কুলাউড়া প্রতিনিধি

১১ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ০০:৪৯

কুলাউড়া জালালীয়া মাদ্রাসা: অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতায় প্রশাসনিক কাজ বন্ধ

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার জালালিয়া দাখিল মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা (স্থগিত) কমিটির সভাপতি ও সুপারের ক্ষমতার দাপটে প্রতিষ্ঠানটি প্রশাসিনক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। মাদ্রাসার দশম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানীর ঘটনায় এক মাস ধরে মাদ্রাসা সুপার মো. আব্দুস শহীদ জেলহাজতে রয়েছেন।

তবে সুপার জেলহাজতে থাকার কথা জানেন না এমন মন্তব্য করে স্থগিত কমিটির সভাপতি আব্দুর রউফ জানান, সুপার ছুটিতে রয়েছেন।

এদিকে, এমন জটিলতায় প্রশাসনিক কাজে মাদ্রাসার প্রশংসাপত্র নেওয়া সহ দাপ্তরিক সকল কাজের জন্য বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

অভিযোগ রয়েছে, মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা (স্থগিত) কমিটির সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফ ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কৌশলে মাদ্রাসার প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রমে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন এবং জেলে থাকা সুপার ও তাঁর আশির্বাদপুষ্ট মাদ্রাসার সহকারি শিক্ষক আব্দুস সামাদ মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের চাবি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহকারি সুপারকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। ব্যবস্থাপনা কমিটি মেয়াদউত্তীর্ণ হলেও স্থগিত কমিটির সভাপতির কারণে নতুন কমিটি গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

এমন অনিয়মের কবল থেকে মাদ্রাসাকে রক্ষা করতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এডহক কমিটি গঠন ও ভারপ্রাপ্ত সুপাররের দায়িত্ব দেয়ার জন্য ২২ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক ও স্থানীয় এলাকার ৩০ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত একটি লিখিত আবেদন করা হয়। যার অনুলিপি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের রেজিস্টারসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া একই তারিখে ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্বের জন্য ইউএনও বরাবরে মাদ্রাসার ১০ জন শিক্ষকের স্বাক্ষর সম্বলিত আরেকটি আবেদন করা হয়।

আবেদনে কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় এডহক কমিটি গঠন এবং বর্তমান সহকারি সুপার মাওলানা মুজিবুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়।

মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রিসাইডিং অফিসারের ওপর অনাস্থা এনে নির্বাচন স্থগিত চেয়ে দুই অভিভাবক আব্দুল হান্নান ও মখলিছ মিয়া গত বছরের ১৪ জুলাই হাইকোর্টে একটি পিটিশন (নং-৮৭৩০) করেন। এদিকে অভিভাবক মো. আব্দুল হান্নানের ছেলে মোস্তাফিজ হোসেন রাহিম নামে শিক্ষার্থী কুলাউড়ার কামারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র বলে প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষরিত প্রত্যয়ন পত্রে জানা গেছে। কিন্তু সেই রাহিমকে জালালীয়া মাদ্রাসার ছাত্র দেখিয়ে তার পিতাকে দিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করানো হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটি ২০০০ সালে এমপিওভূক্তি লাভ করে। মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটি ২০১৯ সালের ১৩ আগস্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। বিধি মোতাবেক নতুন কমিটি গঠনে প্রশাসনের কোন আদেশ কার্যকর হচ্ছে না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার একাধিকবার মাদ্রাসা সুপারকে পত্র ইস্যুর মাধ্যমে মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি গঠনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার নির্দেশ দিলেও সুপার তাতে কর্ণপাত করেননি। ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে আবেদন করেন মাদ্রাসার সুপার আব্দুস শহীদ। এরই প্রেক্ষিতে ইউএনও পরবর্তীতে ১৭ জুন শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রিজাইডিং অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আনোয়ার ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনী তফশীল ঘোষণার লক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানে অনুরোধ জানালেও সুপার আব্দুস শহীদ প্রিসাইডিং অফিসারকে কোন তথ্য দেননি। প্রয়োজনীয় তথ্য না পেয়ে নির্বাচনী তফশীল ঘোষণা করতে পারেননি মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। পরবর্তীতে নির্বাচনের তফসীল কেন ঘোষণা হলো না মর্মে ইউএনও ফের ১১ জুলাই পত্র ইস্যুর মাধ্যমে সুপারকে অনুরোধ করেন। তাতেও সাড়া দেননি সুপার শহীদ।

মাদ্রাসার স্থগিত কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফ জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক ও কুলাউড়া ইয়াকুব তাজুল মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সুপার আব্দুস শহীদকে দিয়েই সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে মাদ্রাসা পরিচালনা করে আসছিলেন। তিনি একবার নির্বাচিত সভাপতি হলেও বাকি কয়েক মেয়াদে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে মাদ্রাসার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট গঠিত কমিটির প্রথম সভায় যে ৮ জন অভিভাবক সদস্যদের উপস্থিতি উল্লেখ করা হয়েছে তারমধ্যে অনেকেই জানেন না তারা এই কমিটির সদস্য আছেন কি না।

ওই মাদ্রাসার অভিভাবক সদস্য বাবুল মিয়া বলেন, ২০১৭ সালে আমাকে সদস্য করা হয়েছে বলে জানানো হয় কিন্তুু এরপর মাদ্রাসা কমিটির কোন সভায় একদিনও আমাকে ডাকা হয়নি। সভায় আমার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। আরেক অভিভাবক সদস্য লিলা বেগম বলেন, একদিন কমিটিতে রাখার জন্য নাম নিলেও কোন সভায় আমাকে দাওয়াত করা হয়নি। আমি সদস্য আছি কি না তা জানি না।

এ ব্যাপারে মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা (স্থগিত) কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফ প্রতিবেদককে জানান, মাদ্রাসায় শিক্ষকদের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্ধের কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে বর্তমানে নির্বাচন কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।

মাদ্রাসার বিভিন্ন অনিয়ম হচ্ছে ও সুপার জেলহাজতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে কোন অনিয়ম থাকলে সেখানে আইন আছে। মাদ্রাসায় কোন অনিয়ম হয়নি আর সুপার কোথায় আছেন জানি না তবে সুপার আমার কাছ থেকে ছুটি নিয়েছেন। বর্তমানে মাদ্রাসার প্রশাসনিক কার্যকম কিভাবে চলবে আমি মানুষ ঠিক করে দিয়েছি। বর্তমানে মাদ্রাসার কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। অন্য এক স্কুলের ছাত্রকে মাদ্রাসায় ভর্তি দেখিয়ে তাঁর পিতাকে দিয়ে হাইকোর্টে পিটিশন কিভাবে করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইন সবাই জানেনা, একজনের পক্ষে আরেকজন পিটিশন করতেই পারে। মাদ্রাসার পরিবেশ নষ্ট করার জন্য একটি মহল এসব ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আনোয়ার বলেন, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি আজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সম্পূর্ণভাবে মাদ্রাসা সুপারের অসহযোগিতার কারণে কমিটি গঠনে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা যায়নি। আর ভারপ্রাপ্ত সুপারের বিষয়ে ইউএনও মহোদয়ের সাথে আলোচনা করবো।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, মাদ্রাসার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের আরো আন্তরিক হতে হবে। মাদ্রাসায় কমিটি না থাকায় প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের কোন নির্দেশনা পাইনি। শুধু আমার স্বাক্ষরে পরিপত্রের আলোকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সুপারের অবর্তমানে সহকারী সুপার দায়িত্ব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন বিষয়ে মহামান্য আদালতের নির্দেশনা পাওয়া সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত