বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি

০২ মার্চ, ২০২০ ১৮:৫৪

প্রেমিকার বিয়ে হওয়ায় সুইসাইড নোট লিখে যুবকের আত্মহননের চেষ্টা

প্রেমিকার বিয়ের খবর শুনে সুইসাইড নোট লিখে বিয়ানীবাজারের সত্যজিৎ নামের এক যুবক আত্মহননের চেষ্টা করেছেন।

শাঁখা-সিঁদুর গ্রহণের পর প্রিয়তমার বিয়ে হয়ে গেছে জেনে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অভিমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে স্থিরবুদ্ধিতে আত্মহননের চেষ্টা চালান সত্যজিৎ দাস।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি ৮ হাজার ৬শত ৪৯ শব্দের ‘সুইসাইড নোট’ লিখে পূর্ণিমার জন্য জীবন উৎসর্গের প্রস্তুতি নেন। সুইসাইড নোট আপলোড করার সাথে পূর্ণিমার সাথে তার দীর্ঘ সময়ে ৭৫টি ছবিও আপলোড করেন তিনি।

ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখলেও সত্যজিৎ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ১ মার্চ গভীর রাতে। বিষাক্ত কীটনাশক পান করে নিজ বসতঘরে চিরনিদ্রার প্রস্তুতি নেন তিনি। চিরনিদ্রায় যাওয়ার পূর্বে পড়ে নেন গত দুর্গাপূজায় পূর্ণিমায় দেওয়া উপহার পাঞ্জাবি। এ পাঞ্জাবিতে পূর্ণিমার হাতে ছোঁয়া রয়েছে জানিয়ে সুইসাইড নোটে পাঞ্জাবি পরেই আত্মহনন করার বাসনার কথা জানান সত্যজিৎ।

১ মার্চ গভীর রাতে তার ঘুঙানির শব্দ শোনে পরিবারের সদস্যরা ছুটে আসেন। সত্যজিৎ সে সময় অচেতন, মুখ দিয়ে লালা বের হচ্ছে। স্বজনরা তাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সেখানে তার চিকিৎসা চলছে। তবে তিনি এখনো আশঙ্কামুক্ত নন।

ফেসবুকে নিজের ব্যক্তিগত আইডি থেকে সত্যজিৎ লিখেন, ‘পূর্ণিমা রানী নাথকে আমি খুব ভালোবাসতাম, ভালোবাসি আর পরজনমেও ভালোবাসব। পূর্ণিমাও আমাকে খুব ভালোবাসত। দু’জনের বুঝাপড়া, পছন্দ, অপছন্দ প্রায়ই মিলে যেত। দু’জনের কল্পনার একটা সংসার ছিল। পূর্ণিমার সাথে কাটানো সময় আমার জীবনের সেরা মূহুর্ত ছিল, আমি বেঁচে থাকবো আর পূর্ণিমা অন্যের সংসার করবে, তা কখনো হতে পারে না। সুইসাইড করার জন্য মা, ছোট-বড় ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগ্না-ভাগ্নি, কাকা-মামা, পিশি-মাসী, বন্ধু-বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজন, পরিজন সবার কাছে আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি মহাপাপিষ্ট, সর্বকনিষ্ট এক নরাধম। জানি সর্বধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ হিসেবে বিবেচিত। তারপরেও আমি করতেছি।’

নিজের প্রেম আর আবেগের কথামালা এভাবে তোলে ধরে প্রায় মাসখানেক অপেক্ষা করেন সত্যজিৎ। প্রথম দিকে পূর্ণিমা তার জন্য ব্যাকুল হলেও শেষ দিকে এসে মুখ ফিরিয়ে নেন। পূর্ণিমার পরিবারের সবার সাথে শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন। তবুও পূর্ণিমা ফেরেনি, ভুলতে পারেননি ফেলে আসা দিনের অনুভূতি।

বিয়ানীবাজার থেকে রাজধানী ঢাকা; ভালোবাসার সহস্র খুনসুটিগুলো বারবার ফিরে আসতো প্রিয়তমা হারানোর কষ্ট নিয়ে। তাই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার পর অনেকের অনুরোধ-উপদেশ কিংবা মায়ের মিনতি কিছুই তাকে টলাতে পারেনি। আবেগী মন শেষ সময় পর্যন্ত পূর্ণিমাকে চেয়েছে। মৃত্যুর পথে যাত্রাকালেও সত্যজিতের পড়েছিলেন পূর্ণিমার দেওয়া পাঞ্জাবি।

সত্যজিৎ দাস বিয়ানীবাজার পৌরশহরের নয়াগ্রামের বাসিন্দা। তিনি স্থানীয় সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক হিসেবে কর্মরত আছেন।

পূর্ণিমা রাণী নাথ বড়লেখার বাসিন্দা। তিনি একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে চাকুরি করেন। ২০১৬ সাল থেকে তাদের পরিচয়, প্রেম এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে চলাফেরা। এই সময়ের মধ্যে সত্যজিৎ-পূর্ণিমাকে কাদিপুর শিবমন্দিরে শাঁখা-সিঁদুর পরিয়ে দেন। এর মধ্যে একাধিকবার তাদের অভিমান হয়, কথাও বন্ধ ছিল অনেকবার।
পূর্ণিমার ভাই এক মন্ত্রীর সহকারী। সেই মন্ত্রীকেও অবহিত করা হয় পুরো বিষয়। বাদ যাননি বিয়ানীবাজার ও বড়লেখা উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক নেতারা- কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। উল্টো ক্ষমতার দাপট দেখাতে তার পেছনে লেলিয়ে দেয়া হয় পুলিশ, এমনটাই উঠে এসেছে সত্যজিতের সুইসাইড নোটে।

গত ২ ফেব্রুয়ারি সিলেট শহরের একটি বাসায় কঠোর গোপনীয়তায় পূর্ণিমার বিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে বড়লেখার এক শিক্ষকের সাথে পূর্ণিমার বিয়ে ঠিক করা হয়। সে শিক্ষকও পূর্ণিমার অতীত জেনে বিয়ে করতে রাজি হলেও তার পরিবার বাধ সাধায় সে বিয়ে ভেঙ্গে যায়।

পূর্ণিমার সাথে সংসারকর্ম সাধনের জন্য ১৭টি আবেগী চুক্তি হয় সত্যজিতের। কল্পনা রঙ সাজিয়ে তারা দুই সন্তানের জনক-জননী হয়েছিলেন! এভাবে কত কিছুই করে এসব চুক্তির সাক্ষী ছিল দু’নার ভালোবাসা। সব চুক্তি বাতিল, সব স্মৃতি মুছে, সত্যজিতের নিখাদ ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়ে পূর্ণিমা এখন অন্যের ঘরণী। এটা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না সত্যজিৎ। অনিদ্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

নিজের ভালোবাসার গল্প, প্রেমিকার ছলনা এবং তার পরিবারের ক্ষমতার দাপটের কথা বর্ণনা করে তিনি গণভবন, বঙ্গভবন, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজিপিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকের কাছে ই-মেইল করে ফরিয়াদ জানিয়েছেন। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাকে আত্মহত্যা প্ররোচিত করার অপরাধে দোষীদের শাস্তির দাবি জানান তরুণ এ দলিল লেখক। ফেসবুকে আপলোড করা সুইসাইড নোট শেষ হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার প্রার্থনা করেন।

মায়ের কাছে হতভাগা ছেলেকে ক্ষমা করে দেওয়ার আকুতি জানিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। তবে সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় বেঁচে আছেন সত্যজিৎ। ভালোবাসার দহন আর পূর্ণিমার মায়াজাল ছিন্ন করে সত্যজিৎ এভাবে আর কতদিন বাঁচবেন, তা কেবল ঈশ্বর-ই জানেন।

সত্যজিতের পরিবারের সদস্যরা জানান, বিষাক্ত কীটনাশক পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। এখনো তিনি শঙ্কামুক্ত নন।

পঞ্চখন্ড রামকৃষ্ণ মিশনের সাধারণ সম্পাদক অরুণাভ পাল চৌধুরী মোহন বলেন, ফেসবুক স্ট্যাটাসে সত্যজিতের সুইসাইড নোট পড়েছি। তার জীবনে এতো বড় একটি ঘটনা ঘটে গেছে আমরা সেটি এভাবে অনুধাবন করতে পারিনি। সত্যজিৎ সুস্থ হয়ে উঠুক এটাই প্রার্থনা করি।

বিয়ানীবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) অবণী শংকর কর বলেন, এ ধরণের কোনও বিষয় কেউ তাকে অবহিত করেনি। তবে তিনি খোঁজখবর নিবেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত