দেবকল্যান ধর বাপন

২২ মার্চ, ২০২০ ০০:৪৪

অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ঝুঁকিতে সিলেটের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরা

নভেল করোনাভাইরাস

ফাইল ছবি

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরা নভেল করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে বাংলাদেশেও। প্রতিদিনই দেশে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগী। এদিকে প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ায় সিলেটকে বলা হচ্ছে এই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। প্রবাসীরা প্রতিদিনই আসছেন দেশে। সিলেটে আসা অনেক প্রবাসীর বিরুদ্ধে হোম কোয়ারেন্টিনের নির্দেশনা না মানারও অভিযোগ রয়েছে। তো এমন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কর্মরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নেওয়া হয়নি তেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থাই। ফলে ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন তারা।

সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন সিলেটের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কর্মরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাদের জন্য তেমন কোনো নিরাপত্তাসামগ্রীই প্রদান করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দেওয়া হয়নি পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই)। এদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিছু নিরাপত্তাসামগ্রী প্রদান করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকরা বলছেন, রোগীদের পুরোপুরি কাছে থেকে তাদেরকে চিকিৎসাসেবা দিতে হচ্ছে, তাই মনে সংশয় থাকলেও দায়িত্ববোধের কারণে পিছিয়ে যেতে পারছেন না তারা। এদিকে হাসপাতালে পর্যাপ্ত মাস্ক, গ্লাভস, এপ্রোন ও জীবাণুনাশক না থাকায় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরাও সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন বলেও জানান তারা। তাই সংক্রমণ ঠেকাতে ও রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের লক্ষে দ্রুত এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান চিকিৎসকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেটের একাধিক বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এছাড়া হাঁচি-কাশিসহ সব ধরনের সংক্রমণ নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে ঢুকছেন। তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। ন্যূনতম নিরাপত্তাহীন অবস্থায় চিকিৎসকদের ওই রোগীদের প্রদান করতে হচ্ছে।

সিলেট উইমেনস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ইএমও) মো. মোস্তফা জব্বার জাহিদ সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, বর্তমানে আমরা ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই নিচ্ছি। এছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে শনিবার আমাদের মিটিং হয়েছে। তারা জানিয়েছেন আগামী দুই কর্মদিবসের মধ্যে তারা এই হাসপাতালের চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেবেন। বর্তমানে নিজেরাই কিছু সরঞ্জাম কিনে রোগী দেখতে হচ্ছে।

এদিকে শনিবার সকালে সিলেট উইমেনস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে নিজেদের সুরক্ষা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষে কয়েক দফা দাবি জানিয়ে কর্মবিরতিতে যান ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তাদের অভিযোগ, চিকিৎসকদের জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই তারা কর্মবিরতি পালন করছেন।

সিলেট নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজের অভ্যন্তরীণ মেডিকেল কর্মকর্তা (আইএমও) নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রোগীদের যত্ন নেয়া চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা সরকারের পক্ষ থেকে বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কোনো চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। সামনে থেকে যারা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ।

এদিকে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীকে দেখতে আসা স্বজনদের উপস্থিতিও চিকিৎসকদের উদ্বেগের একটা কারণ। এতে যেমন চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত হয়, তেমন রোগ সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকেন চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা।

যদিও শনিবার সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যাপারে এখনও কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

সিলেট পার্কভিঊ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত এক নারী চিকিৎসক অভিযোগ করে বলেন, সরকার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য কোন পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। আমরা ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে চিকিৎসকসহ হাসপাতালের প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সুরক্ষার ব্যাপারে কথা বলেছি। উনারা জানিয়েছেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের প্রতিটি ফ্লোরে ৫টি করে মাস্ক সরবরাহ করা ব্যতীত অন্যকোনো পদক্ষেপই এখনো গ্রহণ করেনি।

একই চিত্র সিলেটের প্রায় সবগুলো প্রাইভেট হসপিটাল ও ক্লিনিকে। ন্যূনতম সুরক্ষা ছাড়াই হাঁচি-কাশিসহ সব ধরনের সংক্রমণের রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

আর সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিছু নিরাপত্তাসামগ্রী প্রদান করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে কর্মরত ডা. কায়সার খোকন বলেন, হাসপাতালে মাস্ক, গাউনসহ নিরাপত্তা সরঞ্জাম এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা হয়নি। তাই নিজেরাই কিছু সরঞ্জাম জোগাড় করে অন্যান্য রোগী দেখতে হচ্ছে। এ মুহূর্তে হাসপাতালে সর্দি, কাশি, জ্বর ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের সরাসরি দেখার মতো পরিস্থিতি নেই বলে মনে করেন তিনি। এ জন্য তাদের বিশেষ কক্ষে পাঠানো হচ্ছে। সেখান থেকে চিকিৎসাপত্র নিয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হচ্ছে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর) বলছে, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিলে সবচেয়ে বেশি হুমকিতে পরবেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. এম মুশতাক হুসাইন বলেন, প্রতিটি চিকিৎসকসহ নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা যখন রোগীদের কাছাকাছি যাবেন তাদের অবশ্যই মাস্ক, গ্লাভস ও এপ্রোন পড়তে হবে। এ ছাড়া রোগীকে পরীক্ষা করতে কেউ যদি তার খুব কাছে যায় তাহলে তাকে পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট বা আত্মরক্ষামূলক সরঞ্জাম (পিপিই) পড়তেই হবে।

এ ব্যাপারে প্রাইভেট হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স এসোসিয়েশন সিলেটের সভাপতি ডা. নাসিম আহমদ সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আক্ষেপ করে বলেন, জাতির একটি ক্রান্তিলগ্নে আমরা নিরুপায়। আজ যেখানে আমদের রোগীদের পাশে দাঁড়ানোর কথা সেখানে আমরা অসহায়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের কাছাকাছি যাওয়ায় দেশে চারজন চিকিৎসককে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে, এমন খবরেও সিলেটের চিকিৎসকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

দেশে পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট বা আত্মরক্ষামূলক সরঞ্জামের (পিপিই) পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় আমরা রোগীদের কাছাকাছি যেয়ে চিকিৎসাসেবা না দিতে পারছি না মন্তব্য করেন এ চিকিৎসক।

সিলেটের সিভিল সার্জন প্রেমানন্দ মণ্ডল এ ব্যাপারে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, এ ব্যাপারের সরকারের পক্ষ থেকে এখনোও পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তবে এ বিষয়ে দ্রুতই নির্দেশনা আসতে যাচ্ছে।

তবে শুক্রবার সিলেট শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য খোলা আইসোলেশন সেন্টারের জন্য পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট বা আত্মরক্ষামূলক সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহ করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এদিন সকালে শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে পিপিই হস্তান্তর করেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কর্তৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে সিলেট শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. সুশান্ত কুমার মহাপাত্র বলেন, পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট বা আত্মরক্ষামূলক সরঞ্জামসহ (পিপিই) বেশ কিছু সরঞ্জাম আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। আগে আমরা আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে কাজ করছিলাম।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত