মোসাইদ রাহাত, সুনামগঞ্জ

১৭ এপ্রিল, ২০২০ ১৯:২৮

মাঠে সোনালী ধান, তবুও শঙ্কায় হাওরের কৃষক

সুনামগঞ্জের হাওর জুড়ে এখন সোনালী ধান। হাওরের পানি অনেকটা দেরীতে নামায় বেরো ধানের চাষাবাদও শুরু হয় কিছুটা বিলম্বে। তবে এবার ফলন হয়েছে ভালো। কিন্তু মাঠে সোনালী ধান থাকলেও কৃষকের মনে নেই কোন আনন্দ। কারণ করোনাভাইরাসের জন্য নেই কোন ধান কাটার শ্রমিক এবং তারউপর আছে ভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা।

ফলে মাঠে বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের চোখে মুখে শুধু শঙ্কা। তাছাড়া সরকার থেকে কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার জন্য যন্ত্রপাতি দিলেও সেটা জুটি না সবার কপালে। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, ধান কাটার শ্রমিক আনতে কয়েকটি জেলার কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তারা। ইতিমধ্যে শ্রমিকও আসতে শুরু করেছে সুনামগঞ্জে।

জেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, এবছর জেলায় ১১টি উপজেলা ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে দুই লাখ ২০ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। যার মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ১৬ হাজার ১৬২ হেক্টর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেরায় ১০ হাজার ৮০০ হেক্টর, ধর্মপাশা উপজেলায় ৩১ হাজার ৭২০ হেক্টর, জামালগঞ্জ উপজেলায় ২৪ হাজার ৪৬৫ হেক্টর, তাহিরপুর উপজেলায় ১৭ হাজার ৫২৭ হেক্টর, দিরাই উপজেলায় ২৭ হাজার ৭৭৬ হেক্টর, শাল্লা উপজেলায় ২১ হাজার ৮৮২ হেক্টর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় ২২ হাজার ৩৩৯ হেক্টর, জগন্নাথপুর উপজেলায় ২০ হাজার ৬১০ হেক্টর, দোয়ারাবাজার উপজেলায় ১২ হাজার ৯৬০ হেক্টর এবং ছাতক উপজেলায় ১৪ হাজার ৭০২ হেক্টর জমিনের আবাদ হয়েছে বোরো ধান।  সেখানে ধানের উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ মেট্রিক টন।

সরজমিনে, সুনামগঞ্জের বেশ কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখাযায় মাঠে রয়েছে সোনালী ধান। বাংলাদেশের তিন মাসের খাদ্য যোগান দেয় এ জেলা থেকে উৎপাদিত ধান। কিন্তু মাঠে ধান থাকলেও একার পক্ষে ধান কাটার সামর্থ্য নেই কৃষকদের। প্রতিবছর বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়ে আসলেও এবার অতিরিক্ত মজুরি দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না শ্রমিক যার কারণে কৃষকদের মাঠের ধান বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাত্র ৪.০৩ শতাংশ কাটা হয়েছে।

কৃষকদের দাবি, ধান কাটার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি যদি দেওয়া হয় তাদের, তাহলে দ্রুতই মাঠ থেকে ধান ঘরে নিয়ে আসতে পারবেন তারা। তা না হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডে দেওয়া ১৭-২০ এপ্রিলের মধ্যে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাতের আগাম সর্তকবার্তা সব ধান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার একটি বড় ধরনের আশঙ্কা করছেন হাওর পাড়ের কৃষকরা।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার দেখার হাওরে বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক মাসুক মিয়া বলেন, আমার ১৫ একর জমিত এইবার বোরো ধানের ক্ষেত করছিলাম। এখন আমার পক্ষে তো একলা সব ধান কাটা সম্ভব না। অন্যবার ৫০০ দিয়া রোজ মানুষ রাখতাম এইবারও ১০০০ টাকা দিয়াও ফাইরাম না।

একই হাওরের কৃষক মুজিবুর আহমেদ বলেন, আল্লাহর রহমতে ধান ভালা হইছে। কিন্তু ধান কাটারতো মানুষ ফাইরাম না। শুনছি সরকার থকি যন্ত্রপাতি দিবো কিন্তু আমরা তো ফাইতাম না। যারা সম্পর্ক ভালা তারা ফাইবো, ধান কাটার মানুষ না পাইলে যে বৃষ্টি শুরু হইছে সব ধান পানির তলে যাইবো পরে পথে বওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা নাই।  

ধর্মপাশা উপজেলার চামরদানী ইউনিয়নেরবিচরাকান্দা গ্রামের কৃষক আহম্মদ আলী বলেন, বাহির জেলা থকি বেপারি (শ্রমিক)দের সাথে কথা হইছিলো তারা কইলো গাড়ি নাই কেমনে আইতাম, এখন যাও যারা আছে তারা  ৫০০-৭০০ টাকা বেশি দাবি করছে। তার মধ্যে যে মেঘ শুরু হইছে হাওরের বাঁধ ভাইঘ্যা পানি ডুকিয়া কষ্টের ধান নষ্ট অইবো আমরা ছেলে মেয়ে নিয়া পথে বইমু।

অন্যদিকে ধান কাটার শ্রমিক সংকট মোকাবেলায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসনও। বালু শ্রমিক, পাথর শ্রমিকসহ যারা লক ডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তাদের ধান কাটার আহবান জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যারা ক্ষেতে ধান কাটতে যাবেন তাদের সরকারি রিলিফ দেয়া হবে। রাতে থাকার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে ব্যবস্থা করা হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. সফর উদ্দিন জানান, প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন জেলা প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক সুনামগঞ্জে ধান কাটতে আসতো। এবার করোনা ভাইরাসের কারণে শ্রমিক আসা কমে গেছে। তবে বোরো ধান কাটার জন্য দেশের পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ভোলা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ কয়েকটি জেলার কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগযোগ করেছি শ্রমিক আনার জন্য। ইতিমধ্যে এখন ৩ হাজার ৪৪৩ জন ধান কাটার শ্রমিক আসছে। আরো ১২ হাজার ২৯৪জন শ্রমিক কয়েক দিনের মধ্যে চলে আসবে। স্থানীয়ভাবে অন্য পেশার লোকজনও ধান কাটা শুরু করেছে। আশা করছি শ্রমিক সংকট কিছুটা হলেও কমে যাবে কয়েক দিনের মধ্যে।

তিনি বলেন, আমাদের কৃষি বিভাগের ৯২টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, ১৯টি রিপার সচল আছে। নতুন করে সরকার থেকে নতুন ৪০টি হার্ভেস্টার ও ২৭টি রিপার বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। এগুলো ধান কাটা ও মারাইয়ের কাজে লাগানো হবে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আহাদ বলেন, কৃষকদের উৎসাহ দিতে আমি নিজেও হাওরে ধান কেটে এসেছি। অন্য পেশার শ্রমিকদের ধান কাটায় আনার জন্য আমরা উৎসাহ প্রদান করছি।  শ্রমিক প্রনোদনা হিসেবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০হাজার পিস সাবান, ১০হাজার পিস বিস্কুট বিতরণ করা হবে। কৃষি যন্ত্র মেরামতের জন্য কৃষকদের সুবিধর্তে কামারের দোকান ও ওয়ার্কশপ খোলা রাখার নির্দেশনা প্রদান করেছি। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় দ্রুত ধান কাটার জন্য কৃষকদের বলা হচ্ছে। আমরা চাই আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে হাওরের ফসল কেটে কৃষকের ঘরে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

জেলা সির্ভিল সার্জন ডা. মো. শাসম উদ্দিন বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষদের ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য বলা হলেও সুনামগঞ্জ যেহেতু বোরো আবাদারে এলাকা তাই আমরা সবাইকে বলবো সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং বাহির জেলা থেকে শ্রমিক নিয়ে আসলে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে মাঠের কাজে নিয়ে আসতে হবে। ইতিমধ্যে প্রতি উপজেলায় শ্রমিকদের জন্য ১টি করে মেডিকেল টিম গঠন করেছি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত