ম্যাক সুমন

০৫ জুলাই, ২০১৬ ০২:১৯

সীমান্তের অপার সৌন্দর্য!

দমদমায় যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। পাথুরে ঝিরিপথে গড়ানো পানি দেখে কেউই লোভ সামলাতে পারলাম না। কোনমতে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে সবাই ঝাঁপ দিলাম দমদমায়। দমদমার আরেকটা নাম রয়েছে। স্থানীয়রা একে থুরুং ছড়া বা থ্রুং ছড়া বলে। যতটুকু জানতে পারলাম, সীমান্তবর্তী ঐ এলাকার পাহাড়ি জনগোষ্টির ভাষায় থ্রুং অর্থ হলো, ‘ছোট ঝুড়ি’।

আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ‘হাইকিং ফ্রম জাফলং টু ভোলাগঞ্জ’! জাফলং আর ভোলাগঞ্জ কারও কাছে অচেনা বলে মনে হয় না। সিলেটের সীমান্তবর্তী একটি উপজেলা গোয়াইনঘাট, আরেকটা কোম্পানীগঞ্জ। অপার সৌন্দর্য ও প্রকৃতির লীলাভূমিখ্যাত এই দুই উপজেলায় জাফলং, ভোলাগঞ্জ সীমান্তের সোন্দর্য ছাড়াও অগণিত নাম জানা, না-জানা ছোট-বড় পাথুরে নদী ও ঝিরি রয়েছে। এগুলোর স্বচ্ছ জলধারার শীতল প্রবাহ ভ্রমণপ্রিয় মানুষের তীর্থস্থান। জাফলং এর পিয়াইন নদী, বিছনাকান্দির পাথুরে নদীটা দেশ বিদেশে অত্যন্ত সুপরিচিত।

তবে, আমাদের ‘হাইকিং ফ্রম জাফলং টু ভোলাগঞ্জ’ এর উদ্দেশ্য ছিল, পরিচিত এই নদীগুলো ছাড়া কম পরিচিত ও অপেক্ষাকৃত দূর্গম এলাকায় কোন ঝিরি/ছড়া থাকলে সেগুলো ভ্রমণপিপাসুদের সামনে তুলে ধরা এবং আমাদের ধারণা ছিল, এই পথ ধরে স্থানীয় লোকজন ছাড়া হয়তো কেউ হাইকিং করেন নি। যার ফলে এই সীমান্ত অঞ্চলের সৌন্দর্যটা সম্ভবত বেশিরভাগের নিকট অজানা।

যাইহোক, সকাল ১০ টার দিকে যখন আমরা জাফলং এ পৌঁছলাম, মানুষের কর্মব্যস্ততা তখনও শুরু হয় নি। রমযানের সময় সবাই একটু দেরী করে শুরু করেন সম্ভবত। আর ঝামেলা এড়ানোর জন্যই আমরা রমযানের দিনেই হাইকিং শুরু করি। খেয়া করে পিয়াইন নদী পার হতে হতে সিদ্ধান্ত নিলাম, পথে যাই পড়বে কোনকিছু বাদ দেব না। সেটা ট্যুরিষ্ট স্পট হোক আর এক্সট্রিম কিছু হোক। যেই ভাবা সেই কাজ। নদী পার হয়েই সংগ্রামপুঞ্জি।

ঐতিহ্যবাহী এই পুঞ্জিতে খাসিয়া জনগোষ্টির বসবাস। গ্রামটা বেশ সুন্দর, গোছানো। মজার ব্যাপার হলো, যারাই জাফলং ঘুরতে আসেন, তারা সবাই একবারের জন্য হলেও এই গ্রামে পা ফেলে যান। সংগ্রামপুঞ্জি হলে এদিকের সীমান্তবর্তী শেষ গ্রাম। তবে এই গ্রামের ঠিক উত্তর পাশে একটা ঝর্ণা আছে। আমাদের দেখা সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণাগুলোর একটি। আমার জানামতে, দূর্ভাগ্যবশত এই ঝর্ণাটই ভারত সীমান্তের ভেতরে অবস্থিত। সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সবাই অবাধে সেই ঝর্ণা পর্যন্ত যেতে-আসতে পারেন। আর, ঝর্ণাটার নামকরণও হয়েছে বাংলাদেশের এই গ্রামের নামে; সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা। আমরা ঝর্ণায় পৌঁছে গা শীতল করে নিলাম। ঝর্ণাটা যেমন সুন্দর, তেমন ভয়ঙ্করও। ঝর্ণার উপরের পিচ্ছিল ধাপগুলোতে পৌঁছতে গিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন পর্যটক প্রাণ হারিয়েছেন।

সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা থেকে বেরুতে বেরুতে বেলা সাড়ে বারোটা। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পান্থুমাই। পান্থুমাই আমাদের যাত্রাপথেই পড়ে। সগ্রামপুঞ্জির ভেতরের সবুজঘেরা ঢালাই করা রাস্তা ধরে আমরা লামাপুঞ্জি ও হাজিপুর পাড়ি দিলাম। খেয়া পার হয়ে পান্থুমাই পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর গড়িয়েছে। দেখলাম, কয়েকদিন আগের ঢলের প্রভাবে পান্থুমাই নতুন যৌবন পেয়েছে। পানির শব্দে আশপাশের সবকিছু যেন সংগীতময়।  আমরা সেখানে বড়জোর ১০ মিনিট থামলাম, সময় বাঁচানোর তাগিদে।

এরপর বিছনাকান্দির দিকে আমরা এগুতে থাকলাম। সীমান্তঘেঁষা এই পাথুরে নদীর উপর দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। না থেমে যতটুকু সৌন্দর্য উপভোগ করা গেল, করলাম। ততক্ষণে প্রায় বিকেল সাড়ে ৪টা। সীমান্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমরা এগুতে থাকলাম সোজা পশ্চিশ দিকে। সামনের দিকে আনুমানিক ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে।

আমাদের টিমে আমি ছাড়া আর চারজন অভিযাত্রী হলেন বিনয়, গোপাল, অঞ্জন ও নাম না জানা আরেকজন। সবাই হাঁটতে পারদর্শী। আমাদের আশা ছিল সন্ধ্যার পর পর আমরা উতমা ছড়ায় পৌঁছব। অর্থাৎ, আরো প্রায় ৩ ঘণ্টার পথ। কিন্তু মাঝখানে বাঁধ সাধল ভাঙ্গা রাস্তা আর বন্যার পানি। আমরা যখন প্রথম ঝিরিটার কাছাকাছি পৌছলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা। সিদ্ধান্ত নিলাম, ঐ ঝিরিটার পাশেই আমরা তাবু খাটাব। পৌঁছে জানলাম, এই ঝিরিটার নাম 'দমদমা' বা থ্রুং ছড়া। দমদমা সম্পর্কে আমাদের তেমন কিছুই জানা ছিল না। স্থানীয় আলী হোসেন আমাদেরকে সবকিছু জানালো। এই দমদমা ছড়াই এই গ্রামের পানির উৎস। খাওয়ার পানি থেকে ধোয়ামোছা সবই চলে এই  পানিতে। বারো মাসই প্রায় সমান তালে দমদমা বহে। আরো মজার ব্যাপার হলো, এই দমদমার পূর্বপাশ গোয়াইনঘাট, আর পশ্চিমপাশ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা।

আলী হোসেন আমাদের সন্ধ্যা ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করল। ছোলা-মুরি ছিল সন্ধ্যায়, আর রাতে মুরগীর মাংস। প্রকৃতির কাছাকাছি বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষ কি পরিমাণ উদার ও অতিথিপরায়ণ হয়, আলী হোসেনদের সাথে না মিশলে বুঝা যাবে না। তার নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা স্বত্বেও সে ছিল খুবই আন্তরিক।

যাইহোক, সন্ধ্যার খাবারের পর আমরা তাবু খাটালাম, ঠিক দমদমার তীরে। পানির কলকল শব্দে কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ মানুষের কথাবার্তার তীব্রতায় জাগলাম। এখানের মানুষ খুব আগ্রহী হয়ে আমাদের তাবুবাস দেখছে। তাবুর চারপাশ ঘুরেঘুরে কেউ কেউ সবজান্তার মত মন্তব্য করছে; তাবুতে বৃষ্টির পানি ঢুকবে কি না, বাতাস ভেতরে ঢুকছে কি না, ইত্যাদি। রাত প্রায় ১ টা। তাবু থেকে বের হয়ে ১০/১২ জন মধ্যবয়সী আর যুবককে আবিষ্কার করলাম। এরমাঝে আলী হোসেনও আছে। পরে জানলাম, সে আমাদের পাহারা দিতে আসছিল, যাতে কোন ক্ষয়ক্ষতির সম্মূখীন না হই।

আমরা রাতের খাবার শেষে স্থানীয় স্কুলে রাত যাপন করলাম। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের ভয় ছিল, তাই এই ব্যবস্থা। সকাল সকাল উঠে উতমা ছড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। সামনে ৫/৬ কিলোমিটার পথ। মাঝখানে আরেকটা ঝিরি। নাম থানচিনি ছড়া। স্থানীয়রা এটাকে কুলি/কুলী ছড়া বলে। আশেপাশে কুলী সম্প্রদায়ের বসবাস হওয়ার কারণে খুব সম্ভবত এটার নাম কুলী ছড়া। কুলী ছড়ায় পৌঁছে বুঝলাম, এই ট্যুরে দেখা সবগুলো ছড়া, ঝর্ণার মাঝে এটাই সবচেয়ে পাথুরে ও গভীর; আকর্ষণীয়ও বটে। এটা দেখে দেখে শেষ হওয়ার মত নয়। একেবারে সীমান্তের কাছ থেকে ঝিরিপথ ধরে হেঁটে হেঁটে অনেক সময় ধরে আমরা এটা দেখলাম। স্বচ্ছ পানি, গভীরে বড় বড় সাদা-লাল পাথর। স্থানীয়রা এখানে মাছ ধরছে। কেউ কেউ গোসল সেরে বাড়ি ফিরছে। আমরা পা ভিজালাম, গা ভিজালাম, শীতল হলাম।

কুলী ছড়া থেকে উতমা ছড়া পৌঁছতে আমাদের খুব একটা সময় লাগে নি। মোটে আধা ঘন্টা হবে হয়ত। এখানে কিছুটা ধ্বংসের ছোঁয়া লেগেছে। যেদিকে তাকানো, যায় বড় বড় গাড়ি আর খননযন্ত্র। বাড়ির উঠোন থেকে নদীর মাঝখান পর্যন্ত চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। পাথর যেন নয়, টাকা খুঁড়ে খুঁড়ে তুলছে মানুষ আর দানবাকৃতির যন্ত্র। আমরা একটা গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটছি, নাকি কারখানার ভেতর দিয়ে হাঁটছি, তা শব্দ শুনে বুঝার উপায় নাই।

আমরা অবশেষে উতমা ছড়ায়। মাথার উপর কড়া রোদ, পা শীতল জলে। এখানেও সেই একই রকমের কর্মযজ্ঞ। লোকজন সারি ধরে পাথর তুলছে। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ পাথর নাকি এ অঞ্চল থেকে সরবরাহ হয়। সবচেয়ে ভালো মানের পাথর নাকি এখানেই পাওয়া যায়।

আমরা কাউকে বিরক্ত করতে চাইলাম না। কিন্তু আমাদের দেখে শ্রমিকদের মধ্য থেকে কয়েকজন ছুটে আসল। তারা হয়তো ভেবেছিল, আমরা কোন শুটিং এর কাজে গেছি। কুশল বিনিময় সেরে আমরা তাদের থেকে খানিকটা দূরে চলে গেলাম। এই অঞ্চলের প্রতিটি ঝর্ণা/ঝিরির পানি খুবই পরিষ্কার। পানির নিচে অনেক গভীর পর্যন্ত দেখা যায়। আমরা একটু অগভীর অঞ্চলে জায়গা করে নিলাম। স্বচ্ছ পানির লোভ সামলানো দায়। সবাই আবার ঝাঁপা-ঝাঁপি শুরু করলাম। কিভাবে যে প্রায় ২ ঘন্টা পার হলো, বুঝতে পারি নি। উতমার জল থেকে যখন উঠলাম তখন দুপুর প্রায় ১ টা। ফিরতে হবে।

ভোলাগঞ্জ-সিলেটের রাস্তার অবস্থা ভালো নয়। অনেক ভাঙ্গা। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, হেঁটে আসার পথ ধরেই বিছনাকান্দি হাদারপার বাজারে পৌঁছব। এরপর, ওখান থেকে সিএনজি যোগে শহরে। উতমা ছড়া থেকে হাদারপার বাজার যখন পৌঁছলাম, তখন প্রায় সাড়ে ৪ টা বাজে। প্রায় বিরতিহীন ১৯ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে আসা রীতিমত ভয়ঙ্কর ব্যাপার। মোটামুটি সমতল আর কাদামাটির রাস্তা হওয়ায় কোন অসুবিধা হয় নি আমাদের।

শহরের দিকে রওয়ানা দিলাম। পেছনে পড়ে থাকল পানির কলকল শব্দ, বিশাল পাথরের বাগান আর পাহাড়ি সৌন্দর্য। দূর্গম হলেও এই জায়গাগুলোতে পৌঁছা একেবারে অসম্ভব নয়। কিন্তু এই অঞ্চলের সৌন্দর্যের বিকল্প বের করা একেবারেই অসম্ভব।

ছবি : লেখক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত