সিলেটটুডে ডেস্ক

১১ এপ্রিল, ২০২৩ ০২:০৬

‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিরোধিতা রাষ্ট্রদ্রোহিতাতুল্য অপরাধ’

‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৫২তম বার্ষিকী’ উপলক্ষে “৭১-এর গণহত্যার প্রথম স্বীকৃতি এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার দলিল” শীর্ষক এক আলোচনা সভা সোমবার (১০ এপ্রিল) বিকেল ৩টায় রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনের সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আয়োজনে এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক এমপি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।

অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ’৭২-এর সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল।

আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক এমপি বলেন, ‘১০ এপ্রিল মুজিব নগর সরকার গঠন করা হয়েছিল। জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এই দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা হয়। এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি। তিনি ছিলেন স্বাধীনতাকামী, যে কারণে ইয়াহিয়া খান বলতেন, শেখ মুজিব বিচ্ছিন্নতাবাদী। বঙ্গবন্ধুর প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দারা রিপোর্ট পেশ করতো। সেখানে তারা লিখেছে- শেখ মুজিব স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছে। এগুলো দালিলিক প্রমাণ। অথচ অনেকে এখনও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিকৃত তথ্য প্রচার করে। একটি পক্ষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যাকে বিকৃতভাবে প্রচার করছে। এই অপপ্রচার বন্ধ করার জন্য ‘হলোকাস্ট ডিনায়াল অ্যাক্ট’-এর মত আইন প্রণয়ন করতে হবে।’

‘১০ এপ্রিলকে জাতীয়ভাবে পালন করতে হবে তিনি বলেন।’

নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ হচ্ছে স্বাধীনতাকামী কোন দেশের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ়োক্তি বা দাবি। এই ঘোষণাপত্র আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা তখনই বৈধতা লাভ করে যখন তা প্রদান করেন দেশের বা জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বা স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদী নেতৃত্ব। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জারীকৃত কসোভোর একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা সার্বিয়া যখন আন্তর্জাতিক আদালতে চ্যালেঞ্জ করে তখন (জুলাই ২০১০) আদালতের রায়ে এই নিরিখে বলা হয়- ‘কসোভোর স্বাধীনতার ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেনি।’

‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন স্বাধীনতাকামী জাতির অবিসংবাদী নেতা হিসেবে, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি হিসেবে। আন্তর্জাতিক আইন অন্য কাউকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের অনুমোদন করে না। কোনও দেশে কেউ যদি তা করেও থাকেন তার কোন আন্তর্জাতিক বৈধতা নেই। দালাইলামা তিব্বতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন ১৯৫৯ সালে। যেহেতু তিনি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি ছিলেন না সেহেতু তাকে এবং স্বাধীনতাকামী তিব্বতিদের আশ্রয়দানকারী ভারতও দালাইলামার স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি।

‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করেছেন, যে কারণে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। ‘বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি’ এ কথা বলার অর্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্বীকার করা, আন্তর্জাতিক আইনে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা অস্বীকার করা এবং ইতিহাস অস্বীকার করা। যারা এ ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ করবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’

‘বিএনপি-জামায়াতের বাংলাদেশবিরোধী ও রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ড দেশবাসীর সামনে তুলে ধরবার জন্যেও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ দিবস অথবা ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ পালন করতে হবে। একই সঙ্গে বলতে হবে যারা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অস্বীকার করবে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, তারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের অযোগ্য। সময় হয়েছে ইউরোপের মতো আইন প্রণয়নের। হলোকস্ট অস্বীকার করা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ’৭১-এর গণহত্যা অস্বীকার কিংবা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্বীকার শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করে নতুন আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে উঠেছে।’

‘মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের সহজ পাঠ পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন।’

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ’৭২-এর সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সংবিধান ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সৃষ্টি এক রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রেক্ষিতে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ তারিখ থেকে কার্যকর এবং এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উক্তরূপ স্বাধীনতার ঘোষণা দৃঢ়ভাবে অনুমোদন ও সমর্থন করা হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর অস্থায়ী সংবিধান ঘোষণা করা হয়, যেখানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের স্বীকৃতি রয়েছে। একইভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সমর্থন ও স্বীকৃতি মিলে সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম বাক্যে এবং সংবিধানের ১৫০ (৩) অনুচ্ছেদে। যেখানে বলা হয়েছে “স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং তাহা আইন অনুযায়ী যথার্থভাবে প্রণীত, প্রযুক্ত ও কৃত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল”। সে কারণে ৮ম সংশোধনী মামলার রায়ে বিচারপতি জনাব বদরুল হায়দার চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র-কে বলেছেন “সংবিধান সৃষ্টিতত্ত্ব” এবং এ কারণে, আমাদের সংবিধান অনন্য সাধারণ।

‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মূল যুক্তি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা। আমরা যদি আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির পটভূমি স্মরণ করি, তাহলে সঠিকভাবে সংবিধান বুঝতে ও আত্মস্থ করতে সক্ষম হবো। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার লক্ষ্য ও চেতনা সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং তার প্রতিফলিত চেতনায় উদ্দীপ্ত ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং সে ক্ষমতা সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।’

মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ‘১০ এপ্রিল আমাদের জন্য একটি আনন্দের দিন। কিন্তু একটি মহল স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ একটি বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন, শেখ মুজিব তার ভাষণ শেষ করেছে ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন। আমরা অধ্যাপক ইমতিয়াজের শাস্তি চাই। তিনি বঙ্গবন্ধুসহ ৩০ লক্ষ শহীদদের অবমাননা করেছেন।’

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণা হওয়ার পরই আমাদের মনে হতে থাকলো দেশ একদিন স্বাধীন হবে। ঘোষণাপত্রটি সংবিধানের মতই পবিত্র। আমরা গত একুশ বছর দেখেছি এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে একটি মহল বিকৃত তথ্য প্রচার করছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারিয়েছি তাদের জন্য এটি খুবই কষ্টের। যারা স্বাধীনতার ঘোষণা ও গণহত্যা নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং এ সংক্রান্ত লেখা পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করা উচিৎ’ বলে মন্তব্য করেন।

১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘যে দেশগুলো স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল বাংলাদেশ তার অন্যতম। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ এর প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন, তা স্বীকৃতি পায় ১০ এপ্রিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানের মূলভিত্তি। এটি সরকারিভাবে পালন করা উচিৎ। নির্মূল কমিটি প্রতিবছর দিবসটি পালন করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে গতকাল হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছে। অথচ এটি ইউনেস্কো হতে স্বীকৃত। একটি বিশেষ মহল বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই কাজগুলো করে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে।’

তিনি ‘১০ এপ্রিল দিনটিকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি বাঙালি জাতির সংকটময় মুহূর্তে রচিত হয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন। এর উপর ভিত্তি করে অনেকদিন রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর একটি পক্ষ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অবমাননা শুরু করে। তারা গণহত্যাকে স্বীকার করে না। বাংলাদেশের গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আমরা দাবি জানিয়ে এসেছি। বর্তমান সরকারকে অনুরোধ করব মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতরোধ করার পাশাপাশি, আগামী নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পদক্ষেপ নেয়ার জন্য।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত