রাজেশ পাল

১৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ২২:৫৭

রি-বার্থ অফ ফ্রাঙ্কেস্টাইন!

মেরী শেলীর ফ্রাঙ্কেস্টাইন গল্পটি আশা করি সবারই পড়া আছে। দিনরাত ল্যাবরেটরিতে সুপার হিউম্যান তৈরির প্রাণান্ত প্রচেষ্টা শেষে দানবটির জন্ম দিয়েছিলেন তরুণ বৈজ্ঞানিক ফ্রাঙ্কেস্টাইন। কিন্তু একসময় সে দানবের হাতেই মৃত্যু ঘটে একের পর এক তার পরিবারের সদস্যদের। পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন ফ্রাঙ্কেস্টাইন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তারও। নিজের সৃষ্ট দানবের হাতেই করুণ মৃত্যু ঘটে তার।

শাহবাগের উত্তাল দিনগুলোতে "শুয়োরের সাথে সহবাসের ফতোয়া" অস্বীকার করা দামাল তারুণ্যকে ঠেকাতে সুচতুরভাবে দেশের সিংহভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে উত্তেজিত করার কূটকৌশল হিসেবে মাহমুদুর রহমানের "আমার দেশ" পত্রিকাচক্র প্রচার করা শুরু করে যে শাহবাগ আন্দোলন আসলে নাস্তিকদের আন্দোলন। ব্লগার আরিফ জেবতিক বেশ ক্ষোভের সাথেই এক টকশোতে বলেছিলেন, "আমি জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখি আমাদের ছবি নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে আমার দেশ পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে"!

এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। রাতারাতি নাস্তিক দমনের জিহাদী জোশে সংগঠিত হয় হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি। "ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালানো নাস্তেক বলগারদের পুসির দাবি" জানিয়ে দলে দলে জড়ো হন শাপলা চত্বরে।

শাহবাগের আন্দোলনের কার্যত সমাপ্তি হলেও এই সংগঠনটির তৎপরতা কিন্তু থেমে থাকেনি। উপরন্তু সবাই দেখেছেন সরকারি দলের একাধিক কর্তাব্যক্তি ও হাটহাজারিতে ছুটে গেছেন শফি হুজুরকে শান্ত রাখতে। তাকে সন্তুষ্ট রাখতে রেলের জমি লিজ দেয়া শুরু করে অনেক উদ্যোগই নিয়েছেন তারা। এই নতজানু নীতি কিন্তু তেমন কোন কাজেই আসেনি। এতো এতো উপহার পেয়ে হুজুর শান্ততো হনই নি, বরং উত্তরোত্তর বেড়ে গেছে তাদের দাবি দাওয়া। আর অনেকটা সহজেই মেনে নেয়া হয়েছে।

গতবছর তারা হঠাৎই দাবি তোলে পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু আর নাস্তিক লেখকদের লেখা বাদ দেওয়ার। সেসময় এটা নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক সমালোচনা করাও হয়েছিলো। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেখা গেলো এবছর পাঠ্যপুস্তক থেকে ঠিকই প্রায় ৩৭ টি মানসম্পন্ন লেখা প্রত্যাহার করা হয়েছে তাদের দাবি মেনে। কিন্তু যোগ করা হয়নি জঙ্গিবাদ বিরোধী বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নতুন কোন লেখা।

আর এবার তোলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে গ্রীক মাইথোলজির ন্যায়বিচারের প্রতীক দেবী থেমিসের মূর্তি সরিয়ে ফেলার দাবি। অথচ বিশ্বজুড়ে এই প্রতীকটি ব্যবহৃত হয় ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে। এমনকি তাদের অনেকেরই প্রিয় রাষ্ট্র পাকিস্তান ও এর ব্যতিক্রম নয়।

ভাস্কর্য আর মূর্তিপূজার মধ্যে যে যোজন যোজন দূরত্ব রয়েছে তা সম্ভবত তাদের মস্তিষ্কে ধারণ করা সম্ভব হয়নি। দেবী থেমিসের মূর্তিতে কেউ তো আর ফুল, বেলপাতা, তুলসী নিবেদন করেনা যে তা মূর্তিপূজা হিসেবে বিবেচিত হবে! এটা শুধুই একটা ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দাবিতে সফলতা পেলে আমি অবাক হবো না যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাজেয় বাংলা বা শহীদ মিনার বা সাভারের স্মৃতিসৌধ সরিয়ে নেয়ার দাবিও ওঠে। কারণ প্রতিবছর ফুলেল শুভেচ্ছা সহকারে শহীদ স্মরণকেও হয়তো তারা পূজা হিসেবে ঘোষণা দিতে পারেন! কচু কাটতে কাটতেই তো ডাকাত হওয়া যায়!

শুরু করেছিলাম মেরী শেলীর ফ্রাঙ্কেস্টাইন গল্পটি দিয়ে। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষে যেমন সাপুড়ের মৃত্যু ঘটে সেই কালসাপের ছোবলে, তেমনটাই ঘটেছিল বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কেস্টাইনের ক্ষেত্রে।

যুগে যুগে তবুও অবিমৃষ্যকারী চিন্তা থেকেই ফাঙ্কেনস্টাইনদের জন্ম দিয়ে চলি আমরা!

  • রাজেশ পাল : আইনজীবী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত