ড. কাবেরী গায়েন

১৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ২২:৫৯

অলৌকিকে সমর্পণ একজন মার্ক্সবাদীর দর্শন হওয়ার কথা না

কমিউনিস্ট পার্টির, যে কোন দেশেই, তাত্ত্বিক পাটাতন মার্ক্সবাদ। মার্ক্সবাদ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের উপর গড়ে ওঠা। ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন বা ভগবানের ইচ্ছে ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না- এই বিশ্বাসের বিপরীতে এই দর্শনের অবস্থান। কোন অলৌকিকে বিশ্বাস বা সমর্পণ একজন মার্ক্সবাদীর দর্শন হওয়ার কথা না। তার বরং যুক্তি- জীবজগত আর সভ্যতা এক কোষী প্রাণী থেকে শুরু করে নানা বিবর্তন আর শ্রমের ফসল।

‘বানর থেকে মানুষের রূপান্তরে শ্রমের ভূমিকা’ বা এধরণের নামে এঙ্গেলসের বই-ই আছে। কৈশোরে পড়েছি।

অন্যদিকে হজ, তীর্থদর্শন হলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি সমর্পণের বিষয়, যার পুরোটাই বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। দুটো দুই স্কুল।

আমার জানামতে, সিপিবিতে এই মর্মে কোন পার্টি সিদ্ধান্ত নেই যে কেউ ধার্মিক হতে পারবে না বা ধার্মিক হলে পার্টির সদস্যপদ থাকবে না। তবে, কমিউনিস্ট পার্টির মূল নেতাদের যদি মার্ক্সবাদের খুব প্রাথমিক কিংবা বলা ভালো মৌলিক দার্শনিক পাটাতনেই আস্থা না থাকে বা সেই দর্শনের পরিপন্থী কাজ করতে দেখা যায়, তাহলে তাঁর পার্টির সদস্যপদ চলে যাবার অফিসিয়াল বাধ্যবাধকতা না থাকলেও তাঁকে মার্ক্সবাদী মনে করার আর কারণ দেখি না। অনেকটা ডেনমার্কের রাজপুত্রের চরিত্র ছাড়া যেমন 'হ্যামলেট' নাটক মঞ্চায়ন করা যায় না। কিংবা তাকে মার্ক্সবাদী মনে না করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। এখন মার্ক্সবাদে আস্থা না রেখেও কেউ যদি কমিউনিস্ট পার্টি করতে চান, করতেই পারেন। এমনকি অধিকাংশ নেতাও যদি তাঁদের রূপান্তর ঘটান, তাতেই বা কী আসে যায়! পার্টির নাম পালটে 'ইনসাফ পার্টি' নামও নেয়া যেতে পারে। নামে কী বা আসে যায়! শুধু পার্টিতে পাঠচক্রে শেখানো হবে এক জিনিস, আর প্র্যাকটিস করা হবে অন্য- এটা একটু ঝামেলাপূর্ণ হয়ে যায় সত্যি।

তবে এর চেয়েও যে বিচ্যুতি মারাত্মক মনে হয় বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলোতে, তা হলো, শ্রেণীসংগ্রামের ধারকাছ দিয়েও না যাওয়া। সেই তুলনায় একজন প্রাক্তন নেতার হজপালন নিয়ে হৈ চৈ প্রধান দ্বন্দ্বের চেয়ে অপ্রধান দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকার মতোই।

অবশ্য এই বিচ্যুতি যে শুধু বামপন্থীদের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে এমন নয়। কাজেই যে অ-বামপন্থী দলের লোকজনদের এটা নিয়ে বেশ উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে, তাঁরা খেয়াল করলেই দেখতে পারবেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দলের মূল আদর্শ ছিলো সেকুলারিজম (ইহজাগতিকতা), সেই দল এখন মদীনাসনদ অনুযায়ী দেশ চালানোর ঘোষণা দিচ্ছে।

পাকিস্তান আমলে পাঠ্যবইতে নজরুলের ‘মহাশ্মশান’কে ‘গোরস্তান’ করা নিয়ে যে শোরগোল হয়েছিলো, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটির আমলে পাঠ্যবইয়ের পরতে পরতে ‘তৈলচিত্রের ভূত’কে ‘তৈলচিত্রের আছর’ বানিয়ে দেয়ার বিচ্যুতি আমরা হরেদরে দেখছি।

সময়টাই বোধহয় বিচ্যুতির। উত্তর-কাঠামোবাদ, উত্তরাধুনিকতার কাল বলে চালিয়ে দিলেই হয় বোধহয়।

  • কাবেরী গায়েন : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত