মৃণাল কান্তি দাস

০২ মার্চ, ২০১৭ ০০:৫৬

ধর্মঘটে যখন অধর্ম ঘটে

গত ১৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। আমার স্ত্রীকে নিয়ে মেডিকেল যাচ্ছি। সিরিয়াস রোগী। সিলেট পর্যন্ত যেতে শতাধিকবার গাড়ি আটকালেন ড্রাইভার সমিতির লোকজন। হেতিমগঞ্জ পাড়ি দিয়ে বাইপাসে আসতেই রড-লাঠি নিয়ে একদল ধর্মঘটী হুংকার তুলে গাড়ি থামিয়ে দিলেন। আমি বললাম- ভাই, আমার রোগীর ডেলিভারি কেইস, জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে হবে। পেছন থেকে একটা ছেলে ব্যঙ্গ করে বললো, জরুরী মানে কি? মরে গেছে নাকি?

ছেলেটার হাসি হাসি মুখের দিকে থাকিয়ে আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। চরম হতবাক হয়ে কেবল বললাম- ভাইরে, তোমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মত অবস্থায় আমি এখন নেই। থাকলে শুদ্ধ জবাব দিতাম। আমাদের ড্রাইভার আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল- দাদা, মন খারাপ করবেন না, এই ডিপার্টমেন্টের বেশিরভাগই অসভ্য।

এই হলো পরিবহন ধর্মঘট। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দাবী থাকতেই পারে। একটা দেশের বৃহত্তর উন্নয়নে পরিবহন শ্রমিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাদের অক্লান্ত, অনিদ্র পরিশ্রমের বদৌলতে আমরা হাতের কাছে সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাচ্ছি, ব্যবহার করছি। রাত-বিরাতে যেখানে সেখানে যাতায়াত করতে পারছি। কিন্তু তাই বলে দেশের সকল নিয়মের উর্ধ্বে তারা আসীন নন।

বিগত ৬ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলার গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত প্রতিটি রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পরিবহন ধর্মঘট পালন করলেন পরিবহন ড্রাইভারগন। ইস্যু হলো- জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভানুগাছ নামক স্থানে গাড়ি পার্কিং নিয়ে এক বিজিবি সদস্যের সাথে লাঞ্ছনার ঘটনা। খবর নিয়ে জানা গেল, ঐ বিজিবি সদস্যকে লাঞ্ছিত করেছে স্থানীয় এক ড্রাইভার। পরে বিজিবি ব্যাটেলিয়নের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

বিগত ১৮ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলায় পরিবহন ধর্মঘট পালিত হলো। ইস্যু হলো- আগের দিন সিলেট নগরীর উপশহর পয়েন্টে ৪ লিটার মদসহ দুই শ্রমিককে আটক করেছিল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। শ্রমিকদের পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করলে পুলিশের সাথে শ্রমিকদের সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে পুলিশসহ দশজন শ্রমিক আহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে এবং আটক সদস্যদের মুক্তির দাবীতে এই ধর্মঘট পালিত হয়।

২৮ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) হঠাৎ করে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সারাদেশে পরিবহন ধর্মঘট করেছেন শ্রমিকগণ। ১ মার্চ (বুধবার) আধাবেলা ধর্মঘট করে অনির্দিষ্টকাল চলার কথা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন শ্রমিকবৃন্দ। এবারের ইস্যু হলো- চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং মিশুক মনীরের মৃত্যুর জন্য জামির হোসেন নামের এক বাস ড্রাইভারের যাবজ্জীবন এবং সাভারে এক নারীকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মীর হোসেন নামের এক ড্রাইভারের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এই ড্রাইভারদের মুক্তির দাবিতে পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকে দিয়েছেন।

ড্রাইভাররা দাবী করছেন, মাথায় খুনের দায়ভার নিয়ে তারা গাড়ি চালাতে পারবেন না। এটাও আংশিকভাবে যৌক্তিক কথা। কারন, চালককে দুঃশ্চিন্তামুক্ত মাথায় থাকতে হয়। এর অর্থ এই না যে গাড়ি চাপায় মানুষ মারা গেলেও সেটা নিয়ে তাদের কোন চিন্তা থাকবে না। ড্রাইভারদের এই কথাটাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করলে কথাটা এরকম দাঁড়ায়- মানুষ মারার লাইসেন্স না পেলে তারা গাড়ি চালাতে পারাবেন না! এখন প্রশ্ন হলো, সরকারের কি উচিত হবে ড্রাইভারদের মানুষ মারার লাইসেন্স দিয়ে দেওয়া? আজকাল প্রাকৃতিক দূর্যোগ বাদ দিলে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটছে। প্রশ্ন হলো- সেগুলোর সবই কি দুর্ঘটনা? নাকি তার ভেতরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও রয়েছে?

ধরুন, আপনি ফুটপাত ধরে নিয়ম মেনেই হাঁটছেন। পেছন থেকে একটি গাড়ি রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতে উঠে আপনাকে চ্যাপ্টা করে দিয়ে চলে গেল। আবার পক্ষান্তরে ধরুন, আপনি ট্রাফিক নিয়ম মেনে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। একজন লোক ওভারব্রিজে না গিয়ে বেআইনিভাবে রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে গাড়ির নিচে পড়ে প্রাণ হারালেন। এই দু'টো ঘটনার একটিও দুর্ঘটনা নয়। স্পষ্টত এর একটি হত্যা এবং অপরটি আত্মহত্যা।

সেগুলো তদন্ত করবে বিচার বিভাগ- এটাই নিয়ম। তদন্ত করে যেগুলো হত্যাকাণ্ড প্রমানিত হবে, সেগুলোর শাস্তি প্রদান হওয়াটাই যৌক্তিক। আমাদের ড্রাইভারগণ কি করে এই নিয়ম এবং আইনের উর্ধ্বে নিজেদের ভাবছেন? নাকি নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি চরম শক্তিশালী হওয়ায় দেশের যেকোন যায়গায় যে কোন ইস্যুতে ধর্মঘট ডেকে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা ফলাতে চাইছেন?

আমাদের দেশে বর্তমান আইনে একজন চালক মাতাল হয়ে কিংবা ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মেরে ফেললেও দণ্ডবিধির ৩০৪ এর খ ধারায় একটি মামলা হয়, যে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ৩ বছরের কারাদণ্ড। এই আইন সম্পুর্নরূপে 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের পরিপন্থী। দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের উপর জরিপ চালিয়ে বিশেষজ্ঞগণ দেখেছেন একমাত্র বাংলাদেশেই ট্রাফিক আইনের কোনটিই পালন হয় না। এই প্রকার ধর্মঘটের প্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে কতজন ড্রাইভার লাইসেন্স নিয়ে গাড়িতে উঠছেন। সেটা দেখবেন ট্রাফিক পুলিশগণ। কিন্তু তাদের ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা রুখবেন কে? তাছাড়া লাইসেন্স পাবার জন্য পরীক্ষাও লাগে না আজকাল। টাকা দিলে এক সপ্তাহে লাইসেন্স পাওয়া যায়।

রাস্তায় মোটর বাইক কিংবা বাই সাইকেল নিয়ে আমরাও বের হই। তখন আমরাও ড্রাইভার। যখন কোন ঘটনা ঘটে, তখন সেটাতে অবশ্যই কারো না কারোর যে দোষ থাকে, সেটা আমরা ভালো করেই বুঝি। নিজেদের দোষে আমরা যেসব ঘটনা ঘটাই, সেগুলোকে দুর্ঘটনার নামে অন্যের ঘাড়ে ফেলে দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ড্রাইভারগণ এই রকম ধর্মঘট ডেকে নিজেদের বিষয়কে জনগনের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন। দেশে মহামারি আকার ধারণ করে থাকা সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে সর্বাগ্রে দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। পরিবহন শ্রমিকদের মানসিকতার পরিবর্তনও এর জন্য দরকারি। আর সেজন্য প্রয়োজন কঠোর আইন প্রণয়ন। কিন্তু সে আইন পছন্দসই হয়নি বলে সারাদেশ অচল করে দিয়ে ড্রাইভারগণ অপরাধ করছেন।

নিজেদের যেকোন দাবী আদায়ের জন্য সাধারণ জনগনের মত প্রক্রিয়ায় না গিয়ে আগেই ধর্মঘট ডেকে চাপ সৃষ্টি করার একটা প্রবণতা আমাদের শ্রমিকদের ভেতরে জেগে উঠেছে, যে চাপে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রনা পাচ্ছেন সাধারন জনগন। একটা ধর্মঘটে সাধারন মানুষ যে পরিমাণ ভোগান্তিতে পড়েন, সেটা বর্ণনাতীত। দেশে রাজনৈতিক হরতাল, অবরোধে লুকিয়ে লোকজন গাড়িতে চলতে পারতো, কিন্তু এই পরিবহন ধর্মঘটকে ফাকি দেওয়া দুষ্কর।

অন্যায় হলে, অবিচার হলে, তার প্রতিরোধ করার জন্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগোনোর পর্যাপ্ত পথ খোলা আছে। সেগুলোকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের যেকোন স্বার্থ ক্ষুন্ন হলেই এভাবে একের পর এক ধর্মঘট ডাকা নিঃসন্দেহে অপরাধ। এবং আমাদের পরিবহন শ্রমিকরা হয়তোবা সে দিকেই যাচ্ছেন ক্রমশই।

 

(লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত) 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত