দেবজ্যোতি দেবু

১৫ মার্চ, ২০১৭ ১৭:০০

ভুবন মাঝি : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক

অবশেষে দেখা হলো সরকারি সহায়তায় নির্মিত ফখরুল আরেফিন খান'র 'ভুবন মাঝি'। একজন লালন ভক্ত থিয়েটারকর্মীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠা এবং পরে বাউল মতাদর্শী হয়ে মৃত্যুবরণ পর্যন্ত যে দীর্ঘ জীবনচিত্র, তাই 'ভুবন মাঝি'। গল্পকার তার গল্পের মাঝে ১৯৭১ সালের ভয়াবহতা এবং বর্তমান সময়ে মৌলবাদের প্রভাব, বিস্তার এবং কামড় খুব সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়েছে। ভাল কনসেপ্ট এবং গল্প।

শুরুতেই একটি মাদ্রাসার চিত্র দেখানো হয়েছে, যার প্রয়োজন আদৌ ছিল বলে মনে হয়নি। মূল ম্যাসেজ ছিল- একজন বাউলের মৃত্যু সংবাদ শুনে দু'জন হুজুরের দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া। আর যদি দেখাতেই হয়, তাহলে আরো গুছিয়ে দেখানো উচিত ছিল। শুরুতেই একটা দুর্বল দৃশ্যায়ন। এরপর ধীরে ধীরে অনেকগুলো দৃশ্য দেখানোর চেষ্টা হয়েছে একদম হযবরল অবস্থায়। কোন দৃশ্যের সাথে কোন দৃশ্যের মিল নেই। একই গানে ২০০৪ এবং ১৯৬৯ সাল ঢুকিয়ে খিচুড়ি বানানো হয়েছে। কোনটা কি বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। মোদ্দা কথা, গাঁথুনি খুবই দুর্বল। পুরো ছবি জুড়েই এমন জোড়াতালি অসংখ্যবার করা হয়েছে। যার ফলে ঐ দৃশ্যগুলো তার ন্যায্যতা হারিয়েছে বলে মনে হয়েছে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয় লাভ দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে খুবই হালকাভাবে। একটা ছাদে দাঁড়িয়ে দু'চারটা সংলাপেই পুরো ঘটনা শেষ। অথচ তখন কিছু ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়েছে, যার অনেকটাই ১৯৭০ সালের না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ফুটেজ, বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক আড্ডার ফুটেজ নিয়ে ঐ দৃশ্যে যোগ করা হয়েছে, যা মোটেও প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি আমার কাছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চিত্র যেমনটা ভয়াবহ ছিল, এই ছবিতে তার ক্ষুদ্র অংশটুকুও পাওয়া যায়নি। শুধু মুখের কথা দিয়েই গল্প আকারে সব বলে দেয়ার চেষ্টা স্পষ্ট ছিল। একটি দৃশ্যে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলে স্লোগান দিয়ে ঘর পোড়ানো দেখানো হচ্ছে, আবার সেখানেই জয় বাংলা বলে স্লোগান দেয়া হচ্ছে। মূল কথাটা কি ছিল, তা বুঝা কষ্টকর ছিল সেখানে।

দুয়েকটা জায়গায় রাজাকারের কিছু কুকর্ম তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেটা। দেখানো হয়েছে শুধু আওয়ামী লীগ বলেই হত্যা এবং নির্যাতন করা হয়েছে। এমনকি মূল চরিত্রের মুখ থেকেও সেটাই বলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাড়াও যে মানুষ মরেছে, সেটা এই ছবি দেখলে কেউ জানতেই পারবে না।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম কুষ্টিয়া কিংবা মেহেরপুরে গিয়েছিলেন কিনা কিংবা কোন কারণে গিয়েছিলেন, সেটা আমার জানা নেই। তবে ইতিহাস বলে, তাজউদ্দীন আহমদ ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় ফরিদপুর-কুষ্টিয়া পথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে পৌঁছান। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি ভারতে পৌঁছান। সীমান্ত অতিক্রম করার বিষয়ে মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাঁদের সার্বিক সহায়তা করেন।

কিন্তু ছবিতে ঐ দৃশ্যে তাঁদের উপস্থিতি বোঝাতে যে ভিডিও ফুটেজ তুলে ধরা হয়েছে, সেটা মুজিবনগর সরকার গঠনের ফুটেজ বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে। তাছাড়া ছবিতে প্রতিটি দৃশ্য এতো এলোমেলো ছিল যে কোন দৃশ্য ঠিক কোন সময়টাকে তুলে ধরছে, সেটা বুঝতে পারা খুবই মুশকিল। গল্পের মূল সময়কাল সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে এটা নির্মাতার কৌশলগত দিক ছিল কিনা আমার জানা নেই।

এরপরেই দেখানো হয় ছবির মূল চরিত্র ভারতে গিয়ে পৌঁছান। আকাশবাণীতে যান। আকাশবাণীতে তাঁকে মূলত গান গাওয়ার জন্য নেয়া হয়। কিন্তু তিনি সেখানে আদৌ গান গেয়েছিলেন কিনা, সেটাও স্পষ্ট করা হয়নি। সেখান থেকে আবার কোন একটা জায়গাতে গিয়ে ভাষণও দেন তিনি। সেই ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন- 'বিশেষ করে আওয়ামীলীগের নেতাদেরই ধরে ধরে মারা হচ্ছে'! সেখানে বলা হয়, ২৫ মার্চ রাত থেকেই কুষ্টিয়াতে হামলা করে পাক আর্মি। কিন্তু কুষ্টিয়ার ইতিহাসে পাওয়া যায় ৩০ মার্চ ভোর রাতে পাক আর্মির আক্রমনের শিকার হয় কুষ্টিয়া। তাহলে কোন তথ্যটা সঠিক?

ঐ দৃশ্যে জাতীয় পতাকার অমর্যাদা করা হয়েছে বলেও মনে হয়েছে আমার কাছে। নায়ক ট্রাকে উঠবেন বলে পতাকা হাত থেকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং সেটা মাটিতে ঝুলে থাকে। বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের যে পতাকা ছিল, সেটার মাঝখানে দেশের মানচিত্র বসানো ছিল হলুদ রঙের। পুরো ছবিতেই সেই পতাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু ঠিক এই দৃশ্যেই আমাদের বর্তমান সময়ের পতাকা ব্যবহার করা হয়েছে, যার মধ্যে মানচিত্র নেই। এমন ভুলের যৌক্তিকতা ঠিক কি ছিল সেটা জানার আগ্রহ আছে আমার।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিটি আক্রমণ যেভাবে দেখানো হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে পাকিরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতো আর মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে হামলা করে হানাদারদের হত্যা করে আসতো। পাকি ক্যাম্পের যে বেহাল অবস্থা দেখানো হয়েছে, আদৌ কি সেরকম বেহাল অবস্থা ছিল? ট্রেনিং নিতে যাওয়া বাঙ্গালীদের যিনি ট্রেনিং দেন, তিনি সম্পূর্ণ ইংরেজীতে কথা বলেছেন। সেটাও ঠিক কতোটুকু যৌক্তিক ছিল? কৃষক থেকে উচ্চ শিক্ষিত পর্যায় পর্যন্ত সকলেই গিয়েছিলেন যুদ্ধে। সবই যদি ইংরেজীতে বলে দেয়া হতো, তাহলে স্বল্প শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত যোদ্ধারা সেটা কিভাবে বুঝতেন?

পুরো ছবিতে আলোর কাজ খুব বাজে লেগেছে। নির্দেশক আলো নিয়ে কি কাজ করলেন, সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। প্রয়োজনীয় অনেক জায়গা আছে সেখানে আলোই ছিল না। সাউন্ড এডিটিং খুবই বাজে ছিল। মূল চরিত্র আনন্দ সাঁই মারা যাবার খবর শুনে যখন দু'জন সাংবাদিক আশ্রমে যান, তখন তাদের সাথে ছিল কালো রঙের একটি মোটরসাইকেল। কিন্তু সাউন্ড দেয়া হয়ে ইয়ামাহা RX মোটরসাইকেলের! পাকি আর্মির গাড়ি বহরের শব্দ বোঝাতে যেসব সাউন্ড ব্যবহার করা হয়েছে, তার অনেকগুলোই মানসম্মত এবং সঠিক ছিল বলে মনে হয়নি। আর অভিনয়ের দিকটা নিয়ে না হয় নাই বললাম।

মূল চরিত্র যেহেতু বাউল অনুসারী ছিলেন, সেহেতু একাত্তর সালে বাউলদের উপর কিরকম অত্যাচার হয়েছিল এবং বর্তমান বাউলদের অবস্থা কেমন, সেসব বিষয় তুলে ধরলে অনেকটা যৌক্তিক লাগতো। কিন্তু শেষ দিকে দুয়েকটা সংলাপ ছাড়া বাউলদের নিয়ে কিছুই করা হয়নি ছবিতে।

ছবির শেষ দিকে সাংস্কৃতিক জোটের পিছনে যতটা সময় ব্যয় করা হয়েছে, তার খানিকটা যদি ঐ রাজাকারের নৃশংসতা, সমাজে তার ক্ষতিকারক দিক, মৌলবাদের বিস্তারে তার ভূমিকা প্রভৃতি তুলে ধরতে ব্যয় করা হতো, তাহলে সম্ভবত পূর্ণ একটা চিত্র পাওয়া যেত বর্তমান সময়ে রাজাকারদের ভূমিকার। কিন্তু আফসোস, কোন রকমে জোড়াতালি দিয়ে শেষ করা হয়েছে।

 

(লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত) 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত