আজ শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Advertise

নারীর সতীত্ব

শারমিন শামস্  

এই বঙ্গসমাজে সতীত্ব হইলো সেই কনসেপ্ট যা এদেশের পুরুষের চেয়ে নারীর কাছে বেশি জনপ্রিয়।

নারীর জন্য সতীত্ব এমন একটি অবলম্বন যা বেইচা নারী অনেকদূর যাইতে পারে, কইরা খাইতে পারে, আরামে ঠ্যাঙের উপ্রে ঠ্যাঙ তুলে জীবন কাটায়ে দিতে পারে এবং এই সতীত্বের আবরণে নিজেরে মুড়েই সেসব শ্রেণির কুকাম নির্বিচারে করে যেতে পারে। কারণ সতীত্ব হইলো সেই কনসেপ্ট যা নারীকে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।

সৎ শব্দের নারী ভার্সন সতীত্ব হইলেও সৎ ও সতীর অর্থ এক নহে। সৎ এর সততা আর্থিক, সামাজিক, পেশাগত। সতীর সততা যৌনতায়। অর্থাৎ নারীর যৌনতা ছাড়া আর কোন কাজ কাম নাই। মানে নারীর সৃষ্টি যৌনতার জন্য এবং যৌনতায় তার একমুখী থাকাটাই সতীত্ব এবং বহুমুখী হওয়াটা অসতীত্ব।

পুরুষের সতী অসতী বলে কিছু নাই। তবে পুরুষের চরিত্রহীনতা আছে। কিন্তু সেই একই চরিত্রহীনতা নারীর জন্যও আছে। অর্থাৎ নারীর জন্য চরিত্র ও সতীত্ব দুই-ই আছে।

বিবাহের আগে নারীকে ভার্জিনিটি ধরে রাখতে হয়। বিবাহের পরে একমুখীতা ধরে রাখতে হয়। বিবাহের আগে ভার্জিনিটি গেলে এবং বিবাহের পর অন্য পুরুষের সাথে শারীরিক সম্বন্ধ হইলে সেই নারী অসতী।

আর বিবাহের আগে পুরুষ যদি প্রেমিকার সাথে শারীরিক সম্পর্কে যায় তবে সে প্রেমিক পুরুষ, পতিতার সঙ্গে যায় তবে চরিত্রহীন এবং বিবাহের পর স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন নারীর কাছে গেলে বহুগামী। একইভাবে নারীর জন্যও চরিত্রহীন ও বহুগামী শব্দ বরাদ্দ আছে। তবে বাড়তি একটি শব্দ শুধু নারীর জন্যই আছে, তা হল- সতীত্ব। আর প্রেমিকের সাথে শারীরিক সম্পর্কে গেলে সেই নারী কখনোই প্রেমিকা নয়, সেই নারী খারাপ, বেশ্যা, কুলটা এবং রক্ষিতা।

সতী নারী এই সমাজে একটি দামী জিনিস। পুরুষ সতী নারী চায়। তার চেয়ে বেশি এই সমাজের নারীরা নিজে সতী হইতে চায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল, তারা আসলে কেউই সতী হইতে চায় না। তারা সতীর ইমেজটা চায়। বিবাহের পূর্বে প্রেমিকগমন, বিবাহের পর পরকীয়ার পরও একটি বিশাল অংশ নারী সতীত্বের ইমেজ শরীরে, আচরণে, কথায়, ব্যবহারে প্রকাশ করতে থাকে এবং নিজেকে সতী হিসেবে প্রমাণে ব্যস্ত থাকে।

সতীত্ব ও চরিত্র- এই দুইটি অলৌকিক হাস্যস্পদ শব্দ এই সমাজের মূর্খতার প্রামাণ্য দলিল। যৌনতাকে কেন্দ্র করে এই সমাজ সতীত্ব ও চরিত্রের কনসেপ্ট তৈয়ার ও বহন করে যাচ্ছে। এদেশে সততা না থাকলে তারে নিয়া মুখরোচক আলোচনা হয় না। কিন্তু তার একাধিক বা বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক থাকলে সেইটি টপ অব দ্য টাউন হয়।

যৌনতা শুনলেই বাঙালি মুখ লুকায় কিংবা সিনেমায় যৌনতার দৃশ্যে রিমোট হাতে চ্যানেল বদলায়। তারপর রাতে পর্ন সার্চ দেয়- ‘ভার্জিন টিনএজার’।

তারপর আবার তারাই পর্ন দেখনেওয়ালাদের চরিত্রহীন তকমা দেয়। ভাবখানা এমন, সে নিজেই যে গোপনে পর্ন দেখে এইটা তো আর কেউ জানতেসে নাহ!

পুরাকালে নারীর সতীত্ব পরীক্ষা দিতে হইতো। যে নারী পরীক্ষায় পাশ করত, তারে সকলে মাথায় তুলে নাচত। এই যুগে সতী পরীক্ষা নেয়া হয় না। তবে মেয়েদের একটা বিশাল অংশ সতীত্ব জাহির করতে ব্যস্ত থাকে। তারা সতীত্বের প্রমাণ হিসেবে পোশাকে, চলায়, বলায়, আচরণে, কাজে, সংসারে নানারকম কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। এক্ষেত্রে পোশাক একটি বড় নিয়ামত যা সতীত্বের ঝান্ডা তুলে ধরে রাখতে সাহায্য করে। সেই বিশেষ পোশাকের তলে থাকা শরীরটা কত পুরুষ গমন করলো এবং কীভাবে কখন গমণ করলো তা আর খতিয়ে কেউ দেখে না। পোশাক দেখেই সতীত্ব প্রমাণিত হয়ে যায়।

রাম সীতার সতীত্ব পরীক্ষা করেছিলেন। সীতা সেই পরীক্ষায় পাশ মার্ক পেয়েছিলেন। অথচ রাবন সীতারে ছোঁয় নাই। এমনকি সীতা তো ছিল রামের বউ, মানে তার ভার্জিনিটি নাই, তবু রাবনের কোন আপত্তি ছিল না। মানে রাবনই আসলে ভালবাসতো সীতারে। সীতার উচিত ছিল রাবনের কাছেই থাইকা যাওয়া। যে স্বামী আগুনে ঠেলে ফালায়ে দেয়, তার কাছে কেন যেতে হবে?

সতী নারীর চেহারা ধারণ করে যে নারীরা সমাজে অন্য নারীদের দিকে আঙ্গুল তোলে, তারা মূলত যৌনতা ছাড়া আর কোন কাজ জানে না, পারে না এবং এছাড়া তাদের আর কিছু করার আছে বলে মনে করে না।

নারীর জীবনে যৌনতা একটি সিদ্ধান্ত। নিজের সঙ্গীর সাথে প্রতারণা অবশ্যই একটি অপরাধ। যদি নারী তা করে অসতী উপাধি পায়, তবে পুরুষেরও অসতী উপাধি পেতে হবে যদি সে স্ত্রীর সাথে বা প্রেমিকার সাথে প্রতারণা করে। কিন্তু এই সমাজ বহুকাল ধরে অসতী শব্দটিকে সযত্নে পেলেপুষে রেখেছে। আর সতীত্বের ধারণাটি নারীর নাকের সামনে মূলোর মত ঝুলিয়ে রেখেছে। আর সতীত্বের লকেট গলায় পরে বহু নারী সসম্মানে এই সমাজে বিরাজ করে যাচ্ছে, কারণ নারীর যৌনতাসর্বস্ব সতীত্বই নারীকে বিচার করার একমাত্র মাধ্যম বলে মনে করে এই অশিক্ষিত অসভ্য বর্বর সমাজ আর এই সমাজের নারী ও পুরুষ উভয়ই। 

শারমিন শামস্, লেখক, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৪ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৫ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন