আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

সঙ্গীতা ইয়াসমিন  

পাহাড়ে একটি নয় বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণ শেষে তার নিষ্পাপ দেহটি টুকরো করে যোনিপথে কাটের গুড়িও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়ে ফেসবুক উত্তাল, উত্তপ্ত। পেজে-পেজে অনেক লেখা আসছে, নিউজফিডও ফেটে পড়ছে ক্ষোভে-অভিমানে। পত্রিকার কাটতি তো নিশ্চয়ই আরও সরগরম! টেলিভিশনের চ্যানেলে-চ্যানেলে আলোচনা-সমালোচনা, টক শো, নিউজ আপডেট, আরও কত হুতাশন জনমনে। কিন্তু আমিই কেনো জানি একটুও বিস্মিত হচ্ছি না, একটু বিচলিতও না।

আমি কেবল নিজেকেই কিছু প্রশ্ন করে যাচ্ছি; পাহাড়ে এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি? এর আগে এই বয়সী কিংবা এর থেকে আরও ছোটো কন্যাশিশু এমন পাষণ্ডদের হাতে নির্মমভাবে আত্মাহুতি দেয়নি? নাকি ইতিপূর্বে পাহাড়ে কিংবা আমার সোনার দেশে কোনো ধর্ষণই ঘটেনি? তবে, এতো প্রলাপ কীসের? কীসের এতো বেদনাভার? আমাদের এসব তো গা সওয়া হয়ে যাবার কথা। আমাদের অসীম ধৈর্যের বাঁধ তো এতো সহজে ভাঙার কথা নয়। আমরা এসবে অতিশয় সংবেদনশীল। আমরা নিশ্চয়ই প্রতিবাদে, অ্যাকশনে মুখর! আমরা প্রতিক্রিয়াও জানাই তৎক্ষণাৎ! বিক্ষোভে-ক্রোধে ফেটে পড়তে, শোক-সন্তাপে কেঁদে কেটে আকুল হতে আমাদের ঠিক ততক্ষণই সময় লাগে যতক্ষণ না আরেকটি বিভীষিকাময় ভয়ঙ্কর ঘটনা আমাদেরকে আরও বেশি আকস্মিকতার স্বাদ এনে দিতে পারে। এই তো আমরা! সুতরাং, আজকের শিশুটির জন্য আমাদের এ মায়াকান্নার বয়স এবং এই তাবৎ ঘটনার স্মৃতির গড় বয়স হিসেব করলে একটি টিস্যুর জীবনকালের চেয়ে কিছুমাত্র বেশি নয়।

ধর্ষণ কেবল আনন্দলাভ কিংবা যৌনোত্তেজনা নিবারণই নয়; ইহা দুর্বলের ওপর সবলের ক্ষমতার সদম্ভ প্রয়োগও বটে। শারীরিক শক্তিতে নারী যদি পুরুষের তুলনায় বলীয়ান হত, পৃথিবীর কোনো পুরুষই (ধর্ষক) বোধকরি এই আনন্দলাভে উদগ্রীব হত না। যখন সেই দুর্বলকে পরাস্ত করার মোক্ষম অস্ত্র ধর্ষণ, আর প্রতিপক্ষের নারীটি নারী নয়, শিশু এবং পাহাড়ি, তখন সে সমতলের থেকে দ্বিগুণ বেশি অপরাধ করেই নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। তারে বাঁচাবে কে? তার জীবন প্রদীপখানা এভাবেই নিভে যাবে হিসেব তো তাই বলে!

ও হ্যাঁ, এই ফাঁকে আরেকজনের কথাও মনে না করলেই নয়! নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই নিহত তরুণ, যাকে দুর্ঘটনার দায় এড়াতে হানিফ; থুক্কু রাজ-রাজাদের পরিবহনের কর্মকর্তারা ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছে। আচ্ছা বাপু! এই তো মাত্র কিছুদিন আগেই যুবরাজ একজনকে পিষে মারল! এবার সেই রাজন্যবর্গের আত্মীয় স্বজনেরাই যদি কাউকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েই থাকে তাতে এমন দোষেরই বা কী? এর জন্য এতো মায়াকান্না আপনাদের? এইতো পার্শ্বের দেশ ভারত সেখানে প্রতিদিন কতজন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় সে খবর রাখেন আপনারা? রাখেন না। আপনারা কেবল ছুতো খুঁজে বেড়ান। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে। আপনারাও সামনের দিকে এগোন।

একটা কথা খুব ভালোভাবে বোঝার দরকার আছে এখানে। দেশটা আসলে কার? আপনার-আমার? না কি রাজন্যবর্গের? সেই বুঝটা আগে ভালোভাবে বুঝে নিন। তারপরে আপনি কান্নাকাটি, চিল্লাফাল্লা যা খুশি তাই করবেন। বাংলাদেশ কি আদতেই প্রজাতন্ত্র(??!!) শুনুন, কাগজে-কিতাবে কী আছে ভুলে যান। এই দেশটা একদিন যারা বুকের রক্ত দিয়ে কিনেছিল ওরা ছিল বোকাসোকা। অকারণ, পৈতৃক পরানটা বেগোড়ে হারিয়েছিল। আজ যারা দেশটা গড়ছে, ওদেরকে গড়তে দিন। “আস্থা রাখুন উন্নয়নে- পৌছবে দেশ বিশ্বমানে”। উন্নয়নের বাই প্রোডাক্ট বলে একটা টার্ম আছে জানেন তো! আপনি যখন সাবান বানাবেন, গ্লিসারিন বাই প্রোডাক্ট হিসেবে এমনিই পাবেন। সেই গ্লিসারিনের ঝাঁঝে চোখ জ্বলবে ভেবে আপনি তো আর সাবান উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন না। দেবেন কি? তাই, এসব খুন-গুম, ধর্ষণ এক আধটু মেনে-গুনে নিতেই হবে আপনাদের।

এই হিরক রাজার (রানীর) রাজ্যে নিজের ঘরেই ঘুমিয়ে থেকে মানুষ লাশ হয়, লাশ হয় গাড়িচাপা পড়ে, কথা বলার অপরাধে ঢুকে যায় চৌদ্দ শিকে, দ্বিমত হলে দিয়ে দিতে হয় মস্তকখানা সোজা চাপাতির তলায়। আর এই রাজ্যে ধর্ষণ? সে তো মামুলি ব্যাপার; ছেলেপেলেরা যদি এক আধটু যৌনানন্দই না নিতে পারল তবে ওরাও যে যৌবনে উন্নীত হয়েছিল একদা সেকথা বুঝবে কী করে? এই আনন্দলাভের একমাত্র ক্রীড়নক যখন নারী, তখন ওদের তো মেয়েদেরকেই লক্ষ্যবস্তু করতে হবে নাকি? আর মেয়েদের আবার বয়স কী? গুণীজনেরা কয়, নারীর পুরো শরীরটাই যৌনান্দের টয় (খেলনা)! এসব নিয়েও আপনারা কথা বলবেন? আপনারা কি জানেন না খোদ আমেরিকাতেই প্রতি ১০৭ সেকেন্ডে একজন ধর্ষণের শিকার হয়? আপনারা আছেন শুধু সরকারের খুঁত খোঁজার তালে। আরে বাপু! এই মুহূর্তে দেশে একজন যোগ্য লোকের নাম বলুন তো যিনি হীরক রাজ্যের এই মসনদ অলংকৃত করতে পারেন। আছেন এমন কেউ? নেই তো! সে যেমন আপনিও জানেন, আমিও জানি, জানেন প্রজাসকলে।

সুতরাং, এসব অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বাগাড়ম্বর না করে দেশের কথা ভাবুন। দু'চারটা ধর্ষণ, কয়েকটা খুন, কয়েক হাজার কোটি টাকার লুটপাট, সোনার মোহর না কি তামা, কয়লা নাকি মাটি, সড়ক দুর্ঘটনায় কিংবা গাড়ির তলায় পিষে মরা নিয়ে মরা কান্না আর কাঁদবেন না। কান দেবেন না এসব গুজবে! আমাদের মহারাজের বদনামি করার জন্য এসব জামাতি-বামাতিদের ষড়যন্ত্র!

তার চেয়ে চলুন, উন্নয়নের কথা বলি! নিছক মৃত্যুর কথা ভুলে উড়াল সেতুর কথা বলি, স্যাটেলাইটের কথা বলি! আমরা ক্রিকেট জয়ের আনন্দে উল্লসিত হই, আরও আরও তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবনের বিনিময়ে আগামীর স্বপ্নের কথা বলি! অগণন ভবিষ্যতের রক্তে রাঙাই আমাদের রাজপথ! চলুন, দুর্বৃত্তায়ন আর দুঃশাসনের শিখরে চড়েই আমরা দেখে আসি উন্নয়নের মহাসড়ক! সকলে মিলেই রাজন্যবর্গের সকল কৃতকর্মের জন্য জয়োল্লাস করি!!

সঙ্গীতা ইয়াসমিন, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ