টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
দেবজ্যোতি দেবু | ০৪ আগস্ট, ২০১৮
দেশজুড়ে চলছে তুমুল আন্দোলন। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে। মাত্র চার দিনে তারা পুরো দেশকে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে রাস্তায় শৃঙ্খলা মেনে যান চলাচল করাতে হয়। মন্ত্রী, বিচারপতি, পুলিশ কেউই বাদ যাননি আইন লঙ্ঘনের শাস্তি থেকে। পুরো সিস্টেমকেই এই চারদিনে নাড়িয়ে দিয়েছে বাচ্চারা। তাদের অভিভাবকরাও তাদের সাথে আছেন। সাথে আছে পুরো দেশ। গুটিকয়েক কণ্ঠে বিরোধিতার সুর থাকলেও সেগুলো আমলে নিচ্ছে না কেউ। এ যেন এক নতুন সকাল!
এতো সুখকর দৃশ্যের মাঝেও যখন বিষাদের সুর বেজে উঠে, তখন মলিন মনে হয় সবকিছু। মনে হয় আমরা কি মানুষ!
বলছিলাম খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার নয় মাইল এলাকার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী কৃত্তিকা ত্রিপুরার কথা। কৃত্তিকাকে ধর্ষণ করেছে কিছু নরপশু। এতেই ক্ষান্ত হয়নি তারা। পশুগুলো এতটাই নারকীয় উল্লাসে মেতেছিল যে নয় বছরের ছোট্ট মেয়েটিকে ধর্ষণের পর কুপিয়ে, তার পায়ুপথে গাছের গুঁড়ি ঢুকিয়ে হত্যা করেছে। নৃশংস সত্যগুলো বাধ্য হয়েই বর্ণনা করে লিখতে হচ্ছে। লিখতে হচ্ছে কারণ, এতো নৃশংসতা দেখে ভাষাহীন হয়ে থাকলে অন্ধ সমাজকে আরও বেশি অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়া হবে। খুব সচেতন ভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হবে এই বর্বরতাকে। যা হয়তো সভ্যতার জাগরণকে বাধাগ্রস্ত করবে।
পার্বত্য এলাকায় ধর্ষণজনিত এমন নৃশংসতা শুধু যে কৃত্তিকার ক্ষেত্রে ঘটেছে তা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন 'আন্তর্জাতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন' এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, চলতি বছরে গত ছয় মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সীতাকুণ্ড ও রাউজানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীর ওপর আক্রমণ, ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মতো ঘটনা কমপক্ষে ১৫টি সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ২২ জানুয়ারি রাঙামাটির বিলাইছড়ির দুই মারমা তরুণীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন খাগড়াছড়ির মাটিরাঙায় এক ত্রিপুরা কিশোরীকে ধর্ষণ, ১৩ এপ্রিল বান্দরবানের আলীকদমে এক ত্রিপুরা কিশোরীকে গণধর্ষণ, ১৮ মে সীতাকুণ্ডে দুই ত্রিপুরা কিশোরীকে ধর্ষণের পরে হত্যা, ১৭ জুন বান্দরবানের লামায় নিজ বাড়িতে মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা, ২১ জুন খাগড়াছড়ির জেলা পরিষদ পার্কে এক কিশোরীকে গণধর্ষণ, ৫ জুলাই চট্টগ্রামের রাউজানে এক বৌদ্ধমন্দিরের অনাথ আশ্রমে এক মারমা কিশোরীকে হত্যা, ৯ ও ১৭ জুলাই কাউখালী ও মহালছড়িতে দুই কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। ২৮ জুলাই নৃশংসতার সর্বশেষ শিকার হয় কৃত্তিকা ত্রিপুরা।
কৃত্তিকার কথা মনে হলেই আমার চোখে ভেসে উঠে ছোট্ট একটা শিশুর চেহারা যে সবুজ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাসতে হাসতে ছুটে যাচ্ছে ফ্রক পরে। স্নিগ্ধ, নির্মল হাসিতে প্রকৃতিও যেন আনন্দে ভাসছে। ধানের ক্ষেতে দোল খেয়ে যাওয়া বাতাসও যেন তাকে কোলে নিয়ে নাচছে। চোখে ভেসে উঠে আমার বন্ধুর ছোট মেয়েটার কথা, যে আমাকে দেখলেই ছুটে আসে চকলেটের আশায়। কোলে উঠে পেতে চায় রাজ্য জয়ের আনন্দ। চোখে ভেসে উঠে নাম না জানা অসংখ্য শিশুর চেহারা, যারা বাবা মায়ের স্নেহে বেড়ে ওঠতে ওঠতে স্বপ্ন বুনতে থাকে সুন্দর আগামীর। অথচ কৃত্তিকার লাশের ছবিটা দেখা মাত্রই সব উচ্ছ্বাস চোখের পলকেই হারিয়ে যায় কোন এক অন্ধকার গহ্বরে। দৃশ্যমান বাস্তবতা জানিয়ে দেয়, কৃত্তিকা আর বেঁচে নেই। তাকে বাঁচতে দেয়া হয়নি।
অবাক করা বাস্তবতা হচ্ছে, এই নৃশংসতাগুলো আমাদের ভাবায় না। আমাদের মনে দাগ কাটে না। আমরা আন্দোলনের ডাক দেই না। কৃত্তিকাদের পক্ষে হুংকার ছেড়ে দ্রুত বিচারের দাবি জানাই না। কেন করিনা? জানি না। সত্যিই আমি জানি না। শুধু লজ্জা হয় যখন শুনি নির্যাতিত মানুষগুলোকে পাহাড়ি আদিবাসি ট্যাগ লাগিয়ে দিয়ে আমাদের থেকে আলাদা করে দেয়া হয় এবং নির্যাতনকারীদের পরিচয় পাওয়া যায় বাঙালি হিসেবে! এই পরিচয়টা যে কতটা লজ্জার, কতটা ঘৃণার, সেটা যদি সবাই বুঝতে পারতো!
অধিকার প্রাপ্তি এবং প্রয়োগের প্রশ্ন আসলেই আমরা কৌশলে আদিবাসী-বাঙালি নামে দুটি জাতিসত্তার পরিচয় তুলে ধরি। আমরা দেখাতে চেষ্টা করি, পাহাড়ের মানুষগুলো বাঙালি না। যেহেতু বাঙালি না সেহেতু বাংলাদেশে তাদের কোন নাগরিক অধিকার নেই। খুব কৌশলে তাদের অচ্ছুৎ বানিয়ে রাখার অপচেষ্টা করি আমরা। অধিকাংশ সময়েই আমরা তাতে সফল হই। এমন কূটকৌশলের সুযোগে অপরাধ করেও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় অপরাধীরা। আর পাহাড়ের গা ঘেঁষে লেপটে থাকে নির্যাতিত মানুষগুলোর আর্তনাদ।
আমরা মিয়ানমারের মানুষের জন্য মিছিল মিটিং করি। গাজা, ফিলিস্তিন, তুরস্কের মানুষের জন্য মানবতা দেখাই। পাশের দেশ ভারতেও ধর্ষণজনিত অপরাধ ঘটলে তার প্রতিবাদ করি। নিজের দেশে শিশুদের ওপর হওয়া নির্যাতনেরও প্রতিবাদ করি। কিন্তু পাহাড়ে হওয়া নির্যাতনগুলোর বেলায় চুপ করে যাই! কেন? পাহাড়ে হওয়া হত্যা, ধর্ষণ সহ যাবতীয় সকল নির্যাতনে সরকার চুপ, প্রশাসন চুপ, এমনকি প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াও চুপ! শত কষ্ট করেও ঘটনা জানার কিংবা জানলেও এরপরের ফলোআপ জানার কোন সুযোগ থাকেনা কোথাও। কেন? পাহাড়ের মানুষগুলো বাঙালি নয় বলে?
বাঙালি কিংবা পাহাড়ি হিসেবে না, মানুষ হিসেবে আমি কৃত্তিকার ওপর হওয়া নির্যাতনের বিচার দাবি করছি। নৃশংস নরপশুগুলোর একমাত্র পরিচয় তারা পশু, তারা অপরাধী। তাই ধর্ষণ এবং ধর্ষণ পরবর্তী নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অপরাধে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। সেই সাথে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা প্লিজ কৃত্তিকার পরিবারের পাশে দাঁড়ান। তারা বিচার পাচ্ছে না। বিচারের দাবিতে দাঁড়াতে পারছে না। আজ যদি এইসব নির্যাতনের বিচারের দাবি নিয়ে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্মের সামনে মানুষ পরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে পারবো তো? যে বাচ্চারা তাদের বন্ধু হত্যার বিচারের দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে, তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবো তো?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য