আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

সামনে সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন

রণেশ মৈত্র  

পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে কি না জানি না তবে বাংলাদেশ সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী সাংসদদের ভোটে ৫০ জন নারী নির্বাচিত হন সাংসদ হিসেবে। আসন ৫০ টি সংরক্ষিত। দফায় দফায় নারী আসন সংরক্ষিত রাখার মেয়াদ এবং সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদ, যদি সংসদ পুনরায় তা বৃদ্ধি না করে, তবে হয় তো শীঘ্রই তা শেষ হয়ে যাবে অর্থাৎ এই দফায় পরে আর সংরক্ষিত আসন থাকবে না মহিলাদের জন্য। তবে শেষতক জানলাম আরও ২০ বছর এই পদ্ধতি চালু থাকবে।

সত্য বটে বাংলাদেশে এক ধরণের নারী জাগরণ ঘটেছে বর্তমান নেতৃত্বের তিনটি মেয়াদ কালে। আজ মহিলারা শুধুমাত্র শিক্ষক নন, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, ডিসি, এস.পি. সহ সেনাবাহিনীর নানাপদে অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁদের যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন।
সে হিসেবে মোট জনগোষ্ঠী যেখানে কমপক্ষে ১৬ কোটি সেখানে নারীর সংখ্যা অবশ্যই আট কোটি কিছু কম বেশী হতে পারে। অথচ এই মহিলারাই হয়ে আছেন নিগৃহীত, অত্যাচারিত, অবহেলিত এবং মাত্র সেদিনও তাঁরা ছিলেন শিক্ষা দীক্ষায় অতিশয় পশ্চাৎপদ যেন গৃহকোণে বন্দী। তাই এই ধরণের যন্ত্রণা-বঞ্চনার বিরুদ্ধে নারী সমাজ তোলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তাঁরা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার দাবী করে তা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। বরেণ্য মহিলা বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে “বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ” একটি নির্দলীয় মহিলা সংগঠন হিসেবে। বেগম রোকেয়ার মহতী আদর্শে বলীয়ান হয়ে বেগম সুফিয়া কামাল যেমন মহিলা পরিষদ গড়ে তোলেন তেমনই আবার একই লক্ষ্য নিয়ে আরও অনেক নারী সংগঠন গড়ে ওঠে প্রায় সমান লক্ষ্য কার্যকর করার উদ্দেশ্যে।

সংরক্ষিত নারী আসন ঐ আন্দোলনের ফসল। তবে নারী আন্দোলনকে বাংলাদেশে যেতে হবে আরও বহুদূর কারণ এখনও পর্যন্ত নারী সমাজের বহুমুখী দাবী দাওয়ার আংশিক স্বীকৃতি মিলেছে সত্যি বেশীর ভাগ দাবীর স্বীকৃতি আজও অনর্জিত।
আট কোটি নারীর জন্য মাত্র ৫০ টি সংরক্ষিত আসন এবং তাতে অপ্রত্যক্ষ নির্বাচন বা Selection এর প্রচলিত ব্যবস্থা সাময়িক হতে পারে। তাই তাঁরা বহুদিন আগে থেকেই সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৫০ না করলেও আপাতত: ১০০ তে উন্নীত করে সরাসরি নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলনের দাবী তুলেছেন বেশ কয়েক বছর যাবত। কিন্তু মনের সবলতা ও নারীর ছুটোছুটির সক্ষমতার সীমা বিবেচনা করে ক্ষমতাসীনরা ‘সরাসরি নির্বাচনের সময় এখনও আসে নি” বলে মনে করে সংসদে ঐ সংখ্যা বৃদ্ধির ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাব আলোচনাতেও আসছে না।

আবার আর একটি মত হলো নারীর জন্য আসন সংরক্ষণ অযৌক্তিক। কারণ জনপ্রিয়তা থাকলে মহিলারা দিব্যি সাধারণ আসন থেকেই নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। যেমন শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া, বেগম মতিয়া চৌধুরী সহ আরও অনেকে। এ বিষয়টি সত্য হলেও কাজটি সহজ নয়। অত্যন্ত ভাল মানুষ হলেই তিনি যে জনপ্রিয় হবেনই তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

আসলে এমন তর্ক-বিতর্ক বাস্তবে কোন কাজে আসে না। সমাজে পশ্চাৎপদতা এখনও বিদ্যমান, নারীর অবস্থান এখনও মর্যাদাপূর্ণ নয় এবং নারীর প্রাপ্য ন্যায্য অধিকার সমূহ এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তাই নারী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা এতটুকুও কমে নি বরং বেড়েছে।

বাংলাদেশের সমাজে নারী সমাজকে নিয়ে দুটি পরস্পর বিরোধী ধারা ক্রিয়াশীল। আধুনিকতা ও পশ্চাৎপদতা। তাই পরস্পরের সংঘাত অনিবার্য। এখনও কেউ কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী শিক্ষার বিরোধিতা করে এবং তার দ্বারা সমাজে প্রতিক্রিয়াশীলতা বজায় রাখাতে অথবা পারলে তা বৃদ্ধি করতে চায়। নারী শিক্ষার অনুকূলে বহু পুরাতন প্রবাদ আজও সত্য “একটি শিক্ষিত পরিবার গড়তে একজন শিক্ষিত মায়ের বিকল্প নেই” বাংলাদেশে যেহেতু অধিকতর সংখ্যায় শিক্ষিত পরিবার গড়ে ওঠা প্রয়োজন তাই নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ অপরিহার্য । মেয়েরা ডাক্তার হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক, বৈজ্ঞানিক হোক ভাল শিক্ষক হোক, ভাল খেলোয়াড় হোক এগুলি হলো সময়ের দাবী নালী সমাজেরও সর্বজনীন দাবী। এই দাবীর বিরোধী মহল যে প্রকৃতই সমাজে পিছিয়ে দিতে চায় তা বলাই বাহুল্য এবং সে কারণে দুই পক্ষে অঘোষিত লড়াই বিদ্যমান।

পিতার, স্বামীর সম্পত্তির সমান অংশ উত্তরাধিকারের দাবীটি আজও অপূর্ণ। একই মা-বাবার সন্তান হয়ে (হিন্দু হলে) মেয়েরা কিছুই পাবে না কিন্তু ছেলেরা সমান অংশ তা পাবে। বিধবা স্ত্রী পাবেন ঐ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব (বিক্রয় বা হস্তান্তরের নয়) যতদিন ছেলেরা সাবালক না হবে।

মুসলিম মেয়েরা এ ব্যাপারে হিন্দুদের চেয়ে এগিয়ে আছেন কিছুটা কিন্তু সমান উত্তরাধিকার আজও অধরাই রয়ে গেছে। দুই মেয়ের সমান এক ছেলে এমনই বিধান প্রচলিত রয়েছে। ফলে এই উত্তরাধিকারের প্রশ্নেরও লড়াই অপরিহার্য।

এ লড়াই কারা পরিচালনা করবেন? মহিলা পরিষদ সহ অপরাপর নারী সংগঠন তো আন্দোলনে আছেনই সে আন্দোলন জাতীয় সংসদ পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন এবং এর মধ্যেই নিহিত নারী আসন সংরক্ষিত রাখা, সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে ১০০ তে উন্নীত করা এবং সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার নিশ্চয়তা। এজন্যে আরও প্রয়োজন (এবারের জন্য) ৫০ জন সংগ্রামী নারীর মনোনয়ন। তাদেরকে পাওয়া যাবে মহিলা পরিষদ সহ নানা নারী সংগঠনে, পুষ্পিতা গুপ্তা, খুশী কবির, তামান্নার মত মানবাধিকার কর্মীর মধ্যে এবং বিভিন্ন দলের সংগ্রামী, গণতান্ত্রিক, মানবিক এবং অসাম্প্রদায়িক মহিলাদের মধ্যে। সংকীর্ণতা যেন এই মহৎ কাজের উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে না দেয়।

বাংলাদেশে প্রয়োজন সহস্র বেগম রোকেয়ার, অসংখ্য বেগম সুফিয়া কামাল, হাল আমলে পুষ্পিতা গুপ্তা এবং আরও অনেক। সংসদ নিশ্চয়ই যোগ্য ও সংগ্রামী মহিলাদেরকে স্থান করে দেবে। যেন তাঁরা নির্বাচিত/মনোনীত হয়ে সংসদে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে পারেন এবং সম্মিলিত কণ্ঠে সোচ্চার হয়ে সংসদ অধিবেশনগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারেন। এ ব্যাপারে কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণকারী কোন আইন থাকলে তা বাতিল করে সংসদদের দায়িত্বশীলতার প্রতি অবস্থা জ্ঞাপন করা হোক। নির্ভীক মানবাধিকার কর্মী পুষ্পিতা গুপ্তা এবং আর যারা মনোনয়ন চেয়েছেন তাঁরা মনোনীত হবেন এমন বিশ্বাস মনে পোষণ করি।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ