প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ইমতিয়াজ মাহমুদ | ৩১ জানুয়ারী, ২০১৯
৩১ জানুয়ারি। কমরেড রশিমনি হাজং ১৯৪৬ সনের এই দিনে ব্রিটিশ সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দেন। ফেসবুকে দেখলাম সিপিবির নারী সেল আজকের দিনটি শহীদ কমরেড রশিমনি হাজংয়ের শহীদ হওয়ার দিন হিসাবে পালন করছে। ভালো লাগতো যদি দেখতাম সিপিবির বাইরেও যারা নারীবাদীরা আছেন বা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলেন, আন্দোলন করেন তারাও এই দিনটাতে রশিমনিকে নিয়ে দুই একটা কথা বলছেন।
কী করেছেন রশিমনি হাজং যে তাঁকে স্মরণ করতে হবে? তিনি টঙ্ক আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন। ছোটখাটো নেত্রী না। টঙ্ক আন্দোলনের মুল নেতৃত্বে তো ছিলেন কমরেড মনি সিংহ, তার পরেই গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন কমরেড রশিমনি। নাম থেকেই বুঝতে পারছেন যে তিনি একজন আদবাসি হাজং নারী। হাজং নারীরা কেন টঙ্ক আন্দোলনে অংশ নিতে আসলেন? কী ছিল সেই টঙ্ক আন্দোলন? এই কথাগুলি কি এখনকার ছেলেমেয়েরা জানেন? আমি খুবই সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি।
ব্রিটিশ ভারতের সময়ের কথা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে যে জমিদারি প্রথা চালু করা হয় এই দেশে, তখনও সেই ব্যবস্থা চলছে। জমিদাররা চাষিদেরকে জমি চাষ করতে দেওয়ার বিনিময়ে নানারকম অন্যায় অন্যায্য ও অমানবিক খাজনা আদায় করতো। ময়মনসিংহের উপরের দিকে প্রচলিত ছিল টঙ্ক প্রথা। প্রথাটা ছিল এইরকম যে মোটামুটি চার বিঘা জমি চাষ করলে টঙ্ক কৃষকে খাজনা হিসাবে দিতে হতো পনের মণ ধান। সেই সময়ে টাকার হিসাবে যে খাজনা ছিল তার তুলনায় এটা ছিল কয়েকগুণ বেশি।
২
টঙ্ক প্রথার মুল শিকার ছিল গারো হাজংরা। টঙ্ক উশুল করার পর দেখা যেতো যে কৃষকদের হাতে নিজেদের খোরাকির ধানটাও থাকতো না। ফলে টঙ্ক কৃষকরা একটা দুষ্ট চক্রের মধ্যেই থাকতো। টঙ্ক বাকি পড়তো, ধার দেনা হতো, জমিদাররা বকেয়া টঙ্ক আদায়ের জন্যে অত্যাচার করতো- চূড়ান্ত অমানবিক অবস্থা। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে সেই সময়ের কমিউনিস্টরা কৃষক সমিতির মাধ্যমে। নেতা ছিলেন জমিদারের পুত্র মনি সিংহ।
ওরা তখন ছয় দফা দাবি তুলেছিলেন। দাবিগুলির মধ্যে ছিল টঙ্ক প্রথা বিলোপ, বকেয়া টঙ্ক মওকুফ করে সাধারণ টাকার হিসাবে খাজনা চালু, জমিদারি প্রথা বিলোপ আর সেই সাথে ছিল সাম্রাজ্যবাদী কলোনিয়াল শাসনের অবসান। গারো হাজং তারা তো টঙ্কের মুল শিকার ছিল, ওদের সংগ্রামী অংশগ্রহণ ছিল এই আন্দোলনে।
১৯৪৬ সনে যেদিন রশিমনি হাজং শহীদ হন সেদিন কী হয়েছিল? ব্রিটিশ ভারতের ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বাহিনীকে নিয়োগ করা হয়েছিল কৃষকদের এই আন্দোলন দমন করার জন্যে। এই বাহিনীর একটা দল সেদিন সোমেস্বরী নদীর পারে এক গ্রাম থেকে কুমুদিনী হাজং নামে আরেক কিষাণিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছিল। ওই সময়ই ময়মনসিংহ থেকে আরেক কর্মসূচি থেকে ফিরছিলেন রশিমনি হাজংসহ দোষ বারোজনের একটা দল।
ওরা যখন খবর পেয়েছেন যে ওদের কমরেড কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সৈন্যরা, ওরা গেছেন প্রতিরোধ করতে- না, কুমুদিনীকে ধরে নিয়ে যেতে দেব না। সৈন্যরা ওদের দাবি মানবে কেন? সংঘর্ষ হয়েছে। হাজং নারীদের ওই ছোট দলটি দা নিয়ে আক্রমণ করেছে সৈন্যদের। রশিমনির দায়ের কোপে এক সৈন্যের কল্লা আলাদা হয়ে গেলে বাকি সৈন্যরা গুলি ছোড়ে আর সেখানেই শহীদ হন কমরেড রশিমনি।
৩
আমাদের মেয়েরা, তোমরা রশিমনির কথা বইপত্র খুঁজে পড়ে জানবে। কেননা এই কমরেডরা, রশিমনি বল বা কুমুদিনী বল বা অন্য যারা টঙ্ক আন্দোলনে ছিলেন, আর ইলা মিত্র ছিলেন নাচোলে তেভাগা আন্দোলনে, এইরকম অসংখ্য নারীরা, এরাই আমাদের প্রকৃত হিরো। এদের মধ্যেই পাবে তোমাদের নিজেদের নিজেদের পরিচয়। সেইসব নারীদের সময়ে ওদের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখ, দেখবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চেয়ে ওদের অবস্থান চেতনাগতভাবে অনেক অনেক উপরে।
ঠিকঠাকমতো লেখাপড়া করতে পারতো না যেসব নারীরা, কিভাবে ওরা এইরকম শাণিত চেতনা পেয়েছিলেন? লড়াইয়ের এই দুরন্ত সাহসী বা তাঁরা কোথায় পেয়েছিলেন? জানতে চেষ্টা কর। দেখবে, নিজের অধিকারের জন্যে লড়াইয়ের এই দুরন্ত সাহস আসে শ্রেণি চেতনা থেকে।
সোমেশ্বরি নদীর পারের সেই আদিবাসী নারীদের কথা স্মরণে রাখবে সবসময়।এরাই মানুষ। নিজেদেরকে ওরা নিতান্ত নেহায়েত ঊনমানুষ অর্থে নারী ভাবেননি। নারীদেরকে যারা তুচ্ছ করে মেয়েছেলে মেয়েমানুষ বলে হেলা করে, ওদের সামনে তুলে ধরবে এইসব কমরেডদের কথা। এই দেখ শালা, নারী। নিজেরা অনুপ্রেরণা নেবে এইসব কমরেডদের জীবন থেকে।
কমরেড রশিমনি হাজং শারীরিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন বটে, কিন্তু তোমাদের অন্তরে যেন বেঁচে থাকেন চিরদিন।
৪
লাল সেলাম কমরেড রশিমনি হাজং। আর আমাদের মেয়েরা, তোমাদেরকেও সেলাম- তোমরাই আমাদের আগামী দিনের রশিমনি হাজং আর কুমুদিনী হাজং। লড়বে। লড়াই ছাড়া জীবন নাই।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য