প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রণেশ মৈত্র | ২১ মে, ২০১৯
ফেনীর সোনাগাজির এক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা আমাদের মাতৃতুল্যা কিশোরী, ঐ মাদ্রাসারই ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পিশাচের মত ধর্ষণ করে। এ খবর দেশবাসী বেশ অনেক দিন হলে জেনেছেন।
আরও জেনেছেন, এ কালের নির্যাতিত মায়েদের বিপ্লবী প্রতীক নুসরাত ঐ পৈশাচিক নির্যাতনকে গোপন না করে থানায় গিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার লক্ষ্যে গিয়ে সেখানেও সহানুভূতির বদলে পুনরায় নির্যাতনের শিকার হন। তৎকালীন ও. সি. মেয়াজ্জেম হোসেন ঘটনা মেয়েটির অভিযোগ অস্বীকার করে মেয়েটিকে তাচ্ছিল্য ভরে উপেক্ষাই করেন নি, উল্টো নুসরাতের মাঝে তার কথোপকথন ভিডিও করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে নুসরাতকে “খারাপ মেয়ে” বলে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালায়। এ দুঃখ ধর্ষণ অপেক্ষা কোন অংশে কম মানবিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে নি সাহসিকা নুসরাতকে। কিন্তু শেষতক মামলা নিতেই হলো ঐ বেয়াদব দুর্নীতিবাজ ও. সি. কে-তবে নুসরাতকে ধর্ষণের অভিযোগেই শুধু নয়-তার গায়ে নির্মমভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার ফলে তাকে খুনের দায়েও। ঐ ও. সি. ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণেই অকালে প্রাণ দিতে হলো নিরপরাধ ও সংগ্রামী মেয়ে নুসরাত জাহান রাফিকে। ও.সি. তৎপর হলে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা যেতনা। সে জীবিত থাকতে পারতো।
অধ্যক্ষ নামক নরপিশাচ সিরাজুদ্দৌলা গ্রেপ্তার হয়ে জেলে থাকা কালে তার আপন জনেরা দেখা কতে গেলে তাদেরকে অধ্যক্ষ নির্দেশ দেন নুসরাতকে মেরে ফেলার এবং তার বিশ্বস্ত নেতারা এই হত্যালীলা নির্মমভাবে চালাল নুসরাতের গায়ে অগ্নিসংযোগ করে অবলীলাক্রমে মাদ্রাসারই ছাদে। ধর্ষণও হয়েছিল মাদ্রাসার অভ্যন্তরেই।
ঘটনার খবর বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পড়ে দেশে বিদেশে। সকল সংবাদ মাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত খুঁটিনাটি সহ এ সংক্রান্ত সকল তথ্য প্রচার করেই চলেছে এবং প্রমাণ দিচ্ছে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের গণমাধ্যম সমূহের সুদৃঢ় অবস্থান।
সারা দেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষ এ যাবতকাল এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিবাদে ও দায়ী সকলের যথোপযুক্ত কঠোর শাস্তির দাবী জানিয়ে আসছেন। তদের দাবী ত্বরান্বিত কিন্তু সুষ্ঠু বিচার নিরপেক্ষ তদন্তের ভিত্তিতে।
পিশাচ সিরাজউদ্দৌলা একজন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। তিনি নিয়মিত নমাজ-রোজা সবই করেন নিঃসন্দেহে এবং একই সাথে তাঁর অসামাজিক কাজগুলিও চালিয়ে যান নির্বিবাদে। সিরাজউদ্দৌলাকে বাহবা দিতেই হয় কারণ তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে একটি অপরাধ জগত বা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন এবং নির্বিবাদে ঐ এলাকায় আওয়ামী লীগকেও তাঁর পকেটে পুরতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তাদেরকেও সহযোগী হিসেবে পেতে।
বিস্ময়কর এবং লজ্জাজনক হলেও সত্য কথাটি হলো যে তিনি এতটাই প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন ঐ এলাকায় যে তার গ্রেপ্তারের সাথে সাথেই তাঁর মুক্তির দাবীতে নারী-পুরুষের মিলিত উদ্যোগে ও অংশগ্রহণে মানববন্ধন সমাবেশ প্রভৃতিও ঘটেছে। কোন ধর্ষক কোন খুনির সপক্ষে এমন করে রাস্তায় দাঁড়াতে কাউকে কদাপি দেখি নি আজ এই ৮৭ বছর বয়স কাল পর্যন্ত। এই প্রথম তাও দেখলাম চোখ দিয়ে।
কোন কোন পুলিশ অফিসারও যে ধর্ষিতার মামলা নিতে অমন কেলেঙ্কারি করতে পারেন তাও এমন নগ্নভাবে কদাপি চোখে পড়ে নি। সংশ্লিষ্ট থানার তৎকালীন ও.সি. মোয়াজ্জেম হোসেন শুধু নুসরাত জাহান রাফিকে অপমান অপদস্থই করেন নি কুৎসিত কথাবার্তা বলে সেই কথোপকথন আবার ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে শুধুমাত্র নুসরাতকেই অবমাননা করেন নি, তিনি সমগ্র নারী জাতিকে অবমাননা করতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নুসরাতের ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন।
এ যাবতকাল পর্যন্ত পুলিশি তদন্ত? বেশ ভালভাবেই চলছে মহামান্য হাইকোর্টও তেমন অভিমত প্রকাশ করে এই পর্যায়ে তদন্ত হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
কিন্তু আপাতদৃষ্টে যা দেখছি এবং উপলব্ধি করছি তাতে পুলিশ কতটা দায়ী তা যেন যথাযথ নির্ণীত হচ্ছে না। ও.সি. মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে যে মোকদ্দমা দায়েরের কথা প্রচারিত হয়েছে তা কি যথেষ্ট? তিনি যে অবমাননা করলেন নুসরাতকে তারা জন্যে মানহানি, যে না আজও তাও দুর্বোধ্য। তাদের Complicity তো স্পষ্ট।
অপরপক্ষে প্রায় অনুরূপ অপরাধ ওখানকার পুলিশ সুপারও যে করেছেন তাও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। সুতরাং তার বিরুদ্ধেও মোকদ্দমা দায়ের না করাটা হবে আইনকে এড়িয়ে যাওয়া এবং পক্ষপাতমূলক ঘটনা। সুতরাং তদন্ত যখন আজও শেষ হয় নি।
তাই চূড়ান্ত করে কিছু বলা না গেলেও কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার ( এবং আরও কেউ থাকলে) সংশ্লিষ্টতা কর্তব্যে অবহেলা, মূল ঘটনা আড়াল করে অপরাধী। অপরাধীদেরকে বিচার প্রক্রিয়ার আড়াল করার চেষ্টা প্রভৃতির মাধ্যমে এই ভয়াবহ অপরাধগুলির সহযোগী ভূমিকা পালনের বিষয়গুলি জনগণের সামনে তুলে ধরা। পুলিশ বলে সহজে যেন কেউ রেহাই না পান। কিন্তু সে আশংকা কি আদৌ নিবৃত্ত হচ্ছে?
এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ঐ কমিশনের পক্ষ থেকে ডি.আই.জি. পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বদল বলে ঘটনাস্থলে গিয়ে, যথোপযুক্ত তদন্ত করে ঢাকায় ফিরে এসে কর্তৃপক্ষের কাছে যে রিপোর্ট প্রদান করেন তাতে দেখা যায় যে শুধুমাত্র ও.সি. মোয়াজ্জেম নয়, ফেনী জেলার এস.পি’ও অপরাধীদেরকে বাঁচানোর কসরতে সামিল হয়েছিলেন এবং ঐ একই কাজে দিব্যি লিপ্ত হয়েছিলেন আরও দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা।
অত:পর বিভাগীয় পর্যায়ে ঐ চারজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত নমনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিস্ময় সৃষ্টি করা হয়েছে। ঐ মামলার আসামী হিসেবে তাঁদের কাউকে আজও চার্জশিটে আনা হয় নি এমন কি গ্রেপ্তারও করা হয় নি। দিন কয়েকের জন্য অস্থায়ীভাবে পদচ্যুত দেখিয়ে সোনাগাজি থানা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় অত:পর দিন দশেক যেতে না যেতেই ঐ মোয়াজ্জেমকে রংপুরে বদলি করা হয়। সেখানে যোগ দিলে রংপুরের মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে প্রতিবাদে মুখরর হয়ে ওঠেন।
আবার এসপি’কে ঐ পদ থেকে Close করে (অদ্ভুতই বটে) পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বহাল তবিয়তে তিনি সেখানে অবস্থান করছেন? অপর দু’জন অধ:স্তন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা আজও অজানা তবে কেউ যে আজও চার্জশিটভূক্ত হন নি তা দিব্যি পরিস্কার। কিছুদিনের বিরতি দিয়ে হয়তো বা এসপি’কে ডি.আইজি. পদে উন্নীত করে সম্মানিত করা হবে। সব সম্ভবের দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে পুলিশের ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ভিন্ন এবং বৈষম্য মূলক। এমন কার্যকলাপ আমাদের দেশের আইন তো বটেই, সংবিধান পরিপন্থীও বটে। এমন ব্যবস্থা কোনক্রমে মেনে নেওয়া যায় না অপরাধী যারাই হবে তারা সাধারণ মানুষ নন, সরকারী কর্মকর্তা বা সরকার দলীয় হোন, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান অপরাধী এবং সবার বিরুদ্ধেই সমান ব্যবস্থা অবশ্যই নতে হবে। এবং তা অবিলম্বেই।
অপরাধী হয়েও ঐ পুলিশ কর্মকর্তারা বাইরে থাকলে কর্মরত থাকলে নানা জানা-অজানা পদ্ধতিতে, নানা কৌশল-অপকৌশল প্রয়োগ করে তাঁরা নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণের অবাধ সুযোগ পাবেন। তাঁদের প্রিয় মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে বাঁচানোর চেষ্টায় সাক্ষীদেরকে প্রভাবিত করতে পারেন।
তাই যেভাবেই হোক, অবিলম্বে ঐ চার পুলিশ কর্মকর্তাকে চার্জশীট ভুক্ত করা হোক, তাদের সকলকে গ্রেফতার করে কারাগারে নেওয়া হোক সকলের বিচার করে আইন মোতাকে কঠোর শাস্তি বিধান করা হোক। আবারও বলি, নুসরাত ধর্ষণ ও তাকে অগ্নিদগ্ধ করে যে নিষ্ঠার হত্যালীলা চালানো হয় তার পেছনে ঐ চার পুলিশ কর্মকর্তার Complicity বা যোগসাজশ অত্যন্ত স্পষ্ট। সুতরাং আইনে তাঁরা সমপরিমাণেই অপরাধী এবং একই ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের পথে বাধ্যতামূলক।
অন্যান্য অপরাধীসহ পুলিশ কর্মকর্তাদেরও কঠোর শাস্তি হলে একটি আকাঙ্ক্ষিত বার্তা পৌঁছে যাবে গোটা পুলিশ বিভাগই শুধুমাত্র নয় সকল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছেও যে অপরাধ করলে পুলিশ বা সরকারী কর্মকর্তা বলে রেহাই পাওয়া যাবে না।
এতে নুসরাতের পরিবারের লোকেরা বা তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ জনেরাই শুধুমাত্র নয় সমগ্র দেশবাসী একটি আস্থা ফিরে পাবেন যে সকল অপরাধীই শাস্তি পেল।
নুসরাত ধর্ষণ ও হত্যার পরে এবং আগেও দেশ জুড়ে অজস্র নারী ধর্ষণ অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের পর হত্যা প্রভৃতি ব্যাপকভাবে ঘটতে দেখা যাচ্ছে যা অত্যন্ত আতঙ্কজনক এবং আমাদের রুচি সংস্কৃতি সভ্যতা বিরোধী।
লক্ষণীয় যে এই জঘন্য অপরাধ ঘটাতে মাদ্রাসা শিক্ষকের আকাঙ্ক্ষী হলেও, অপরাপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তা ছড়িয়ে পড়েছে যেন ধর্ষণ একটি উৎসব বা মহোৎসব। সর্ব প্রযত্নে এগুলিকে রুখতে হবে। মূল দায়িত্ব সরকার, সরকারীদল এবং সমাজকেও পালন করতে হবে দ্বিধাহীনভাবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য