আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

পিরিয়ডকালীন সুব্যবস্থাপনা হতে পারে নারী দিবসের প্রতিপাদ্য

ড. শামীম আহমেদ  

আমার জনস্বাস্থ্যের মাঠ পর্যায়ের কাজের একটা বড় অংশই ছিল প্রজনন সক্ষম নারীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। কেউ এটাকে বলেন মাসিক, কেউ বলেন ঋতুচক্র, বেশিরভাগ বলেন পিরিয়ড। আমিও বাকি লেখাতে এটিকে পিরিয়ড বলেই সম্বোধন করব। যে ভাষায় মানুষ অভ্যস্ত সেটি ব্যবহার না করার কোন কারণ দেখি না। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, সিলেটের চা বাগান, টাঙ্গাইলের পতিতালয়, ঢাকার বস্তি, হাওর অঞ্চল যেখানেই গিয়েছি, পিরিয়ড বললেই সবাই এক বাক্যে বোঝেন কী বোঝাতে চাচ্ছি। গবেষণাভেদে বাংলাদেশে ১০ বছর থেকে ৪৯ বছর পর্যন্ত ৪ কোটি থেকে সাড়ে ৫ কোটি নারীর প্রতিমাসে ৫-৭ দিন পিরিয়ড থাকে। এই পিরিয়ড নিয়েই আজকে কিছু কথা বলতে চাই।

এটি কোন সুখানুভূতি নয়: প্রতিমাসে পিরিয়ড হয় বলে এটিকে গুরুত্ব দেয়া যাবে না ব্যাপারটি এমন নয়। অনেক নারীই এ সময় তীব্র ব্যথার মধ্যে দিয়ে যান। প্রতি মাসে ৫-৭ দিন ধরে একটা মানুষের রক্তপাত হয়, ব্যাপারটা সহজ নয়। আমি আমার পরিবারের সদস্যদের ছোটকালে দেখেছি এই সময় ব্যথায় শুয়ে থাকতে, ব্যথার জন্য বুটাপেন বা নো-স্পা খেতে। পেটে গরম পানির সেঁক দিতে।

দৈনন্দিন কাজে প্রতিবন্ধকতা: পিরিয়ডের জন্য কখনও কখনও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাউকে কাউকে মাঝে মাঝে অফিস কামাই দিতে হয়। কাউকে কাউকে চিকিৎসকের পরামর্শও নিতে হয়।

অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা: গড়ে প্রতিটি নারীর পিরিয়ড ব্যবস্থাপনার জন্য মাথাপিছু ন্যূনতম ৫০ টাকা দরকার। স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা, সেটা ব্যবহারের পর সুনির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা খুব জরুরি। বাংলাদেশে অনেক পরিবারেরই প্রতিমাসে স্যানিটারি ন্যাপকিনের জন্য মাথাপিছু ৫০ টাকা ব্যয় করার সক্ষমতা নাই। এটি একটি চ্যালেঞ্জ।

মানসিক প্রতিবন্ধকতা: অনেক পরিবারের পুরুষেরা মাসে সিগারেটের পিছনে দুই-তিন হাজার টাকা খরচ করলেও স্যানিটারি ন্যাপকিনের জন্য ৫০ টাকা খরচ করতে চান না। আবার অনেক নারীরও অর্থনৈতিক সক্ষমতা থাকলেও নিজের বা পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য এই জরুরি খরচটা করতে চান না। আমাদের ট্র্যাডিশনাল সমাজ ব্যবস্থায় পিরিয়ডের জন্য, স্যানিটারি ন্যাপকিনের জন্য খরচ করা টাকাকে অনেক ক্ষেত্রেই বাজে খরচ হিসেবে দেখা হয়। ফলশ্রুতিতে এখনও কোটি কোটি পরিবারে অর্থনৈতিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতার জন্য পিরিয়ডের সময় কাপড় ব্যবহার করা হয়। যারা অর্থাভাবে কাপড়ের ব্যবহার করেন, তাদের অবস্থানকে আমি সম্মান জানাই, কিন্তু যারা চিন্তার দীনতার জন্য এটি করেন, তাদের উচিৎ পরিবারের নারী সদস্যদের পিরিয়ডকালীন সুস্থ স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা।

সামাজিক ট্যাবু বা পিছনমুখী চিন্তা: সমাজে পিরিয়ড নিয়ে নানা ট্যাবু আছে। এটি যে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সেটি বেশিরভাগের আচরণ দেখলেই বোঝা যায় না। অনেক জায়গায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের কোথায় ফেলা হলো কিংবা যারা কাপড় ব্যবহার করেন তাদের কাপড় কোথায় শুকানো হলো সেটি নিয়ে প্রতিবেশীরা বিরূপ আচরণ করেন। স্কুল-কলেজে মেয়েদের নানা উস্কানিমূলক আচরণের শিকার হতে হয়। অনেকেই ভেজা কাপড় অন্য আরেকটি কাপড়ে নিচে ঢেকে শুকানর চেষ্টা করেন যার বারংবার ব্যবহারে অনেক নারীই জটিল রোগে ভুগে থাকেন।

অনুপযোগী টয়লেট একটি মহাসমস্যা: আমাদের সব স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েই টয়লেট একটি বড় সমস্যা। অনেক জায়গায় মেয়েদের আলাদা টয়লেট নেই। যেখানে আলাদা টয়লেট আছে, সেখানে হয় পানি নেই, সাবান নেই, গোপনীয়তা নেই অথবা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে ফেলবার জন্য ভালো ব্যবস্থা নেই। ফলশ্রুতিতে অনেকেই পিরিয়ডের সময় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। আমি আমার অনেক নারী সহকর্মীকে দেখেছি তারা যখন দীর্ঘ সময়ের জন্য মাঠে বা ঢাকার বাইরে যান তখন সকাল থেকেই পানি খান না, যাতে রাতের আগে তাদের টয়লেটে যেতে না হয়। এই সময়ে তাদের অনেককে টয়লেট চেপে রাখতে হয়, যা অনেকের জন্যই নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পিরিয়ডের সময়ে এই সব বাধার কারণে অনেকে অফিসের বাইরে মিটিং এ বা মাঠেও যেতে চান না।

এই নানা ধরণের সমস্যা মোকাবেলায় তবে কী করা যায়? ২০২১ সালে এসেও আমাদের এখনও পিরিয়ডের ব্যবস্থাপনা মান্ধাতা আমলের এটি হতাশাব্যঞ্জক বটে। আমি আমার সীমিত ধারণা থেকে কয়েকটি বিষয়কে সমাধানের পথ হিসেবে দেখতে চাই।

অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা: বাংলাদেশে সড়ে ৫ কোটি নারীর মধ্যে অন্তত ১ কোটি নারী ও তাদের পরিবারের নিজেদের মাসিক ব্যবস্থাপনার অর্থনৈতিক ভার সামলাবার সক্ষমতা আছে বলে আমি ধারণা করি। বাকি সাড়ে ৪ কোটি নারীর জন্য মাথাপিছু ৫০ টাকা ব্যয় হলে মাসিক খরচ ২০০ কোটি টাকা। এই ২০০ কোটি টাকা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সরকারের পক্ষে পুরোপুরি দিয়ে দেয়া সম্ভব কিনা আমি জানি না, তবে সরকার চাইলে নিশ্চয় কিছু ব্যবস্থা করতে পারে:

ক) বিনা পয়সায় বা স্বল্প খরচে স্যানিটারি ন্যাপকিন: স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, পাবলিক টয়লেটে, সরকারি-বেসরকারি অফিসে, গার্মেন্টস কারখানাসহ নানা জায়গা যেখানে বেশিরভাগ প্রজনন সক্ষম নারী থাকেন বা কাজ করেন, সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিনা পয়সায় বা সুলভে বিক্রির ব্যবস্থা করা। এই ক্ষেত্রে সরকার কিছু ভর্তুকি প্রদান করতে পারে, এবং সাথে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও ভর্তুকি দেবার জন্য নির্দেশনা দিতে পারে। এছাড়াও স্বাস্থ্য, বেতন-ভাতা ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধার মধ্যে স্যানিটার ন্যাপকিন কেনার জন্য বিশেষ ভাতা অন্তর্ভুক্ত করে দিতে পারে।

খ) স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার: বাংলাদেশে উৎপন্ন যেকোনো স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদন, প্যাকেজ, বিতরণ, বিপণন সবক্ষেত্রে যেকোনো ট্যাক্স-ভ্যাট, ভর্তুকি প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা করতে পারে। এতে করে স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম কমে আসবে। যারা কিনতে পারেন না, হয়ত তারাও কিনতে পারবেন।

টয়লেটের উন্নয়ন: স্কুল কলেজসহ যেকোনো পাবলিক টয়লেটে নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে কিনা এবং তা পিরিয়ডকালীন সময়ে ব্যবহার উপযোগী কিনা তা নিয়মিত মনিটর করা। এছাড়াও সকল অফিসে নারীবান্ধব টয়লেটের ব্যবস্থা করার নির্দেশ প্রদান এবং তা নিশ্চিতকরণ। বেশী বেশী পাবলিক টয়লেটের স্থাপন করা এবং সেসব জায়গায় পানি, সাবান ও স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশে বিদ্যমান ল্যাট্রিনের বেশীরভাগই মানের দিক দিয়ে অত্যন্ত নিম্নমানের, সেগুলার মানোন্নয়ন করা।

মানসিক ও সামাজিক ভাবনার উন্নয়ন: পিরিয়ডের সময় নারীদের যে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয় তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া। অল্প বয়স থেকেই সামাজিক শিক্ষায় এই বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যাতে নারী, পুরুষসহ সকল জেন্ডারের সকল বয়সী মানুষ এই বিষয়টিকে জরুরি জনস্বাস্থ্যের বিষয় বলে মনে করে এবং এই সময়টিতে নারীদের প্রতি কোন ধরণের বিরূপ আচরণ না করে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পৃথিবীর সকল নারী ও যারা নিজেদের ‘নারী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন, তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা ও সালাম জানাই।

ড. শামীম আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক-বিজ্ঞান গবেষক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ