আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

হিজাব ও ইরানের সাম্প্রতিক আন্দোলন

এনামুল হক এনাম  

সাম্প্রতিক সময়ে উপমহাদেশ থেকে আরব বিশ্ব সর্বত্র নারীরা কি পরবে আর কি পরবে না তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে। এসব আলোচনা পাড়ার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ হয়ে সংসদ ভবন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এক গোষ্ঠী নারী স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে হিজাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তো আরেক গোষ্ঠী সামাজিক অবক্ষয়ের অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার হচ্ছেন হিজাবের পক্ষে। আরেকটি পক্ষ সুযোগ বুঝে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অগোচরে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে যাচ্ছে। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে আমরা পোশাক সম্পর্কে এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে অসংখ্য অভিযোগ বা ন্যায্যতা বা অধিকার নিয়ে দাবি শুনেছি সবই নারী পোশাক সংক্রান্ত, পুরুষদের পোশাক নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন অভিযোগ বা দাবি নিয়ে কেউ সামনে আসেনি বা কোন ঘটনা ঘটেনি।

গত মাসে ইরানে ঘটে যাওয়া হিজাব নিয়ে হত্যা, আন্দোলন এবং পরবর্তী প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করতে চেষ্টা করবো। শুরুতেই আমরা চলে যাই ঘটনার মূলে। কী ঘটেছিল সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ?

কিছুদিন আগের কথা। সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে মাশা আমিনী এবং তার পরিবার ইরানের কুর্দিস্তান এলাকা থেকে রাজধানী তেহরানের দিকে আসছিলেন তাদের আত্মীয়স্বজনের সাথে সাক্ষাতের জন্য। সন্ধ্যার দিকে তেহরান সংলগ্ন এলাকায় তাদের গাড়ি থামায় পুলিশ। এ কোন সাধারণ পুলিশ ছিল না। তারা ইরানের নৈতিক পুলিশ বাহিনী বা Guidance Patrol or morality police. এই পুলিশ সাধারণ পুলিশের মত অপরাধ নিয়ে কাজ করে না। তারা ধর্মীয় নৈতিকতা রক্ষায় নিয়োজিত থাকে, বিশেষ করে নারী পোশাক এবং আচরণবিধি তারা নজরে আনে এবং যে কোন সাধারণ জনগণকে আটকানোর ক্ষমতা রাখে।

এখানে উল্লেখ্য যে ইরানে বাধ্যতামূলক ড্রেস-কোড আছে নারীদের জন্য, যে আইনে নারীদের অবশ্যই মাথায় হিজাব পরতে হবে সুনির্দিষ্ট নিয়মে যাতে মাথার চুল প্রকাশ্যে দেখা না যায়। পাবলিক প্লেসে কোন নারী যদি সঠিক ভাবে হিজাব পরিধান না করে তাহলে এই নৈতিক বা মোরালিটি পুলিশ সেই নারীকে আটক এবং বাধ্য করতে পারবে হিজাব পরার জন্য, প্রয়োজনে তাকে রিহেবিলিটেশন সেন্টারেও তারা প্রেরণ করতে পারবে। আপনি ধরে নিতেই পারেন, এই মোরালিটি পুলিশের কাজই হল নারীরা সঠিক ভাবে পোশাক পরেছে কি না তা দেখার। অনেকের কাছে বিষয়টি স্কুল পড়ুয়া শিশুদের সাথে আচরণের সামিল মনে হতে পারে। আদতে বিষয়টি ইরানে তেমনই এবং অতি স্বাভাবিক এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে “জবরদস্তিকৃত”। আরও পরিষ্কার ভাবে বললে, সরকারি মানদণ্ড অনুযায়ী হিজাববিধি মেনে না চলার জন্য জনসাধারণের মধ্যে হিজাব বিধিমালা বাস্তবায়নের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আইন প্রয়োগকারী কমান্ডের একটি সহ-স্কোয়াড গাইডেন্স পেট্রোল বা মোরাল পুলিশ।

মূল ঘটনায় ফিরে আসি। মাশার পরিবারের সূত্র মতে, মাশাকে সঠিক ভাবে হিজাব না পরার জন্য গাড়ির ভেতর থেকে টেনেহিচড়ে বের করে নিয়ে আসা হয়। একটা বিষয় এখানে লক্ষণীয় যে, মাশা আমিনী তার পরিবারের সাথে গাড়ির ভেতরে ছিল, কোন পাবলিক প্লেসে অশ্লীলভাবে ঘুরছিল না।

মাশাকে টেনে বের করে পুলিশের গাড়িতে বসানো হয় এবং বলা হয় তাকে পুলিশ স্টেশন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ১ ঘণ্টার মোরাল লেসন বা নৈতিক শিক্ষা দেয়ার জন্য। মাশার ভাই কিয়ারাস অনেক চেষ্টা করে পুলিশকে বুঝানোর এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে বিষয়টি সেখানেই শেষ করার। কিন্তু পুলিশ কারও কোন অনুরোধ গ্রাহ্য না করে মাশা আমিনীকে থানায় নিয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ মাশার ভাই কিয়ারাসও সেখানে উপস্থিত হয়। থানায় মাশাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইন্টারোগেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। আমিনীর ভাইয়ের সূত্রমতে জিজ্ঞাসাবাদের কক্ষ থেকে তা বোনের চিৎকার এবং কান্না শব্দ তিনি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐ থানার সামনে একটি পুলিশ অ্যাম্বুলেন্স আসে এবং লুকিয়ে মাশা আমিনীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের ভাষ্যমতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমিনীর হৃদরোগের লক্ষণ দেয় এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়া হয়। এখানে আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেই, আমিনী একজন ২২ বছরের সুস্থ, শক্ত সামর্থ্য নারী, যার পূর্বে কোন দিন হৃদরোগ বা অন্য কোন অসুস্থতা ছিল না। হাসপাতাল থেকে তাদের পরিবারকে জানানো হয় আমিনী কোমায় আছেন এবং চিকিৎসা চলছে। দুইদিন পর তেহরান পুলিশ অফিসিয়াল বক্তব্যে জানায়, মাশা আমিনীকে অ্যারেস্ট করার পর থানায় আনা হলে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। বক্তব্য প্রকাশের পরের দিন, অর্থাৎ ১৭ সেপ্টেম্বর আমিনীর মৃত্যু হয়।

২২ বছরের মাশা আমিনীর মৃত্যু ঘটনায় পুরো মিডিয়াপাড়ায় তোলপাড় শুরু হয়, সোশাল মিডিয়া থেকে ইরানের রাজপথ সর্বত্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জনগণ। মাশা আমিনীর পরিবার এবং থানায় উপস্থিত সকল প্রত্যক্ষদর্শী সরাসরি পুলিশকে দায়ী করে এই মৃত্যুর জন্য, প্রত্যেকটি সূত্রই অভিযোগ করে মাশাকে প্রচন্ডভাবে মারপিট করা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে, যার দরুন তার মৃত্যু হয়েছে। অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী এই ধরণের সকল অভিযোগকে বাতিল করে সরাসরি বলেন, আমিনীর আগে থেকে হৃদরোগ ছিল এবং থানায় আনার পর হৃদরোগের কারণেই আমিনীর মৃত্যু হয়েছে। মোরাল পুলিশের কাছে এমন কোন অস্ত্র নেই যে যার আঘাতে আমিনীর মৃত্যু হতে পারে।

এখানেই আসে ঘটনার মূল টুইস্ট, একটি ইথিক্যাল হ্যাকার গ্রুপ সরকারি তথ্য ভাণ্ডার থেকে কিছু ডকুমেন্টস হ্যাকিং করে জনসম্মুখে নিয়ে আসে। সেই ডকুমেন্টসগুলোর মধ্যে ছিল মাশা আমিনীর মাথার সিটি স্ক্যানের ফিল্ম এবং রিপোর্ট। সেই রিপোর্টে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল যে মাশা আমিনীর মাথায় আঘাতের কারণে ব্রেন হ্যামারেজ (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের একটি গোপন সূত্র মিডিয়াকে নিশ্চিত করে যে আমিনীর মাথায় আঘাতের চিহ্ন আছে এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণেই তার মৃত্যু হয়েছে।

এইসব নিয়ে যখন সরকারের সাথে মিডিয়া যুদ্ধ চলছিল তখন আসে আরেকটি টুইস্ট, প্রচণ্ড সাহসী চিকিৎসক, ডাক্তার হোসেইন কারামপুর মিডিয়ায় নিয়ে আসেন আমিনীর হাসপাতালে বেডে থাকাকালীন কিছু ছবি, যেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মাশা আমিনীর মুখ এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে জখমের চিহ্ন যা ছিল রক্তাক্ত। ডাক্তার হোসেইনী চিঠি লিখেন ইরান মেডিকেল কাউন্সিলের প্রধান মোহাম্মদ রইছজাদাকে, উনি লিখেন সত্যকে সামনে আনুন, সততা এবং সাহসের সাথে জনগণের সামনে নিয়ে আসুন প্রকৃত সত্যকে।

এইসব বিষয় যখন রাজপথকে উত্তপ্ত করছিল তখন ইরানের সরকার একটি সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, একজন তরুণী পুলিশ ওয়েটিং রুমে হঠাৎই ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছেন। ইরানের সরকারি মিডিয়া দাবি করে যে নারী কারও আঘাত ছাড়াই ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছেন, তিনিই মাশা আমিনী, যাকে পরবর্তীতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমিনীর বাবা এই ভিডিও ফুটেজ ভুয়া এবং ফেইক দাবি করে বলেন, এটা একটা মেইক ভিডিও, এতো ক্যামেরা আছে থানায়, এই একটি ক্যামেরাতেই কেন ফুটেজ ধারণকৃত। অন্যান্য ক্যামেরার ফুটেজও প্রকাশ করা হোক। পুলিশের গাড়ি থেকে শুরু করে থানার ভেতর বাহির এমনকি অ্যাম্বুলেন্সেও ক্যামেরা ছিল, সেই ভিডিও প্রকাশ করা হোক। সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়া হয় না।

রাজপথে আন্দোলন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, তখন (১৮ সেপ্টেম্বর) ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি দুঃখ প্রকাশ করে সরাসরি ফোন করে মাশা আমিনীর পরিবারের কাছে। তিনি নিশ্চিত করেন যে এই মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং সত্যকে সামনে নিয়ে আসা হবে। ইতিমধ্যে এই ইস্যুটি আন্তর্জাতিক ভাবে আলোচিত হচ্ছিলো এবং সরাসরি জাতিসংঘ থেকেই বিবৃতি আসতে শুরু করেছে। জাতিসংঘ থেকে দাবি তোলা হল, মাশা আমিনীর মৃত্যুর জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের। অ্যামনেস্টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে দাবি উঠে নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত সত্য প্রকাশের জন্য।

রাজপথে আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল আমিনীকে হাসপাতাল নেয়ার দিন থেকেই। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ জনসম্মুখে আসার পর আন্দোলনের তীব্রতা তেহরান ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আরও শত অভিযোগ জনসম্মুখে আসে যেখানে নারীরা সরাসরি অভিযোগ করছিলেন একই ধরণের নৃশংসতার শিকারও তারা হয়েছেন। অনেক ভিডিও ফুটেজ সামনে আসতে থাকলো, যেগুলোতে সরাসরি দেখা যাচ্ছে কিভাবে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন মোরাল পুলিশ দ্বারা। আন্দোলনের এক পর্যায়ে অনেক নারী প্রকাশে নিজের চুল কেটে প্রতিবাদ জানাতে থাকলেন। অনেক নারী প্রকাশ্যে নিজের হিজাব আগুনে পুড়িয়ে ফেললেন। ইরান সরকার দেশে এবং বিদেশে সর্বত্র সমালোচিত হতে থাকলো, এখনও হচ্ছে।

প্রতিবাদী প্রতিরোধের জন্য সরকার শক্ত হাতে পুলিশি পদক্ষেপে আন্দোলন দমনে সচেষ্ট থাকে। যার ফলে শত শত আহত এবং হাজারো গ্রেপ্তার হয়। এখন পর্যন্ত বেসরকারি হিসেবে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ এবং সরাসরি বুলেট ছোড়ার রাজপথে আন্দোলনকারীর মৃতের সংখ্যা ১৮৫ ছাড়িয়ে গিয়েছে। ইথিক্যাল হ্যাকার গ্রুপ সরকারি বিভিন্ন ওয়েব সাইট হ্যাক করে বিগত বছরগুলোর হিজাব এবং নির্যাতন সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। সেলেব্রিটি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ মাশা আমিনীর মৃত্যুতে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে।

এ পর্যন্ত আমরা জেনেছি মাশা আমিনী সংক্রান্ত ঘটনার পূর্ণ বিবরণ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে আজ হিজাব নিয়ে ইরানে এতো আলোচনা সমালোচনা আন্দোলন এসব কিছুই অতীতে ছিল না। কারণ ১৯৭৯ সালের পূর্ববর্তী সময়ে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক ছিল না। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লব সংঘটিত হয় ইরানে, এর পূর্বে ইরানের শাসক ছিলেন মোহাম্মেদ রেজা। তিনি ছিলেন বিদেশে উচ্চ শিক্ষিত সেক্যুলার ঘরানার অসাম্প্রদায়িক মানুষ। তিনি ইরানের আইনে বিশাল সব পরিবর্তন এনেছিলেন, যেমন, বহুবিবাহ প্রথা রোধ করা, মেয়েদের সর্বনিম্ন বিয়ের বয়স ১৮ বছর করা, নারী পুরুষ সম অধিকারের ভিত্তিতে কাজ করা। উনার সময়ে প্রচুর ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৯ সালের সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরই ইরানের আইনে আমূল পরিবর্তন আসে। তখনই ইরানে হিজাবের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। প্রতিবাদ তখনও হয়েছিল, নারীরা প্রতিবাদী হয়েছিল আমরা নতুন ইরানের সূচনা করতে চাই, মেয়েদের হিজাবের নিচে রেখে পেছনের পায়ে হাঁটতে চাই না। কিন্তু তৎকালীন শাসক এই বিষয়ে আরও কঠোর হয়ে ১৯৮১ সালে হিজাব আইন পাস করে, এবং নারীদের হিজাব পরতে বাধ্য করে। এছাড়াও ইতিপূর্বে নিষিদ্ধ করা বহু বিবাহ প্রথা ফিরিয়ে আনা হয় এবং মেয়েদের বিয়ে ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরের বাধ্যবাধকতা তুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ জন্মের পর প্রথম দিন থেকে শুরু করে যে কোন বয়সে পরিবার চাইলে একটি মেয়ে বিয়ে দিতে পারবে।

সাম্প্রতিক সময়ে এ বছরের জুলাই মাসের ৫ তারিখ প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেন, নারীরা ঠিকমতো হিজাব করছে না, হিজাব বিষয়ে সরকার আরও কঠোর হবে। তখন তিনি নতুন আইনে মোরাল পুলিশকে আরও বেশি ক্ষমতা দেন হিজাব আইন বাস্তবায়নের জন্য। নতুন আইনে হিজাব সঠিক ভাবে না পরলে যে কোন নারীকে মোরাল পুলিশ চাইলে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং নির্দিষ্ট সময়ের নৈতিক শিক্ষা এবং প্রয়োজনে জেল হাজতেও প্রেরণ করতে পারবে। একই আইনে নারীদের হাই-হিল (উঁচু জুতা) পরা নিষেধ করা হয় এবং এ সকল আইন বাস্তবায়নের জন্য মোরাল পুলিশকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়া হয়।

১৯৭৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত হিজাবের বিরুদ্ধে ইরানে অসংখ্য আন্দোলন হয়েছে। ২০০৬ সালে ১০ লক্ষ সাক্ষরের একটি পিটিশন দাখিল করা হয় হিজাবসহ সকল আইন যা নারীদের সমতায় বাধা তা বাতিলের জন্য। ২০১৪ সালেও অসংখ্য নারী জনসম্মুখে নিজেদের হিজাব খুলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এটি একটি অনলাইন প্রটেস্ট ক্যাম্পেইন ছিল নারী জাগরণের। ইতিপূর্বে সকল আন্দোলন সরকার কঠোর হাতে দমনও করেছে। তরুণ ডাক্তার ফরহাদ মায়েসামি ২০১৮ সাল থেকে জেল খাটছেন নারী আন্দোলনের সমর্থন দেয়ার জন্য।

আমরা যদি মাশা আমিনীর ঘটনায় ফিরে আসি, তাহলে একটু হিসেব করলেই দেখব যে এত বড় আন্দোলন মাত্র একটি হত্যাকাণ্ডের জন্য রচিত হয়নি। মূলত ১৯৭৯ সালের পূর্বে নারীদের স্বাধীনতা এবং পরবর্তী সময়ে নারীদের অধিকার হরণ একের পর এক প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। এই সময়ের ভিতরে হাজারো মাশা আমিনী মোরাল পুলিশিংয়ের শিকার হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতেও হিজাব নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। কর্ণাটক শহরে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব পরে স্কুল কলেজে আসার জন্য। উক্ত ঘটনায় মামলা হাই কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু হাই কোর্ট হিজাব নিষেধাজ্ঞার পক্ষেই রায় দিয়েছিল। পরবর্তীতে সেই মামলা সুপ্রিম কোর্টে যায় এবং এখন পর্যন্ত তা সুপ্রিম কোর্টেই আছে, কোন রায় হয়নি।

একটু খেয়াল করলে দেখবেন, তেহরান এবং কর্ণাটকের দুটি ঘটনা পুরোপুরি বিপরীত। ভারতের কর্ণাটকের মুসলিম নারীরা হিজাব পরাকে সম্মানের মনে করছেন এবং বলছেন হিজাব পরা তাদের অধিকার। অপরদিকে ইরানের নারীরা হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। আপনারা যদি দুটি ঘটনা খুবই কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেন তবে দেখবেন দুটি ঘটনা মূলত একই। পৃথিবীর আলাদা আলাদা দেশে আলাদা আলাদা সরকার আইন করে নির্দেশ করতে চায় লোকজন কী পরবে আর কী পরবে না তার উপর। আর নারীরা এখানে স্বাধীনতা চায়, তারা তাদের নিজেদের পছন্দমত পোশাক পরতে চায়, হোক তা হিজাব কিংবা জিনস। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখানে নাক গলাতে চায়, বাধ্য করতে চায় নারীদের নির্দিষ্ট পোশাক পরতে। একটা ব্যাপার লক্ষ করবেন, পৃথিবীর কোথাও পুরুষদের জন্য এমন কোন আইন নেই। পুরুষরা কি পরবে কি পরবে এ ব্যাপারে কোন দেশের বাধ্যবাধকতা নেই। পুরো বিষয়টি যদি আপনি নিরপেক্ষ ভাবে বিশ্লেষণ করতে চান তবে দেখবেন, বিষয়টি মূলত স্বাধীনতা। একজন নারী কী পরবে তা তার পছন্দের উপরই ছেড়ে দেয়া উচিত। হিজাব পরা যেমন একজন নারীর ব্যক্তিগত অধিকার, তেমনি না পরাও ব্যক্তিগত অধিকার বা ইচ্ছা। পুরো বিষয়টাতে সমাজ ব্যবস্থা বা ধর্মের নামে নাক গলাচ্ছে পুরুষরা। দেশ ভেদে পুরুষরাই নির্ধারণ করছে নারীরা কী পরবে আর কী পরবে না এবং দিনশেষে তা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে নারীদের উপর। নারীদের হিজাব পরতে যেমন বাধা দেয়া যাবে না, তেমনি হিজাব কেউ না পরলেও তাকে জোর করে পরানো যাবে, আইনের বিধান তো এমনই হওয়া উচিত। কিন্তু রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে বিষয়গুলি সমাজের অলিগলি থেকে সংসদ ভবনেও চলে আসে, এ ব্যাপারে আমি লেখার শুরুতেই বলেছি।

হিজাবের পক্ষে বিপক্ষে আন্দোলন সংগ্রাম দেখবেন, পক্ষে বিপক্ষে আইন দেখবেন… বিষয়গুলোর গভীরে লুকিয়ে থাকে রাজনৈতিক ইস্যু। অথচ, কেউ বলে না, জিজ্ঞেস করি একজন নারী কী পরতে চায়, তাকে তাই পরতে দিই। আমরা শত বছর ধরে ধর্মীয় পোশাক বলে যা নিজে পরেছি বা নারীদের পরিয়েছি তা মূলত নির্দিষ্ট এলাকার ঐতিহ্য সংস্কৃতির নেয়া। এটা একটা সমাজের সাংস্কৃতিক চর্চার ফল। নারীদের পোশাকে অধিকারের প্রশ্ন আসলেই আমরা অশ্লীলতার কথা বলি। সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে এখনও ব্যক্তির স্বাধীনতা কী, আর অশ্লীলতা কী তা যদি না বুঝি তবে কবে বুঝব?

এনামুল হক এনাম, কলামিস্ট, সাহিত্যিক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ