আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

দাসরা মুক্ত হয়েছে, নারীর মুক্তি এখনো হয়নি

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

না, গ্রামীণফোনের ওই বিজ্ঞাপনে নারীবাদীদের আপত্তির কারণটা আপনি বুঝতে পারবেন না। কেননা আপনি নারী বা পুরুষ যাইই হোন, আপনি সমাজের সকল কর্মকাণ্ড দেখেন পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিতে। আপনার চোখে পিতৃতান্ত্রিক পরকলা বসানো। পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে নারীকে গৃহে বন্দি করে। নারীর জন্যে বিধান হয়েছে ওরা ঘর সামলাবে। নারী ঘরে থাকবে, পুরুষের কামনা পরিতৃপ্ত করবে, পুরুষের জন্যে সন্তান জন্ম দেবে, পুরুষের জন্যে রান্না করবে, পরিবেশন করবে। মহান পুরুষরা নারী পুষ্প ও প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লিখবে। শিশুদেরকে ভালবাসবে আর লিখবে 'বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে'।

যখন পৃথিবীতে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল তখন এমনকি মহান মানবিক ব্যক্তিরাও দাসপ্রথাকেই একটি স্বাভাবিক প্রথা হিসাবেই বিবেচনা করতো। তোমার দাসদেরকে মারধোর করবে না, ওদেরকে ভাল খেতে দাও, পোশাক দাও, ওদের প্রতি সদয় হও এইসব খেলো কথাও তখন মহানুভবতা হিসাবে বিবেচিত হতো। এখন যেমন আমাদের ভালো মানুষ পুরুষরা নারীর প্রতি সদয় হও, ওদেরকে স্বাধীনতা দাও, ওদেরকে মারধোর করবে না, ওদের জন্যে কল্যাণের ব্যবস্থা কর এইসব কথা বলেই মহানুভবতার ঢেকুর তোলেন। দাসপ্রথার জমানায় যেমন দাসদেরকে নাগরিক বিবেচনা করা হতো না, নারীদেরকেও তখন নাগরিক বিবেচনা করা হতো না। দাসরা তো মুক্ত হয়েছে, নারীর মুক্তি এখনো হয়নি।

দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে নারীরা খানিকটা অধিকার আদায় করে নিয়েছে বটে। সংগ্রাম করেই নিয়েছে, এমনিতে কেউ দেয়নি। কিন্তু পিতৃতন্ত্র কিনা বিরাজ করে এখনো আমাদের পৃথিবীতে, এখনো আমরা নারীকে পুরুষের সমান মানুষ বিবেচনা করি না। এটাই কারণ আমরা নারীর জন্যে এখনো নির্ধারণ করে রেখেছি কিছু কিছু নির্দিষ্ট ভূমিকা। মাতৃত্ব যেমন। মায়ের ভূমিকাকে আমরা উজ্জ্বল করে দেখাই, আমাদের প্রত্যাশা সন্তান লালন পালন প্রাথমিকভাবে নারীরই দায়। যেন কী গৌরব আহা! পিতৃতান্ত্রিক চোখে এইটাই মনে হয় স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক সুন্দর। জলের মধ্যে বাস করে যে মাছ, তার কাছে জলে বাস করাটাই মনে হয় স্বাভাবিক—হাওয়ায় বাস করা তার কাছে অস্বাভাবিক।


দাসপ্রথার জমানায়ও কিছু কিছু কিছু দাস ওদের নির্ধারিত ভূমিকার বাইরে বেরিয়ে এসে নানা কীর্তি করেছে। ভারতবর্ষে তো রীতিমত রাজা হয়েছে, রাজবংশ স্থাপন করেছে, রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সব পদ দখল করেছে। পিতৃতন্ত্রের মধ্যেও কিছু নারী নিজেদের চেষ্টায় যোগ্যতায় দক্ষতায় নারীর জন্যে নির্ধারিত ভূমিকার বাইরে বেরিয়ে এসে নানা কীর্তি করেছে। অতীতেও করেছে, এখনো করছে। আমরা পুরুষরা ওদেরকে যে সবসময় নিন্দা করি সেটা কিন্তু নয়। আমাদের ভাল মানুষেরা হাততালি দিই—দেখো, মেয়ে হয়েও ওরা কীসব কাণ্ড করছে। খাস পুরুষেরা কিন্তু ঠিকই উত্তপ্ত হয়—মেয়েমানুষ কেন অফিসে যাবে, মেয়ে মানুষ কেন এটা করবে, মেয়ে মানুষ কেন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াবে।

কিন্তু পিতৃতন্ত্রের বেঁধে দেওয়া ভূমিকার বাইরেও মেয়েরা যখন কিছু করে তখন কি আমরা তাকে নারীর জন্যে বেঁধে দেওয়া ভূমিকা থেকে মুক্তি দিই? না, আমরা প্রত্যাশা করি যে মেয়েটা কাজ করবে, টাকাও কামাবে আবার আমার জন্যে 'ম্যাগি নুডলসও' বানাবে। বিজ্ঞাপন দেখেননি? নারীটা ও পুরুষটা একসাথে অফিস থেকে ফিরেছে। ব্যাটাছেলে তার বৌকে বলে ক্ষুধা পেয়েছে, একটা কিছু বানি দাও। 'আদর্শ নারী' অনুগত কণ্ঠে বলে, দিচ্ছি। মায়ের প্রতি মায়া দেখিয়ে কন্যা সন্তানটি ম্যাগি নুডলস বানিয়ে নিয়ে আসে। বিজ্ঞাপনে কি পিতৃতন্ত্রের নির্দেশটা খুব অস্পষ্ট? হে নারী, তুমি চাকরি কর বা ব্যবসা কর বা ব্যারিস্টারি কর—তুমি কিন্তু মেয়েমানুষই থাকবে। ক্লান্ত স্বামীর জন্যে রান্না করা তোমার কাজ—অথবা তোমার কন্যার। ঘর সামলাবে, তারপর অন্য কাজ।

গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপন এর বাইরে কিছু না। ওইখানেও পিতৃতন্ত্রের অমোঘ নির্দেশ। ওরে তার মেয়েছেলে, ব্যবসাবাণিজ্য করছিস সে তো ভাল কথা, কিন্তু তোর আসল কাজ ঘর সামলানো। ব্যবসা করিস, চাকরি করি বা যাই করিস, ঘর যদি সামলাতে না পারিস, স্বামীর জন্যে যদি নুডলসটা বা লেবুর সরবত ঠিকমতো বানাতে না পারিস তাইলে তুই সার্থক রমণী হতে পারলি না। নারীকে রান্না করতে হবে আবার স্বামীর প্রমোদের জন্যে নিজের দেহখানাও সুসজ্জিত করতে হবে। কথা তো এমনি আসেনি—যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। নারীর জন্যে এইটাই পিতৃতন্ত্রের নির্ধারিত ভূমিকা।


বিশেষ করে নারী দিবস উপলক্ষেই বিজ্ঞাপনে এই বার্তা কেন? কেননা নারী দিবস এলে কিনা নারীরা একটু সংগ্রামী চেতনা দেখায়, নিজেদের মুক্তির কথা চিন্তা করা, বৈষম্যের অবসানের কথা বলে, সেটাকে থাপ্পড় মারতে হবে না? থাপ্পড়টা কে মারবে? সমাজের প্রকৃত শাসক যারা—পুঁজি, পুঁজিই তো থাপ্পড় মারবে। নিও লিবারেল কায়দায় পুঁজি কিনা অতি চতুর, ওরা নারীর মুক্তির প্রকাশ্য বিরোধ করবে না, ওরা এমন ভাব করবে যেন ওরা নারীর পক্ষেই। আর আমাদের দেশে বড় পুঁজি বা পুঁজির মাস্তান কারা? ওরাই তো এইসব কথা কায়দা করে ছাড়বে—হে নারী, নারী দিবস এসেছে, পার্পল কাপড় পর, শোভাযাত্রা কর, সবই ঠিক আছে, আমরা স্পন্সরও করবো। কিন্তু ভুলে যেওনা, তোমার নিতান্তই মেয়েছেলে, ঘর সামলাতে হবে।

ভুলে যাবেন না, কমিউনিস্ট নারীরা—ক্লারা জেটকিন ও তার কমরেডরা, ওরা যখন নারী দিবস উদযাপনের সূচনা করেন তখন ওদের মুল প্রতিপক্ষ কারা ছিল। পুঁজির বিরুদ্ধেই কমিউনিস্টদের লড়াই। সেসময় নারীবাদীদের আরেকটা সংগ্রাম চলছিল, ভোটাধিকারের সংগ্রাম। কমিউনিস্ট নারীদের সংগ্রামটা ওদের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট নারীরা এবং অন্যান্য নারীবাদীরা বিরোধিতাও করেছে পরস্পরের চিন্তার। কমিউনিস্ট নারীরা পুঁজির বিরুদ্ধে সর্বহারা সংগ্রাম আর পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর মুক্তির সংগ্রাম এ দুইটাকে এক ধারায় প্রবাহিত করতে চেয়েছে সবসময়। ফলে বিশ্বজুড়ে বড় বড় পুঁজি যারা ওরা যে নারী দিবসকে নারীর মুক্তির সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে নিজেদের পক্ষেই নিতে চাইবে তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে!

নারীর মুক্তির সংগ্রাম থেকে নারীবাদকে দূরে রাখতে ওরা যে খানিকটা সফলও হয়েছে সেকথা তো আমরা জানি। ওরে এখন 'নারীর ক্ষমতায়ন' ধরনের কথা চালু করেছে। লিন-ইন ধারার নারীবাদীরা নারীর সার্বিক মুক্তির পথ থেকে খানিকটা দূরে কিছু নারীর জন্যে ব্যক্তিগত সাফল্যকেই নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার পথ বলে প্রচার করছে। সেইসব প্রচার বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে বটে। কেন হবে না? ওদের সাথে তো এরা আছে পুঁজি। যারা নারীকে মেয়েমানুষ রেখেই কিছু নারীর জন্যে কিছুটা সুযোগ সুবিধা দিয়ে পিতৃতন্ত্র বজায় রাখার পথে ডাকে নারীকে।


আমি অবাক হই না যে এমনকি আমাদের নারীবাদীদের মধ্যে দু-একজনও আছেন যারা পিতৃতন্ত্রকে ঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেন না। ওদের ক'জনকে দেখলাম এই বিজ্ঞাপনে আপত্তির দিকটা দেখতে পান না। অবাক হই না। কেননা আপনার রাজনৈতিক দৃষ্টি যদি স্বচ্ছ না থাকে, আপনি যদি পিতৃতন্ত্রের পরকলা দিয়েই নারীর জন্যে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন তাইলে তো আপনি পিতৃতন্ত্রের শয়তানিটা ধরতে পারবেন না।

নারীবাদী আন্দোলনকে যদি আপনি একটি সর্বাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসাবে না দেখতে পারেন, তাইলে তো আপনি নারীকল্যাণ আর নারীর অধিকারের মধ্যে গুলিয়ে ফেলবেনই।

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ