আজ বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

Advertise

প্রেরণায় নারী

রাজু আহমেদ  

প্রত্যেক সফল পুরুষের গল্প খুঁজে খুঁজে জানুন। তাদের প্রত্যেকের সফলতার যে কোন ভাঁজে কোন এক বা একাধিক নারীর অবদান স্বীকৃতি পাবেনই; হোক সে মা-কন্যা, স্ত্রী কিংবা বোন। মানুষ, মানবতা ও সাম্যের কবি বাস্তবতা বিবর্জিত যুক্তিহীন ছন্দে বলেননি, ‘কোন কালে একা হয়নি ক’জয়ী পুরুষের তরবারি/ প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।’ তিনি যা বলেছেন তা দিনের আলোর মত স্পষ্ট সত্য। কবিগুরুও পুরুষের জীবনে অস্বীকার করেননি নারীর অবদান। অকুণ্ঠ চিত্তে তিনিও ঘোষণা দিলেন, ‘নারীর বচনে শুধু হৃদয়েতে হলাহল/ অধরে পিয়ার সুধা, চিত্তে দাবানল।’

নারী কোন কালেই পুরুষের প্রতিযোগী ছিলো না কিংবা পুরুষও নারীর নয়। সবকালে সবাই সবার সহযাত্রী। বরং দু’সত্ত্বার মিলনের একতায় মানুষ হতে পেরেছে পূর্ণতম সত্ত্বা। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যথার্থই বলে গেছেন, ‘মানব দেহে যেমন দুই চোখ, দুই হাত, দুই পা, সমাজ দেহে তেমন নর-নারী । যে দেহে এক চোখ কানা, এক হাত নুলা, এক পা খোঁড়া সে দেহ বিকলাঙ্গ নারী জাতির সুষ্ঠু উন্নতি ব্যতীত সমাজকে সমুন্নত বলা চলে না।’

মানুষের সফলতার গল্পগুলোর অবয়ব পরিপুষ্ট করতে হলে নারী এবং পুরুষকে ঘরে-বাইরে, শিক্ষায়-কর্মে সম-অবদানে বিস্তৃত হতে এবং দিতে হবে। একজন হেলেনের কারণে ট্রয় ধ্বংস হয়েছিলো—এই অপবাদে যদি নারীকে পিছিয়ে রাখা হয়ে তবে পিছিয়ে যাবে আমাদের বোন-কন্যারা। যদিও বলা হয় সম্পদ এবং নারী ঝামেলার ঝুড়ি তবুও এর জন্য দায়ের ইঙ্গিত কিন্তু পুরুষের দিকেই উঠবে। কেননা পুরুষ যদি নারীকে কেবল ভোগের সামগ্রী হিসেবে বিবেচনা না করতো তবে নারী নির্যাতনের সম্যক রূপ, পারিবারিক অশান্তির দাবানল অন্তত মানুষের পৃথিবীতে প্রোজ্জ্বল হওয়ার সুযোগ পেত না।

শক্তির তোড়ে, কণ্ঠের জোরে আজ অপবাদের সব নারীদের ওপরে অনায়াসে চাপিয়ে দিয়ে পুরুষ মুক্তি নিতে পারে বটে কিন্তু প্রবোধকুমার সান্যালের কাছে ধরা পড়া সত্য অস্বীকার করার সাধ্য কি পুরুষকুল রাখে? তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরী নারীর মোহ মানুষকে এক আশ্চর্য পথে নিয়ে যায়। আসক্তির সঞ্চয় হয় যে পাত্রে, সেই পাত্র থেকেই এককালে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে থাকে নীতি ও নীচতা, ধর্ম, বুদ্ধি ও ঈর্ষা, উদারতা ও প্রলোভন, ঔদাসীন্য ও দীনতা। নারীর সংস্পর্শে এলে পুরুষের অপূর্ব চেহারা ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়।’ আব্রাহাম লিঙ্কন বলতে ভোলেননি, ‘কোন পুরুষের সহায়তা ছাড়া কোন নারী বিপথে যায় না।’

যে সমাজ এককানা দৈত্যের মতো পুরুষশাসিত সে সমাজে শুধু পরের মেয়েরা নিগৃহীত হয় না বরং আমাদের মা-বোন এবং কন্যারাও কোথাও না কোথাও নিগৃহীত হয়। এটাই তো হওয়ার কথা; নয়কি? স্রষ্টার মহান দূতদের থেকে শুরু করে সমাজবদ্ধ যে কোন সফল মানুষের কৃতজ্ঞতা আছে কোন না কোন নারীর প্রতি। নারীর প্রেরণা ছাড়া পুরুষের সাফল্যের স্বপ্ন সুদূর পরাহত। স্রষ্টাও তাই পুরুষের প্রয়োজনে নারীকে নয় বরং সৃষ্টির পূর্ণতার প্রয়োজনে নারীকে সৃষ্টি করতে একটুও ভুল করেননি ।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দিনে দিনে নারী-পুরুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব কেবল প্রকট হচ্ছে অথচ এসব অনাকাঙ্ক্ষিত। নারী পুরুষের কিংবা পুরুষ নারীর প্রতিযোগী হবে কেন? বরং হবে-তো একজন আরেকজনের পূর্ণতার নির্দেশক। স্বপ্ন-যাত্রার বিশ্বস্ত সঙ্গী। শিক্ষার উৎকর্ষতার যুগে আজও ঘরে ঘরে নারী নির্যাতিত হচ্ছে অথচ এসব বর্বরতার দীনতম প্রকাশ। কোন এক স্বার্থে পুরুষকুলের একাংশ নারীকে কেবল দমিয়ে রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কিন্তু নারীর প্রচেষ্টায় নারীর যে উত্থান তা কি শক্তি দিয়ে মোকাবেলার সাধ্য এর পরের যুগের থাকবে? অথচ জাতীয় কবির, ‘নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে/আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে/যুগের ধর্ম এই-পীড়ন করিলে সে-পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই’ বাণী বোধহয় সত্য হতে যাচ্ছে।

যদিও প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সম্পূর্ণটাই ‘ইউটোপীয়’ (কাল্পনিক স্বর্গরাজ্য) ভাবধারার ছিলো তবে সেখানে তিনি নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মানের বিষয়ে যে উদার ধারণা দিয়েছিলেন তা যদি এই সমাজে বাস্তবায়ন করা না যায় তবে ভবিষ্যতের কোন এক কালে নারীর দ্বারা পুরুষকে পর্যুদস্ত হতেই হবে; যেমনটা দূর অতীত থেকে পুরুষের দ্বারা নারীর প্রতি চলমান সময় পর্যন্ত চলছে । ধর্ম নারীকে সম্মানের আসনে আসীন করলো অথচ কিছু মানুষ ধার্মিকের তকমা লাগিয়ে নারীর প্রতি অবিচার চালিয়ে যাচ্ছে। সময় তার সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নেবেই। সময়ের ধর্মই যে অতীতের পুনরাবৃত্তি উল্টোপথে ঘটানো!

একপাক্ষিক ভাবে শুধু পুরুষদের বিরুদ্ধে বলে গেলেও সমস্যার সমাধান আসবে না। কেননা জ্ঞানীরা নারীদেরকেও তাদের দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করতে বলেছেন। বিখ্যাত মনীষী ও দার্শনিক হউরিপিদিস বলেছেন, ‘দুষ্ট মেয়েমানুষের মতো অশুভ আর নেই এবং সৎ মেয়ে মানুষের মতন ঈশ্বর আর কিছু সৃষ্টি করতে পারেননি।'’ নারীত্বের ক্ষমতার গভীরতা অতল। পণ্ডিত কার্ভেন্টিস বলেছেন, ‘যে নারী শ্রদ্ধা আদায় করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সে একপাল উশৃঙ্খল সৈন্যের কাছে থেকেও তা আদায় করতে পারে।’

শেষ বেলায় দ্রোহ ও সাম্যের কবি প্রিয় নজরুলের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে যাই, ‘বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর......নরককুণ্ড বলিয়া কে তোমা করে নারী হেয়-জ্ঞান? তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান/ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে/ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।’ কাজেই পুরুষ যদি অকৃতজ্ঞ না হয় এবং নিজেকে সফল মানুষদের সারিবদ্ধ করতে চায় তবে তার জীবনে বিভিন্ন পরতে পরতে নারীর অবদান সে কোনভাবেই অস্বীকার কিংবা উপেক্ষা করতে পারে না।

রাজু আহমেদ, কলাম লেখক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৪ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৮ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ