আজ বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Advertise

হ্যাপি ব্লিডিং!

মারজিয়া প্রভা  

আম্মুর মেনপেজ স্টেজ চলছে। পিরিয়ড বন্ধ হবার আগে ধুমধাম করে কখনও ওভার ব্লাড যায়, কখনও টানা বন্ধ থাকে। এই স্টেজ নতুন আম্মুর কাছে। আমি তাই গুগল করে জোরে জোরে ব্যাপারগুলো জানছিলাম, মাকে জিজ্ঞাসা করছিলাম ক্লড ( জমাট রক্ত) যাচ্ছে ?  আম্মু ইশারা দিয়ে কাছে ডাকল। আমাকে বলল “কি ভাব, ফ্ল্যাটে তুমি ছাড়া আর মানুষ থাকে না ? রক্ত যায় নাকি জোরে জোরে করে বলছ ক্যান”।

-    প্রথম কথা দরজায় আড়ি পেতে কেউ থাকবে না যে আমাদের কথা কেউ শুনবে। দ্বিতীয়ত  পিরিয়ডে রক্ত যাবে এটা স্বাভাবিক, এটা জোরে আস্তে আর কি! তোমার অসুবিধা তোমাকে জিজ্ঞেস করব না ?
-    নিজের তো শরম নাই। এখন আমারও রাখবা না?

মাত্র তিন সপ্তাহ আগের ঘটনা।  মায়ের বয়স ৫০ পেরিয়েছে, এখন অবধি পিরিয়ড মায়ের কাছে অত্যন্ত “শরম” এর বিষয়।

আমার ছোটবেলা পিরিয়ড হলে মা আমাকে আচার ছুঁতে দিত না। “ছুঁতা” জিনিষ বলত  আমাকে  যার অর্থ অচ্ছুৎ। আমার পিরিয়ড হলে আমি কোন অ্যাঙ্গেল থেকে অচ্ছুৎ হই জানি না। হলিক্রস কলেজে পড়ার সময় আমার পিছনে এক বান্ধবী বসত, এখন মেডিক্যালে পড়ে। তো সে একদিন  বলছিল “পিরিয়ড হলে সকালে উঠে দৌড় দিয়ে বাথরুমে যেতে হয়, কোন কিছুর সাথে ছোঁয়া লাগান নিষেধ”।

অনেকদিন আগে এক আপু প্রশ্ন করেছিল মসজিদ-মন্দিরে-গির্জায় চোর, খুনি যেতে পারে, রজঃস্বলা মেয়ে যেতে পারেনা কেন? মেয়েদের ইস্ট্রজেন হরমোন বেশী থাকা সত্ত্বেও, এই সময়ে রতি অনুভূতি সর্বাধিক হওয়া সত্ত্বেও এবং মেডিক্যাল সায়েন্সে কোনরূপ ভুল প্রমাণ না হওয়া সত্ত্বেও, এখনও ঋতুবতি মেয়ে স্বামীর সঙ্গে সহবাস করতে পারে না। এখনও দেশের ৭০% মেয়ে প্যাড ব্যবহার করে না, ভেজা কাপড় ব্যবহার করে। শুকনা পাতা, বালি, ভুষিও ব্যবহার করে কাপড়ের নিচে রক্ত শোষণ করার জন্য।

অপরাজেয় বাংলাদেশ পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করে। সেখানে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ওয়াহিদা বানু আপু ৯৮ সাল থেকে মেয়েদের মাসিক সচেতনতার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ৯৮ সালের বন্যায় ত্রাণ দিতে গেছেন। ঘরে ঘরে মহিলাদের গিয়ে সাথে কথা বলেছেন। জিজ্ঞেস করেছেন “ খুব কষ্ট তাই না?” তারা বলত “ এমন অনেক কষ্ট আফা, মানুষকে কওয়া যায় না, রক্ত যাইতেছে, যাইতেছে, কাপড় শুকাতে পারি না। কাপড় বাইরে শুকালে স্বামী যদি দেখে অন্ধ হয়ে যাব , আয়ু কমে যাব তার । ওইসব ন্যাতা দিয়ে গ্রামের মানুষ তাবিজ করবে”। যে মাসিক না হলে মেয়ের মা হওয়ার ক্ষমতা থাকবে না, মাসে একবার মিস হয়ে গেলে স্বামী-শ্বশুরবাড়ি চিন্তায় পাগল হয়ে যায়, সেই মাসিকের কাপড় শুকান দেখলে স্বামী অন্ধ হয়ে যাবে ?  

কুসংস্কার পিছু ছাড়ে নি আমাদের। সারা বিশ্বেই টুকটাক ছড়িয়ে আছে এই মিথগুলো। মাসিক চলাকালীন গাছে উঠলে সে গাছে ফল ধরে না, কুকুর যদি পিরিয়ডের রক্ত খেয়ে ফেলে সে পাগল হয়ে যাবে, ভারতে তো আজও অনেক মেয়েদের রান্না করতে দেওয়া হয় না। তারই জের ধরে  ভারতের কেরালাতে  সবরিমালা মন্দিরের দেখভাল ও নীতি নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা গোপালকৃষ্ণন বলেছেন “ছয় থেকে ষাট বছর পর্যন্ত মেয়েদেরকে ওই মন্দিরে ঢোকা নিষেধ। এক জন মেয়ে যে ঋতুমতী নন, এবং তিনি যে মিথ্যে বলে মন্দিরে ঢুকে দেবতা ও মন্দিরকে ‘অপবিত্র’ করছেন না, তার গ্যারান্টি কী ? তাই এই স্টেপ নেওয়া”।

ধর্ম তো ঋতুবতী মেয়েদের অচ্ছুৎ করেই দিয়েছে। এ আর নতুন কি ? গোপালকৃষ্ণের কথায় তাই আমি অবাক হই না। সে তো জানা কথাই নতুন মোড়কে শুধু পুনরাবৃত্তি করেছে। কিন্তু এই ঘটনার পরপরই, ভারতের  বিভিন্ন মহলের মেয়েরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছেন। ক্যাম্পেইন করছেন: ‘#হ্যাপি টু ব্লিড। সেই ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশেও।

এক মেয়ে তার প্রথম রজঃস্রাবের বর্ণনা দিয়েছেন এই হ্যাপি ব্লিডিংয়ের ক্যাম্পেইন হিসেবে। এতে পুরুষ মহল থেকে স্বভাবতই ছি! ছি! উঠেছে। একজন এই জের ধরেছে পুরুষদের প্রথম বীর্যপাতের বর্ণনা দেওয়া উচিত। আমার কথা, বীর্যপাত প্রত্যেক পুরুষেরই হয়! সাধারণ ঘটনা! ওই গোপালকৃষ্ণরও হয়, তাহলে তার কেন মন্দিরে আসা বারণ হল না ? আজ অবধি আমি কখনও শুনি নি বীর্যপাতের ফলে বাবা বলছে ছেলেকে “তুমি খাবার ছুঁবে না, ওটা এঁটো হয়ে যাবে”। সবচেয়ে বড় কথা এই বীর্যপাতের সঙ্গে তাদের সেরূপ সংক্রামক রোগের বালাই নেই। যেটা আছে আমাদের মাসিকের সঙ্গে ।

৬-৭ ঘণ্টা প্যাড পড়ে থাকা, ভেজা কাপড় ব্যবহার করা জরায়ুমুখের ক্যান্সারের এক বিরাট কারণ।এই কথাগুলো জানতে বা বুঝতে খুব বুঝদার কেউ হতে হয় না। আমার এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই পুরুষগুলোই কারও স্বামী হয়, কারও বাবা হয়, কারও ভাই হয়! আজ যখন অন্য নারীর রজঃস্রাবের কথা শুনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করছে, সহজ হতে পারছে না, তখন কি করে ভবিষ্যৎ জীবনে বউকে স্বাস্থ্যসম্মত প্যাডের ব্যবস্থা করবে এরা?

অপরাজেয় বাংলাদেশের ওয়াহিদা আপুর ব্রেইন চাইল্ড হচ্ছে সাড়া দেশের সব মেয়ের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত প্যাডের ব্যবস্থা করার লক্ষে ৪-৫ টাকা প্যাকেটের প্যাড তৈরি করা। এই নিয়ে বহু সংগ্রামের পর  অপরাজেয় বাংলাদেশের মেয়েদেরকেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কীভাবে প্যাড বানাতে হবে, যাতে পার পিস ৪ টাকা করে পড়ে। দেশি বিদেশী ১০ টি প্যাডের এক প্যাকেটের দাম আজ ৭০ টাকার নিচে না, সেখানে এই প্যাডের দাম হবে ৪০ টাকা। আরও অনেকেই সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, এর ফলে প্যাডের দাম ধীরে ধীরে কমবে। আপুর ইচ্ছা মরার আগে হলেও ৪-৫ টাকা দেশের ভিক্ষুক থেকে শুরু করে, গার্মেন্টস কর্মী, প্রত্যন্ত গ্রামের সেই নারীর কাছেও স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দেওয়া।

ধর্ম সমাজ ট্যাবু লাগিয়ে দিয়েছে পিরিয়ডের উপর। দেশের আনাচে কানাচে এত শিক্ষিত ছেলেরাও সেই ট্যাবু ধরে মেয়েকে বাজে বিরূপ মন্তব্য করতে পিছপা হয় না। এই দেশ এই সমাজের আর কতদিন লাগবে এই ভাইটাল বিষয় নিয়ে ট্যাবু ভাঙত ? আমি জানি না!  

যাক বাদ দেই ওদের কথা, আমি বরং তৃপ্তি সহকারে দেখি, মেয়েরা একটু একটু করে ট্যাবুটা ভাঙছে। যে মেয়ে  পিরিয়ডের পেটের ব্যথায় লজ্জা রাঙ্গা হত, ফিসফিস করে নিজের পিরিয়ডের কথা জানাত, সে আজ আত্মবিশ্বাস ভরে হ্যাপি টু ব্লিড লিখছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং। এই ট্যাবু ভেঙ্গে জিতে যাওয়াও অনেক না কিছু পাওয়ার মধ্যেও অনেক পাওয়া।

মারজিয়া প্রভা, ফাউন্ডার, ফেমিনিজমবাংলা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৪ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৫ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন