প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জহিরুল হক বাপি | ২৯ মে, ২০১৬
এ ভুবনে ডুবল যে চাঁদ, সে ভুবনে উঠল কি তা?
হেথায় সাঁঝে ঝরল যে ফুল হোথায় প্রাতে ফুটল কি তা?
এ জীবনের কান্না যত- হয় কি হাসি সে ভুবনে?
হায়! জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের প্রেমে পড়েছিলাম শৈশবেই। আজও উপন্যাসটা আমাকে যাদু করে। বেশ কিছু দিন পর মডেল সাবিরার আত্মহত্যার ঘটনায় কবির ঐ লাইনগুলো মনে পড়লো। সাবিরা যে মালা না গাঁথতে পেরে অন্য ভুবনে চলে গেল সে ভুবনে আজ, কাল বা পরশু প্রাতে সেই সে মালার কি ফুল ফুটবে? সে ফুলের কি মালা হবে? মালা কি সাবিরা কারো তার গলায় পরাতে পারবে?
“সারা নিশি জাগিয়া, মালা গাঁথিয়া ছিঁড়ে ফেলেছি সকালে”
এ ভুবনে সাবিরা মালা ছিঁড়তে পারেনি, তাই মালাই সাবিরাকে ছিঁড়ে ফেলে দিল। সাবিরার আত্মহত্যা, নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পরও ব্লগ, অনলাইন, চায়ের দোকান, কোথাও কোথাও ইস্যু হয়েছে। সাবিরাকে নিয়ে অনেক কথা, অনেক আলোচনা চলছে কম বেশি। প্রায় ৯৫% সাবিরার নিন্দা বা ঋণাত্মক কথা বলছেন। কাওয়ার্ড, মনোবল নাই, ডিজুস, উশৃঙ্খল, মূর্খ এমনকি কেউ সরাসরি পতিতা বলতেও দ্বিধা করেননি। ধরে নিলাম সাবিরা ডিজুস, মনোবল নাই, শৃংখলাহীন এমন কি পতিতাও!
এবার আসি সাবিরা ভালো চাকরী করতো, সাবিরা পড়ালেখা শিখেছে, সাবিরা মডেল, সাবিরার ফেসবুক আইডি আছে। সে হিসাবে সাবিরার প্রচুর পরিচিত আছেন কাছের, দূরের।
সাবিরা আত্মহত্যা করার অনেক আগেই আত্মহত্যার ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করেন। সাবিরার ভিডিও অবশ্যেই পরিচিত কারো চোখে পড়েছেই ঐ সময়ের মধ্যে। তারপরও কেউ এলো না দেখতে, বাঁচাতে, বোঝাতে?! কেন এলো না?? কেন? কেন? সাবিরার একলা থাকার কথা না। বাবা মার ডিভোর্সের কারণেই সাবিরা একলা বাসায় থাকতো কারণ বাবা মা দুই জন দুই ব্যস্ততায়। এমন কি মৃত্যুর পরও সাবিরার লাশ এক ধরনের বেওয়ারিশ হয়েছে সিদ্ধান্তের অভাবে। তার বাবা বিদেশ থেকে ফেরা পর্যন্ত নিঃস্বঙ্গ সাবিরাকে অপেক্ষা করতে হবে আসলেই চলে যাওয়ার। সেতো মানবীয় প্যাচ ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে অথচ তেমন কোন স্বজন নাই বলে হিম ঘরে। সাবিরা যে ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে এও সাবিরার দোষ অনেকের ইনিয়ে বিনিয়ে কথায়। কেউ হয়তো বলতে পারেন সাবিরা আগেও এমন করেছে প্রেমিকের উপর রাগ করে। তাই. . .।
সে ক্ষেত্রে তো বন্ধু, স্বজন, প্রেমিকে উচিত ছিল তাকে এ আত্মহত্যা প্রবণতা থেকে বের করে আনা। প্রয়োজনে চিকিৎসা করানো। যে কারণে সে এমন করে সেই কারণের সমাধান করা। কেউ কি করেছে? কেউ? কেউ? সব দোষ সাবিরার। যে যেহেতু মডেল সেহেতু দোষ চাপানো সহজ। মডেল না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ছাত্রী হলেও এক গ্রুপ বলতো হলের মেয়েরা খারাপ। যারা সাবিরাকে ফেইম সিকার, ইমব্যালেন্স, আত্মবিশ্বাসী ইত্যাদি বলছেন তাদের কে সবিনয় অনুরোধ করবো আপনার নিজেকে চেক করুন। আমরা সবাই এক ধরনের আত্নবিশ্বাসহীনতায়, ইমব্যালেন্সে ভুগছি। কিছু কারণের ভিতর মানসিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে আত্মবিশ্বাসহীনতা বড় এক কারণ।
আমরা বড় হয়েছি, হচ্ছে পারিবারিক নি:সঙ্গতা থেকে জন্মানো অ-নিরাপত্তায়। আগে বাবা মারলে দাদা ধরতো, মা আবদার না রাখলে চাচী, ফুপু আবদার রাখতো। কোথাও না কোথায় জায়গা পেতই। এক ধরনের নিরাপত্তা, আস্থা তৈরি হতো। যার ফল তারা আমাদের চেয়ে অনেক ব্যালেন্স, সুখী, আমাদের চেয়ে অনেক কম সুবিধা পেয়েও। কিন্তু আমরা….. । শুরু কিন্তু আমাদের বাবা-মারাই করেছেন। পরিবার প্রথা ভাঙ্গার পর পর থেকে অবস্থা । দুই যুগ বা তার কিছু বেশি সময় থেকে এর শুরু। সাবিরার কি আর ফিরে আসবে? আসবে না….
ভুলো নারে মন রসনা
সমঝে করো বেচা কেনা
লালন বলে কূল পাবা না
এবার ঠকে গেলে
আর কি হবে মানব জনম
বসবো সাধু মিলে।
সাবিরার আর আসা হবে না। আসলে সাবিরাকে ঐ পথে ঠেলে দিয়েছি আমরা। ঐ পথে আমরা নিজেদেরও ঠেলছি। সাবিরার ক’দিন আগে আত্মহত্যা করলো, সে আত্মহত্যা করে হয়তো বেঁচে গেল। কিন্তু আমাদের বাঁচার কোন উপায় নাই। মৃতরা আত্মহত্যা করতে পারে না। আমরা যদি জীবিত থাকতাম সাবিরার কাছে কেউ না কেউ যেতই। মৃত আমাদের ক্রমাগত আরও অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
কেউ কি আছো একটু আলো দেবার, নিদেন পক্ষে এক জোনাকির আলো?
নেই, আক্ষরিক অর্থে নেই। এ আলোর শিক্ষা দিতে পারতো শিক্ষকেরা। কিন্তু তারাও আন্ধারের ব্যাপারী।
নিজে কানা পথ চিনে না
পরকে দেখায় বারংবার
এসব দেখি কানার হাঁট বাজার
কমার্স কলেজের কথা চিন্তা করুন। দুই কিশোর কিশোরীর প্রণয় কবিতা লিখার অপরাধে ১১ শিক্ষার্থী অপরাধী এবং শাস্তিপ্রাপ্ত। যে শিক্ষকরা এদের বহিষ্কার করলো তারা নি:সন্দেহে এ শিক্ষার্থীদের চেয়ে “কানা”।
বয়ঃসন্ধি কালে শারীরিক, বায়োক্যামিক্যাল পরিবর্তনের কারণে কিশোর-কিশোরী একটু বেশি আবেগ প্রবণ থাকে, কখনও কখনও অনিয়ন্ত্রিত হয়। এটা চারিত্রিক দোষ বা গুনের বিষয় নয়। পুরাই বৈজ্ঞানিক। শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর কাজ পথ দেখিয়ে দেওয়া। জীবন যেন চলতে পারে ভালো ভাবে তার জন্য একাডেমিক শিক্ষার সাথে পারিপার্শ্বিক শিক্ষাও দেওয়া হয়। পারিপার্শ্বিক শিক্ষার কারণে পরিচ্ছন্নতা, টাই পরা, ইন করা, সুন্দর সম্ভাষণ শিখানো হয়। কিন্তু এ বয়সের আবেগ নিয়ন্ত্রণ, মানসিক অবস্থার পথ প্রদর্শনের কোন ব্যবস্থা কি শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে আছে? কমার্স কলেজে আছে? কাউন্সেলিং সাইকোলোজিষ্ট আছে? নেই। তাহলে বয়ঃসন্ধিতে অপরিচিত এ মনোদৈহিক পরিবর্তনকালীন সময়ে এ সব কিশোর কিশোরীদের পথ দেখাবে কে? কলেজ থেকে বহিষ্কারের ফলে সকলে চরম বিব্রতকর অবস্থা পড়বে, পড়েছে। সাধারণ জ্ঞানে বলে কিশোরী সবচেয়ে বিব্রত হবে।
খাওন দিবার বেলায় নাই, কিলের বেলায় গোপাল গোসাই
-কমার্স কলেজের জন্য মানান সই।
আমার জানায় যদি ভুল না হয়, স্কুল কলেজের শিক্ষকদের কোচিং পড়ানো নিষেধ। কমার্স কলেজের শিক্ষকরা কি কোচিং করান না কেউ? জেনে বুঝে ভুল করলে পাপ আর না জেনে পাপ করলে তা হয় ভুল? নিয়ম, শৃঙ্খলার প্রেমের অপরাধের (?!) বিচার করার আগে নিজে সত্যিকারের নিয়ম এবং শৃঙ্খলার মধ্যে আছে তো কমার্স কলেজের উক্ত শিক্ষকরা?
সাবিরা আসলে মরতে চায় নি। সাবিরা বারবার বাঁচতে চেয়ে ছিল বলেই অবর্ণনীয় যন্ত্রণা নিয়ে ভিডিও আপলোড দিয়েছিল। শুনতে কি পাও? কেউ কি আছো? কারো কি স্পর্শ আছে? উত্তর দেবার কেউ ছিল না। মৃতদের কিছু থাকে না। কমার্স কলেজের শিক্ষার্থীদের আমরা সব দিক দিয়েই বাঁচাতে পারি এখনও… বাঁচতে পারি নিজেরাও…. বাঁচাতে পারি নিজেদের ভবিষ্যৎ সন্ততিকেও… যদি কমার্স কলেজকে উদাহরণ হিসাবে নেই… ।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য