প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ | ২৬ আগস্ট, ২০১৬
গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্সের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর ক্ষতবিক্ষত লাশ। লক্ষ্মীপুরে ২ বোনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে ছেলের সামনে মা খুরশিদার উপর বর্বর নির্যাতন। সর্বশেষ ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী আফসানা ফেরদৌসের হত্যাকাণ্ডটি আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। গত ১৩ আগস্ট ২ যুবক মিরপুরের একটি হাসপাতালে আফসানার লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। অদ্যাবধি উন্মোচিত হয়নি এই হত্যা রহস্য।
সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর অগ্রগতি বড় ভূমিকা রাখলেও ঘরের মধ্যে নারীর অবস্থা তেমন বদলায়নি। দেশের নারীদের একটি বৃহৎ অংশ কোনো না কোনো বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার। ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ১৯৯৯ সাল থেকে “বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করে আসছে। যেখানে সংবাদপত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের পাশাপাশি সমিতির সেবা প্রদানকারী কেন্দ্রের তথ্য, সদস্যদের প্রদেয় তথ্য, সত্যানুসন্ধান ও সমমনা সংগঠনের প্রকাশিত বিভিন্ন উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সমিতি কর্তৃক ২০১৫ সালের নারীর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি নিয়ে আজ এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
দেশের নির্যাতিত নারী ও শিশুদের রক্ষা ও অপরাধীদের শাস্তি দিতে প্রথমে ১৯৮৩ সালে নারী নির্যাতন অধ্যাদেশ (৬০ নং) জারি করা হয়। এরপর এই আইনের আরও কঠোর প্রয়োগের জন্য ১৯৯৫ সালে পূর্ববর্তী আইনটি বাতিল করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ১৯৯৫’ প্রণয়ন করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালের আইনের দুর্বলতা, অস্পষ্টতা ও বিভিন্ন ক্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে সময়োপযোগী করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে এটি একটি কঠোর আইন।
আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছাড়াও অতিরিক্ত ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করার কথাও বলা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি পলাতক থাকলে তার অনুপস্থিতিতেই বিচার করার কথা বলা হয়েছে এ আইনে।
‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিলো এ আইনের আওতায় সংঘটিত অপরাধের জন্য বিচার প্রার্থীদের প্রতিকার প্রদান করা এবং অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের রক্ষা করা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা পুরোপুরি হতাশাজনক।
ঢাকার ৫টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে যে চিত্র পাওয়া গেছে তা হলো, এ আইনের অধীনে দায়ের করা অধিকাংশ মামলাই চূড়ান্তভাবে শেষ হয়না। তাই অনেকে এসব মামলার অধিকাংশকেই মিথ্যা বলে অভিহিত করেন।
এ বিষয়ে ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট মাহমুদা আক্তার এর বাস্তবতা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, তিনি দেড় বছর ধরে পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রায় ৩ হাজারের মতো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে এ সময়ে। সর্বোচ্চ ৭/৮ টি মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে আসামিদের। বাকি সব মামলায় আসামিদের খালাস দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। দেড় বছরের পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে শতকরা ৮০ ভাগ মামলাই মিথ্যা।
একই প্রসঙ্গে ঢাকার ১ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এর স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর এডভোকেট আব্দুল বারি বলেন, ‘শতকরা ৯০ ভাগ মামলাই ভুয়া।’
২ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি মো. আলী আকবরও বলেন, ‘পারিবারিক বিষয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে এবং বিরোধের একেবারে শেষের দিকে ১১ (গ) ধারায় (যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা বা মারাত্মক জখম বা সাধারণ জখম) মামলা হয়। এ জাতীয় শতকরা ৯৯ ভাগ মামলায় কোনো সাজা হয়না।’
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্টের ঘটনা আজও অনেকের মনে আছে। ঐ দিন ঢাকা থেকে বাসে করে বাড়ি ফিরছিলো ইয়াসমিন। কিন্তু বাসটি তাকে ‘দশমাইল’ নামক স্থানে নামিয়ে দেয়। সেখানে পুলিশের কয়েক সদস্য তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কথা বলে তাদের ভ্যানে তোলে। ভ্যানে তোলার পর পুলিশ সদস্যরা তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ রাস্তায় ফেলে যায়। এ ঘটনায় ‘দশমাইল’ এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। পরে তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে দিনাজপুরে এক মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে ৭ জন নিহত হয়। পরে আন্দোলনের মুখে জড়িত ৩ পুলিশ সদস্যদের ফাঁসি হয়। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। দিনাজপুরের সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ২৪ আগস্ট ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ’ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বয়সের সাথে ধর্ষণের ঘটনার একটা মিল রয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের শিকার বেশী হচ্ছেন স্কুলগামী মেয়েরা। দেখা যায়, অ্যাসিড সন্ত্রাসের যারা শিকার তাদের যেমন পুনর্বাসনের ব্যবস্থা আছে, ধর্ষণের শিকার যারা তাদের বেলায় তেমনটি নেই।
গবেষণায় দেখা গেছে, আদালতের দ্বারস্থ না হয়ে ধর্ষণের শিকার অনেক কিশোরীই নীরবে সহ্য করেছেন। কেউ কেউ পথ বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশের আইন-কানুন এমন যে অনেক সময় ধর্ষণের ঘটনা আদালতে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার মেয়েদেরকে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। যেহেতু এখন মেয়েরা বেশী সংখ্যায় বাইরে কাজ করছেন এবং কিশোরীরা বেশী সংখ্যায় স্কুলে যাচ্ছেন, সেকারণে তাদেরকে দুর্বল ভেবে অনেক যুবক ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে।
পরিসংখ্যান বলছে, নারী নির্যাতনের হার ও বীভৎসতা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই এধরনের ঘটনা ঘটছে। হিসেব অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে দেশে ১৬৯ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তবে বাস্তবে এর সংখ্যা আরও অনেক বেশী। বিশেষজ্ঞদের মত, অপ-সংস্কৃতির মারাত্মক প্রভাব ও মাদকাসক্ততায় কারণে এসব বর্বরতা বাড়ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২১ হাজার ২২০ টি, ১৪ সালে ২১ হাজার ২৯১ টি এবং ১৩ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজার ৬০১ টি। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের চেয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে বেশী নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। জানুয়ারি মাসে ১৩শ’ ১৫ টি নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। আর ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ড হয়েছে ১৪শ’ ৮২ টি।
নারী ও শিশু নির্যাতন। এ যেন এক গুরুতর অন্ধকারের ইঙ্গিত। সভ্যতা-মানবতার এই কলঙ্ক। এই কলঙ্ক ঘোচাতে সবাইকে কাজ করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে অত্যন্ত উদার নৈতিকতার মধ্য দিয়ে। নারী ও শিশু নির্যাতনকারীরা সমাজের কীট। এদের সমূলে বিনাশ করা সময়ের অন্যতম প্রধান দাবী।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য