আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আলোর মিছিলে আসুক সকল আলোর পাখি

ফরিদ আহমেদ  

এখন থেকে ঠিক চার বছর আগে, এই সেপ্টেম্বর মাসেই ঢাকার একটা অভিজাত হোটেলে জাঁকজমকের সাথে একটা অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানটার নাম ছিল 'ভিশন ২০২২'। ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলবে,  এই স্বপ্নের জন্মের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সেই এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এর উদ্যোক্তা ছিলেন কাজী সালাউদ্দিন। বাংলাদেশের জন্মের সময়কার অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার তিনি। খেলেছেন বাংলাদেশের অহংকার স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিমেও। সময়ের আবর্তনে তিনি এখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি।

বাংলাদেশের যে ফুটবল মান, তা দক্ষিণ এশিয়াতেই সেরাদের কাতারে পড়ে না। দক্ষিণ এশিয়া হচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ। সেই অঞ্চল থেকে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ২০২২ সালে বিশ্বকাপে যাওয়াটা বাস্তবযোগ্য কোনো স্বপ্ন হিসাবে নয় বরং ঘুমের ঘোরের অলীক স্বপ্ন হিসাবেই বেশি বিবেচিত হবার কথা। এমন স্বপ্ন মানুষের মাথায় থাকতেই পারে, আসতে পারে অগোচরে ঘুমের মধ্যে, কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ ঘটা করে অনুষ্ঠান করবে না। আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দেবে না। কিন্তু, কাজী সালাউদ্দিন সেই কাজটা করেছিলেন।

তাঁর স্বপ্নটা অবাস্তব কিনা, উদ্ভট কোনো কল্পনার মধ্যে পড়ে কিনা, এই বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, তিনি সেটা মোটেও মনে করেন না। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি করেছেন এমন অনেক কিছুই অসম্ভব মনে হয়েছিল একসময়। তাঁর ভাষায়‘কোটি টাকার সুপার কাপ করার ঘোষণা যখন দিলাম, অনেকে আমাকে পাগল বলল। মেসিসহ আর্জেন্টিনা আসার আগে লোকজন বলেছে, আমি অবাস্তব কথাবার্তা বলছি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠ দেখে মেসি নাকি খেলতেই নামবে না। কিন্তু মেসি এসেছে, আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচ হয়েছে। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। তাই ২০২২ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।’স্বপ্নকাতর চোখে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ফুটবলপাগল মানুষ। পাগল বলেই মনে করি, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।’

তিনি অসম্ভব মনে না করলেও, এটা আসলেই অসম্ভব একটা কাজ ছিল। মাত্র চার বছরের মাথাতেই কাজী সালাউদ্দিনের সেই স্বপ্ন পাখা মেলার পরিবর্তে ডানা ভেঙে মাটিতে পড়ে গিয়েছে হুমড়ি খেয়ে। গত পরশুদিন মালেতে এক প্রীতি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ মালদ্বীপের সাথে। মালদ্বীপ গুণে গুণে পাঁচ গোল দিয়েছে বাংলাদেশকে। বহু আগে মালদ্বীপকে এমন করে গুণে গুণে গোল দিতো বাংলাদেশ। এখন তারা সেই ঋণ শোধ দিচ্ছে বাংলাদেশকে কড়ায় গণ্ডায়। হারাটা অবশ্য বিস্ময়ের কিছু না। গত পনেরো বিশ বছর ধরেই দুই একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে মালদ্বীপের সাথে হারছে বাংলাদেশ। মালদ্বীপের কাছে পাঁচ গোল খাওয়া দল যে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ খেলবে না, সেটা বোঝার জন্য বিশেষ কোনো জ্ঞান লাগে না। জ্যোতিষী হবারও প্রয়োজন পড়ে না এই বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্য।

এই ঘটনা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, একটা ভিশন নিতে গেলে সেটার পিছনে কী করা লাগে কাজী সালাউদ্দিন সেটা জানেন না। কোনটা বাস্তবায়নযোগ্য স্বপ্ন আর কোনটা কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়ার স্বপ্ন সেটা তিনি বোঝেন না মোটেও। বোঝেন না বলেই এমন এক অবাস্তব স্বপ্ন তিনি নিজে দেখেছেন এবং অন্যদের সেটা ঘটা করে দেখিয়েছেন, যা এখন সুখস্বপ্নের পরিবর্তে দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করছে আমাদের।

অথচ এর বিপরীতের একটা চিত্রটা দেখুন। ঢাকা থেকে অনেক দূরের এক মফস্বল শহর ময়মনসিংহ। সেই ময়মনসিংহ থেকেও আড়াই ঘণ্টার দূরত্বের এক সীমান্তবর্তী অজ পাড়াগাঁ। সেই পাড়াগাঁটির নাম কলসিন্দুর। ওই কলসিন্দুর গ্রামের একজন দরিদ্র স্কুল শিক্ষক, যাঁর নিজের কোনো ফুটবল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, তিনিও ফুটবল নিয়ে একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন। দেখেছিলেন তাঁর স্কুলের মেয়েরা একদিন ফুটবল খেলবে। এমন দিবাস্বপ্ন বহু মানুষই দেখে। দেখে, তারপর আবার ভুলেও যায়। কিন্তু, তিনি এই দিবাস্বপ্নকে স্বপ্ন হিসাবে রাখেননি। বাস্তব করতে মাঠে নেমে পড়েছিলেন তাঁর স্কুলের বাচ্চা মেয়েদের নিয়ে। প্রবল দারিদ্র, কুসংস্কার, মেয়েদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই এর সমস্ত সাহস নিয়ে মাঠে নেমে এলেন তিনি। দরিদ্রতাজনিত অপুষ্টির শিকার একদল মেয়েকে তিনি ফুটবলে লাথি দেওয়া শিখিয়েছেন। তারপর দিনের পর দিন পরম মমতা দিয়ে তৈরি করেছেন তাদের ফুটবলার হিসাবে। এই যাত্রা সহজ ছিল না। বাধা এসেছে নানাদিক থেকে। সেই সব বাধা অতিক্রম করে গেছেন সাফল্যের সেতু তৈরি করে করে। যে মেয়েদের তিনি একদিন তৈরি করেছিলেন কঠিন পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং পরম ভালবাসা দিয়ে, সেই মেয়েরা আজ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে চমকে দিয়েছে গোটা দেশবাসীকে। আমাদের মেয়েরা এশিয়ার সেরা সাত দলের সাথে পাল্লা দিয়ে লড়বে এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের রঙ্গমঞ্চে, এর চেয়ে রোমাঞ্চকর আর কী হতে পারে? শুধু এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে অংশ নিয়েই তারা থেমে থাকবে না। একদিন তারা  বিশ্বকাপেও খেলবে বলে স্বপ্ন দেখছে দলের ব্যবস্থাপকেরা। এই স্বপ্ন কাজী সালাউদ্দিনের স্বপ্নের মতো অলীক কোনো স্বপ্ন না, একটু কষ্ট করলেই হাতের মুঠোয় ছোঁয়া যাবে এমন নরম তুলতুলে স্বপ্ন এটা।

স্বপ্নের বাস্তবায়নে বাগাড়ম্বরতা লাগে না, লাগে না প্রচার এবং প্রোপাগান্ডা। এমনকি লাগে না টাকা পয়সাও তেমন। লাগে শুধু আন্তরিক ইচ্ছাশক্তি, সুগভীর আগ্রহ আর অদম্য সাহস। বাংলাদেশের এই কিশোরী দলটার মধ্যে এর সবগুলো গুণই আছে। এই সব অদম্য মেয়েদের আর মফিজ মাস্টারকে দেখে স্বপ্নের বাস্তবায়ন কীভাবে করতে হয়, সেটা শিখে নিতে পারেন কাজী সালাউদ্দিনেরা।

পুরুষ দল কতদূর কী করতে পারবে বুঝে গেছি আমরা। ওখান থেকে পয়সা সরিয়ে এই মেয়েদের দলটার পিছনে ঢালা হোক। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে লজ্জা কেনার চেয়ে, সেই টাকার কিছু অংশ এই মেয়েরা পেলে অন্তত খাবার সময় দুটো ডিম বেশি পাবে, ঘুমনোর সময় এক গ্লাস দুধ পাবে। সেই সামান্য পুষ্টি নিয়েই নব্বই মিনিট আরবি ঘোড়ার মতো দৌড়বে এরা, প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দেবে প্রবল প্রতাপে।

বাঙালির ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন যদি কেউ সফল করতে পারে কোনোদিন, সেটা পারবে এই সোনার টুকরো মেয়েগুলোই। লক্ষ টাকার দামড়াগুলো নয়। ওরা শুধু লজ্জা আর অপমানের বস্তাই বয়ে আনবে প্রতিদিন আমাদের জন্য।

শুধু বিশ্বকাপে খেলা কিংবা ফুটবল সাফল্য নয়, এই মেয়েগুলো হয়ে উঠবে আগামী দিনে আমাদের দেশের মেয়েদের মুক্তির প্রতীক। আমাদের দেশটা যখন ক্রমান্বয়ে দখলে চলে যাচ্ছিল ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে, তখন এই মেয়েগুলোই এসেছে সাহসী বার্তা নিয়ে।  ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, পশ্চাদপদতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নারীই সবচেয়ে কার্যকর শক্তি। আর এরাতো অমিত শক্তিধর কুশলী নারী। এদের সাহসী এবং সাফল্যমণ্ডিত পদরেখা দেখে পায়ের বাঁধন  খুলে ফেলবে অসংখ্য শৃঙ্খলিত মেয়ে। দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাবে দূরবর্তী সূর্যোদয়ের দিকে। এই সাহসী সমরযাত্রাকে, এই অন্তহীন আলোর মিছিলকে ঠেকানোর সাধ্য নেই কোনো কালো এবং কুৎসিতের।

কিশোরী ফুটবলারদের এই আলোর মিছিলে যোগ দিক আরো অসংখ্য আলোর পাখি।

ফরিদ আহমেদ, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ