আজ মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪

Advertise

উচ্ছ্বাস, উন্নয়ন ও উদ্বেগ

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ  

গত ৩১ আগস্টের ঘটনা। অফিসে নিউজ এডিট করছি। বিভিন্ন ধরণের নিউজ। হরেক রকম সংবাদ। হঠাৎ একটি নিউজ হাতে পেলাম। কিরগিজিস্তানকে ১০-০ গোলে হারিয়েছে বাংলাদেশী মেয়েরা। এর আগে, এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাই পর্বে প্রথম দুই ম্যাচে ইরানকে ৩-০ ও সিঙ্গাপুরকে ৫-০ গোলে হারিয়েছে তরুণী ফুটবলার’রা।

গর্ব আর আনন্দ যখন মিলেমিশে একাকার তখন আরও একটি খবর এসেছে। আমি আনন্দিত চিত্তে সেটি’র এডিটিং-এ হাত দিয়েছে। খবরটি হচ্ছে, যশোর বোর্ডের আওতাধীন এক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। বোর্ড অফিসের হাবিবুর রহমান নামের কর্মকর্তা অফিসের কর্মসময় পেরিয়ে যাওয়ার পর, অফিস ফাঁকা হয়ে গেলে ওই শিক্ষিকার শ্লীলতাহানি করেন। শিক্ষিকার কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মজিদ। তিনি বলেছেন,মঙ্গলবার বিকালে ওই শিক্ষিকার কাছ থেকে লিখিত একটি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি স্পর্শকাতর। শিক্ষিকার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। ‘প্রমাণিত’ হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে।

সংগত কারণে, আমার উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়লো। মন ভার হয়ে গেলো। নাহ! এই দেশে বৈষম্য বিদ্যমান। সেটা যতোই আড়াল করতে চেষ্টা করা হোক না কেন! সত্যি বেরিয়ে আসবেই। বিভিন্নভাবে। বিবিধ রূপে!

নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা অতীতের যে কোনো সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এ ঘটনায় আমরা এখন বিপদসীমা অতিক্রম করে ফেলেছি বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেন। সারা দেশের নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ১ হাজার ৯২ জন নারী-শিশু। আর ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬৬৬ জন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) মতে, জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে ৪০-এর বেশি শিশুকে হত্যা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজন-রাকিব হত্যাকাণ্ডের মতো দ্রুত বিচার আইনে নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না।

মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর মার্চ মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই ৩ মাসে মোট ধর্ষণের শিকার ১৬৯ জন নারী ও শিশু। এই ৩ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হন ৭০ জন। আর এসিড সহিংসতার শিকার হন ১১ জন নারী।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এ ২ মাসে মোট ধর্ষণের শিকার হয় ১০৫ জন নারী। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয় ২৯ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় তিনজনকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করে ২ জন। আর ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন ২০ জন ভিকটিমের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একই সময়ে শিশু নির্যাতন নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ধর্ষণের পর মৃত্যু হয়েছে ২ জন শিশুর। শারীরিক নির্যাতনে একজন গৃহশ্রমিক শিশু ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় ১৮টি শিশুকে। অপহরণের পর হত্যা করা হয় ১১ জন শিশুকে। এ সময়ে ১৩ জন নিখোঁজ শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

বিএমবিএস-এর মতে, গত তিন মাসে ৮৩ জন শিশু হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মার্চে ২১ শিশুকে হত্যা করা হয়। নির্যাতনের শিকার হয় ৯ জন। ফেব্রুয়ারিতে ৪০ শিশুকে নির্যাতন করা হয়। আর হত্যা করা হয় ২৪ শিশুকে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মিডিয়াকে বলেন, শিশুরা প্রতিহত করতে পারে না বলেই তাদের ওপর নেমে আসছে বর্বর নির্যাতন। আর ‘নারীকে ভোগ’ করা নিয়ে সমাজে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত আছে। ফলে আমরা যতই উন্নয়ন করি না কেন, সমাজে নারীদের নিরাপত্তা না থাকা প্রমাণ করছে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, সামাজিক অপরাধগুলোর মধ্যে আগেও নারী নির্যাতন ছিল প্রধান সমস্যা। তবে এখন ডাইমেনশনে পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বায়নের কারণে সোশ্যাল মিডিয়া ও টেকনোলজি ব্যবহারের কারণে সমাজে নেতিবাচক ঘটনাগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

গবেষকরা বলছেন, আমাদের পাঠ্যসূচিতে ‘সেক্স এডুকেশন’ নেই। ফলে মানসিকভাবে পুরুষরা নারীদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত। মেয়েরাও এখন পেশা ও শিক্ষা গ্রহণের জন্য ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন বেশি। ফলে তাদের নির্যাতনের ঘটনাও আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে দ্রুত বিচার আইনে নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের শাস্তি দেয়া হলে এ ঘটনাগুলো কিছুটা কমবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর আধুনিকায়ন ও সংস্কার প্রয়োজন।

নারী নির্যাতনের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরা সহজ। নির্যাতিতদের নিয়ে কাজ করেন অসংখ্য মানবাধিকার সংস্থা। এদের পক্ষে কথা বলতে পছন্দ করেন প্রায় সবাই। যেন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলা পুণ্যের কাজ। নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান দেয়া যতোটা সহজ, ঠিক ততোটাই কঠিন নারী সাফল্যের ইতিহাস তুলে ধরা। সমাজে নারীদের ভূমিকা বর্ণনা করা।

বৈষম্য কখনও মঙ্গলময় বয়ে আনতে পারে না। শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ, যেকোন ক্ষেত্রেই বিরাট বাধা ‘বৈষম্য’। উন্নতির লক্ষে কিংবা স্বাভাবিকভাবে জীবন ধারণের অভিলাষে আমাদের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সেটা কী আমরা পেরেছি? আমরা কী পেরেছি, নারীকে ‘নারী’ নয়, একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে?

বাংলাদেশে ক্রিকেট জনপ্রিয়তা সম্প্রতি বেশী। ক্রিকেটেও নারীদের সাফল্য অগ্রগণ্য। সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও প্রচারে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে ২ সেপ্টেম্বর দেশ ছেড়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। সফরে স্বাগতিক আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি টি-টোয়েন্টি ও দুটি ওয়ানডে খেলবে বাংলাদেশের মেয়েরা। ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। একদিন বিরতি দিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর প্রথম ওয়ানডে। ১০ সেপ্টেম্বর সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ ওয়ানডে খেলবে দুদল। এই সফরে সবগুলো ম্যাচ জিতে দেশে ফিরতে চান নারী দলের অধিনায়ক জাহানারা আলম।

উল্লেখ্য, ৪ বছর আগে অর্থাৎ ২০১২ সালের আগস্টে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে আয়ারল্যান্ড সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। সেবার দারুণ সাফল্য পেয়েছিল তারা। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের সবগুলো ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ নারী দল। কেবল একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচে হার দেখতে হয়েছিলো তাদের। এই ঘটনাটি জানেন ক’জন?

গত ৩ সেপ্টেম্বরের ম্যাচটিতেও জিতেছে বাংলাদেশ। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইয়ের ম্যাচে শক্তিশালী চাইনিজ তাইপেকে হারিয়ে মূলপর্বে উঠেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচে তাইপেকে ৪-২ গোলে হারায় বাংলাদেশের কিশোরীরা। এই জয়ের ফলে ২০১৭ সালে চীনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের মূল পর্বে প্রথমবারের মতো খেলবে কৃষ্ণা-মর্জিয়ারাই।

নির্যাতন-নিপীড়ন-লাঞ্ছনা-বঞ্চনা পেরিয়েও নারীরা এগিয়ে চলছে।  তাদের এগিয়ে চলার গতি আরও দ্রুতময় হতো, যদি তারা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা এবং উৎসাহ পেতেন। যে কাজটি আরতে পারি আমরা। তাদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। নিজের দেশকে এগিয়ে রাখার স্বার্থে।

আগস্ট মাসটি আমাদের জন্য শোকের। চলতি বছরও সদ্য শেষ হওয়া মাসটিতে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু শোকবার্তা। সুখময় ঘটনা নেই বললেই চলে। প্রতিনিয়ত বিবিধ অপ্রীতিকর ঘটনার মাঝেও যারা আমাদের আনন্দিত করেন, সুখী করেন, গর্বিত করেন তাদের কী প্রাপ্য সম্মানটুকু আমরা দিতে পারি না?

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৪ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৯ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪২ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২১ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন