প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রেজা ঘটক | ২০ এপ্রিল, ২০১৫
প্রকাশ্যে নারীর উপর যৌন নিপিড়নের ঘটনা বাংলাদেশে মোটেও নতুন কোনো আজগুবি ঘটনা নয়। এটা দীর্ঘ দিন ধরে প্রকাশ্যে ভিড়ের মধ্যে ঘটতে থাকা নারীর উপর যৌন নিপিড়নের অহরহ ঘটনারই আরেকটি নতুন সংস্করন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে পহেলা বৈশাখের বর্বর ঘটনাটি। ভিড়ের মধ্যে প্রকাশ্যে নারীর উপর যৌন নিপিড়নের দীর্ঘ প্রাকটিসের ফল এটি।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে গাউসিয়া ও নিউমার্কেটের প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যেও নারীর উপর যৌন নিপিড়নের ঘটনা ঘটত। সেটি এখনো বন্ধ হয়নি। বরং সেটি এখন নতুন মাত্রায় বিভিন্ন উৎসব, পার্বন, মেলা, মার্কেট, যাত্রীবাহী লোকাল বাস, বাস-স্টপিজ, ট্রেন স্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, মিছিল, প্রতিবাদ-মিছিল, হাটে-মাঠে-ঘাটে বাংলাদেশের সর্বত্রই দানবের আকারে ছড়িয়েছে। প্রকাশ্যে নারীর উপর যৌন নিপিড়নের প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রযন্ত্র বা আইন শৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীকে সর্বদা নিরব থাকার ইতিহাসই কেবল শোনা যায়।
অথচ আমাদের দেশে বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন বা নিপিড়নের উপর গঠিত আইন কিন্তু খুবই কঠিন। রাষ্ট্রযন্ত্র শুধু আইন করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে চুপচাপ হাত গুটিয়ে নপুংসক দর্শক সেজে বসে আছে। এমন কি কোনো কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুর্বৃত্তদের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিলেও পুলিশ অর্থের বিনিময়ে বা শাসক-দলীয় প্রতাপের কাছে নতি হয়ে তাদের এক সময় ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রকাশ্যে নারীর উপর যৌন নিপিড়নের ইতিহাস এমন সাক্ষ্যই দেয়।
নারী হিসেবে জন্ম নিয়ে একটি শিশু বড় হতে হতে প্রথম যৌবনে নিজের চৌহদ্দির ভেতরেই প্রথমে পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয়দের হাতে প্রথম যৌন নিপিড়নের শিকার হয়। নারীর উপর প্রথম যৌন নিপিড়নের সেই ঘটনাকে অনেকটা পারিবারিকভাবেই এক ধরনের ধামাপাচা দেওয়ার রেওয়াজই এখনো বাংলাদেশে প্রচলিত। তারপর সেই নারীর উপর তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপিড়নের উদাহরণও ভুরিভুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের ভালো রেজাল্টের পেছনে একটি ওপেন সিক্রেট ব্যাপার প্রায়ই শোনা যায়, যার সঙ্গে সেই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের কারো কারো সেই ছাত্রীর প্রতি যৌন নিপিড়নের বা পক্ষপাতদুষ্ট ঘটনাগুলোর ইতিহাসও আমরা অনেক জানি। অনেককেই এটাকে সেই ছাত্রীর শিক্ষকের কাছে নিজের শরীর সপে দেওয়ার বিনিময়ে ভালো নম্বর পাবার ঘটনা হিসেবে জাহির করারও প্রবণতা দেখা যায়। আসল সত্য যা-ই ঘটুক না কেন, সেই ছাত্রী যে শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপিড়নের শিকার হয়নি, তা কিন্তু জোর দিয়ে কেউ বলতে পারবে না। এমন কি সেই ছাত্রীও এটাকে অনেকটাই এড়িয়ে যেতেই পছন্দ করেন।
এরপর সেই নারী যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে তখন তার উপর বদমায়েস লম্পট পুরুষ-বসের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। প্রায় ক্ষেত্রেই হয় সেই নারী স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে কর্মস্থল পরিবর্তন করেন। নতুবা তাদের কেউ কেউ বসের কাছে ধরা দিয়ে নিজের আখের কামিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে আমাদের মিডিয়ায় যারা রাতারাতি বিখ্যাত হতে চায়, সেসব নারীর ক্ষেত্রে এই ধাপগুলো নানান কৌশলে পাড়ি দেবার ঘটনা কি মোটেও মিথ্যে? অনেকটা ওপেন সিক্রেট ব্যাপারের মত দীর্ঘ দিন ধরেই নারীর উপর পুরুষের যৌন নিপিড়নের এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশে এভাবেই প্রাকটিস হয়ে আসছে। এখনো সেই প্রাকটিস চলছে। মুখে কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, ঘটনা কিন্তু ঘটেই চলছে। যার অল্প কিছু ঘটনাচক্রে মানুষ জানতে পারছে। অবশিষ্ট প্রায় বেশিরভাগ ঘটনাই অনেকটা নিজেদের মান-সম্মান বাঁচাতেই নারীরা স্বেচ্ছায় গোপন করছেন।
কোচিং করতে গিয়ে শিক্ষকের কাছে ছাত্রীর শ্লীলতাহানীর ঘটনা ঘটছে। আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নারীর শ্লীলতাহানী ঘটছে। মার্কেটে মেলায় উৎসবে বেড়াতে গিয়ে নারীর উপর যৌন নিপিড়নের ঘটনা ঘটছে। সেই সকল ঘটনার প্রায় অধিকাংশই হয় গোপন থাকছে বা নারীরা নিজেদের মান-সম্মানের দোহাই দিয়ে নিজেরাই গোপন করছেন। কিন্তু এভাবে প্রায় প্রতিদিন-ই বাংলাদেশে প্রকাশ্যে বা অন্দরমহলে গোপনে নারীদের উপর যৌন নিপিড়নের ঘটনা ঘটছে। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যা জেন্ডার ভায়োলেন্স নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই অর্ধেক নারীর মধ্যে ১০ থেকে ৪০ বছর বয়সি নারীদের উপরই যৌন নিপিড়নের ঘটনাগুলো সবচেয়ে বেশি ঘটছে। অন্তত শতকরা ৭৭ ভাগ নারী বাসাবাড়িতে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছেন। সন্তান জন্মদানে সক্ষম এমন ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি নারীদের অন্তত শতকরা ৬০ ভাগ যৌন নিপিড়নের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন হয়েছে সত্য কিন্তু কোথাও এই নিপিড়ন তেমন বন্ধ হয়নি। বরং যৌন নিপিড়নের সেই ঘটনা অন্দরমহল ছাড়িয়ে দিনদিন প্রকাশ্যে ঘটার হার বাড়ছে।
এখন প্রশ্ন হল গাউসিয়া-নিউমার্কেট থেকে টিএসসির দূরত্ব কত? ভৌগলিক দূরত্ব হয়তো কয়েক শো গজ বা কয়েক শো মিটার। কিন্তু নারীদের উপর যৌন নিপিড়ন বৃদ্ধির তীব্রতা তুলনা করলে এই দূরত্ব কয়েক হাজার মাইল। বাংলাদেশের গোটা ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়েই এই যৌন নিপিড়নের তীব্রতা জ্যামিতিক হারেই বেড়েছে। তাহলে এই ঘটনার পেছনে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কি?
১. আমাদের সমাজ নারীকে মানুষ নয় নারী হিসেবেই উপস্থাপন করতে বেশি পছন্দ করে। করপোরেট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের আড়ালে মূলত নারীর যৌবনকেই পুঁজি করছে। এখনো দেশে মেরিল-প্রথম আলো সুন্দরী প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এগুলো নারীর উপর যৌন নিপিড়নকে এই সমাজই ইচ্ছে করে উসকে দিচ্ছে। যে কোনো বিজ্ঞাপনে নারীকে ব্যবহারের এই চিত্রই সমাজে আজ এই নষ্টামিকে উৎসাহিত করছে।
২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন শিক্ষা না থাকা বা যৌন শিক্ষা নামকাওয়াস্তে থাকলেও সেটি ছেলেমেয়েদের প্রকৃত শিক্ষায় ততোটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ যে শিক্ষা ছেলেমেয়েদের চোখ খুলে দেবে, সেই শিক্ষাকে এই সমাজে নানান অছিলায় গোপন করার প্রবনতা দেখা যায়। যৌন শিক্ষা তো বাংলাদেশে একদম অনুপস্থিত।
৩. সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে বাংলাদেশ মূলত নারীদের জন্য এক ধরনের সীমাবদ্ধতা টেনে দিয়েছে। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে বর্তমানে হিজাব বা বোরকা পড়ার হার অনেক বেশি। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই হার আশংকাজনক হারে বেড়েছে। যার সঙ্গে ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রসারের একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এই ৪৪ বছরে ধর্মীয় মৌলবাদের আশংকাজনক বৃদ্ধিই এই হিজাব ও বোরকা বৃদ্ধির পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। ভবিষ্যতে মদিনা সনদ অনুযায়ী যদি দেশ শাসিত হয়, এই সংখ্যা রাতারাতি কয়েকশ গুণ বাড়ার আশংকাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
৪. মোবাইল ফোনের ব্যবহার ও ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল ফোনের ব্যবহার যতবেশি বেড়েছে, তরুণ প্রজন্মের কাছে ততবেশি পর্নো ছবি বা পর্নো ভিডিও দেখার প্রবনতাও বেড়েছে। এমন কি তরুণ প্রজন্মের মেয়েদের হাতের মোবাইল ফোনেও এই পর্নো ছবি বা পর্নো ভিডিও দেখার ব্যাপারটি আশংকাজনক হারে বেড়েছে। যা আসলে বাংলাদেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকেই এই ডিজিউজ-প্রজন্ম নাড়িয়ে দিয়েছে। এই ঘটনাগুলো নারীর উপর যৌন নিপিড়ন বৃদ্ধির হারকে উৎসাহিত করছে।
৫. মিডিয়ার কল্যানে বিদেশি বা বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রতি বাংলাদেশ যত বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে, তত বেশি এই নারীর উপর যৌন নিপিড়নের সংখ্যাও বাড়ছে। বিশেষ করে মেয়েদের পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে যতোটা বিজাতীয় সংস্কৃতির পোশাকের দিকে আমাদের মেয়েরা ঝুঁকছে ততোটা বেশি হারেই এই যৌন নিপিড়ন বৃদ্ধির প্রবনতা দেখা যাচ্ছে।
৬. দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে স্বীকৃত পতিতাপল্লী গুলো রাষ্ট্রীয় মদদে উঠিয়ে দেওয়া হলেও, দেশের যে কোনো স্থানে আবাসিক হোটেলগুলো এখন অনেকটাই সেই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থ্যাৎ নষ্টপল্লী উঠিয়ে দিতে গিয়ে রাষ্ট্র সেই পল্লীকে অনেকটাই হাতের নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছে। ঢাকায় গুলশান বনানী বারিধারাসহ বিভিন্ন এলাকার আবাসিক হোটেলগুলোতে সবার চোখের সামনেই চলছে রমরমা যৌন ব্যবসা। এমন কি ঢাকার কোনো কোনো এলাকায় বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়েও এই যৌন-ব্যবসা চলছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ম্যানেজ করেই।
৭. সরকার বিবাহের ক্ষেত্রে নতুন বয়স সীমা চালু করেছে, যেখানে আগে মেয়েদের জন্য সর্বনিম্ন বয়স সীমা ছিল ১৮ বছর এবং ছেলেদের জন্য ছিল ২১ বছর। এক সময় বাল্যবিবাহ রোধ করতেই এই আইন করা হয়েছিল। অথচ সেটাকে শীতল করে নতুন আইনে মেয়েদের জন্য পরিবার ইচ্ছে করলে ১৬ বছর বয়সি মেয়েকে রাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে বিবাহ দিতে পারবে বলা হয়েছে। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে তা কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। যা অল্প বয়সেই ছেলেমেয়েদের রাষ্ট্রীয়ভাবে যৌন কর্মে উৎসাহিত করার সামিল। যা আসলে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাল্যবিবাহ অনুমোদন করার জন্য দায়ী। অথচ আন্তর্জাতিক যে কোনো আইনে ১৮ বছরের নিচে যে কোনো ছেলেমেয়েকেই শিশু গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের সদস্য। ২০২১ সালের মধ্যে প্রজনন হার কমিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশ ঠিক করেছে, বিবাহ যোগ্য বয়সের হার কমিয়ে তা মূলত বাংলাদেশের জন্য এখন বুমেরাং হবে।
৮. বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আইন শৃঙ্খলায় চরম অবনতি নারীর উপর যৌন নিপিড়ন বৃদ্ধির একটি অন্যতম প্রধান কারণ। কারণ বাংলাদেশে অপরাধ করার পর অপরাধীরা বিনা বিচারে সবার চোখের সামনে বুক ফুলিয়ে হাঁটছে। বিচার ব্যবস্থার চরম পরিনতি এজন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। তাছাড়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চরম উদাসীনতাও এক্ষেত্রে চরমভাবে দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীকে অর্থের বিনিময়ে বা শাসক দলের স্বজনপ্রীতির অযুহাতে ছেড়ে দিচ্ছে। আবার অনেক ঘটনায় যৌন নিপিড়করা রাষ্ট্রীয়ভাবে শাসক দলের পুরস্কার হিসেবে বিদেশে যাবার সুযোগ পেয়েছে। যা অন্যদের নারীর উপর যৌন নিপিড়ন করতে উৎসাহিত করছে।
৯. ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর থার্টি ফার্স্টের নাইটে টিএসসিতে বাঁধন নামের যে মেয়েটি যৌন নিপিড়নের শিকার হয়েছিলেন, সেই ঘটনার বাংলাদেশে বিচার হয়নি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেঞ্চুরি পালনের ঘটনারও কোনো বিচার হয়নি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর বা ছাত্র কর্তৃক সহপাঠীর যৌন নিপিড়নের ঘটনাগুলোরও আজ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। যা নতুন করে নারীর উপর যৌন নিপিড়ন করাকে এই গোষ্ঠী হাতিয়ার হিসেবে নিয়েই উৎসাহিত হয়েছে।
১০. বাংলাদেশে বিশেষ করে নব্য চালু হওয়া শহুরে সংস্কৃতিতে মা-বাবারা তাদের সন্তানদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কুবই কম খোঁজখবর রাখেন। বাসা থেকে বাইরে গিয়ে তাদের সন্তান কোথায় কি করছে, কার সঙ্গে মিশছে, কি কি করে বেড়াচ্ছে, সে সম্পর্কে মা-বাবাদের আগ্রহ অনেক কম। এজন্য তারা সময়কে দুষছেন। মা-বাবারা কাজের ভিড়ে সন্তানকে একদম সময় দিচ্ছেন না। সেই সুযোগে তাদের সন্তানরা বখাটের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে। এই হাইব্রিড প্রজন্ম তাই ঘরের বাইরে কোথায় কি করছে, এ সম্পর্কে মা-বাবাদের আসলেই কোনো ধারণা নেই। সন্তানদের সময় না দেওয়ার এই প্রবনতা থেকেই তাদের মধ্যে এক ধরনের ভোগ-লালসা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১১. ১৯৭৭-৭৮ সালে মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের একটি দলছুট অংশ বাংলাদেশের কক্মবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। সেই থেকে রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এসব রোহিঙ্গাদের জীবিকার জন্য প্রধান ব্যবসা হল মায়ানমার থেকে চোরাই পথে বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্য এনে তা বাংলাদেশের লোকাল মার্কেটে সাপ্লাই দেওয়া। রোহিঙ্গাদের সেই নেশার সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে সর্বনাশা ইয়াবা নেশা। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ইয়াবা সেবনের হার আশংকাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে গুলশান বনানী ধানমন্ডি ও পুরান ঢাকার কিছু অংশে ইয়াবা ব্যবহারের হার বিপজ্জনক হারে বেড়েছে। যা প্রকাশ্যে নারীদের উপর যৌন নিপিড়নের জন্য এক ধরনের মাশালা হয়েই কাজ করছে।
এরকম প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যাবে যেসব কারণে বাংলাদেশে নারীদের উপর যৌন নিপিড়ন বা যৌন হয়রানীর ঘটনা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। যেখানে রাষ্ট্র অপরাধীকে অনেকটা জামাই আদরে বাঁচিয়ে রেখেছে বা ছাড় দিয়েছে। একজন অপরাধী যখন অপরাধ করার পরেও সবার চোখের সামনে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ানোর সাহস পায়, তখন সেই ঘটনা একই মানসিকতার অন্য অপরাধীকে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশের জন্য এই উৎসাহিত করার ঘটনাই সবচেয়ে বেশি। আর যারা এই অপরাধে এখনো যুক্ত হচ্ছে না, তারা সেই ঘটনার নিরব দর্শক হয়ে নপুংসকের মত আচরণ করছে। এই উভয় ঘটনাই রাষ্ট্রের সমাজ বিকাশের পথে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। আর রাষ্ট্রযন্ত্র ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মদিনা সনদ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করলে অদূর ভবিষ্যতে প্রকাশ্যে নারীদের উপর যৌন নিপিড়নের ঘটনা আরো ভয়ংকর আকার ধারণ করবে। যা থেকে বাংলাদেশের শীঘ্রই মুক্তি পাবার কোনো লক্ষণ আপাতত নেই।
একদিকে করপোরেট মিডিয়ার নানান ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যের কারণে প্রভোক করার মত উপাদান আমাদের পোষাকের সঙ্গে এবং আচার-আচরণে বা ডেইলি প্রাকটিসে নানাভাবে যুক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে দেশে অবাধে ইয়াবা প্রবেশ করছে। মোবাইল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির দেখার প্রবনতা বাড়ছে। সেই সুযোগে কোনো কোনো অতি উৎসাহী মহল বাংলা পর্নোগ্রাফিও করারও দুঃসাহস দেখিয়েছে। এসব নষ্টদের হাতে হাতে সেসব পর্নোগ্রাফি এখনো অবাধে চলাচল করছে। এসব উপাদানই সম্মিলিতভাবেই নারীদের উপর প্রকাশ্যে যৌন নিপিড়ন করতে উৎসাহ দিচ্ছে। আর রাষ্ট্রযন্ত্র তা দেখে বসে বসে ঝিমোচ্ছে। প্রতিরোধে কোনো ভূমিকাই পালন করছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীর পক্ষেই রাষ্ট্রপক্ষ ওকালতি করছে।
এই যখন দেশের সামগ্রিক চিত্র, তখন পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের সামনে প্রকাশ্যে যে বর্বর ঘটনা ঘটেছে, তা গাউসিয়া থেকে টিএসসি পর্যন্ত প্রকাশ্যে নারীর উপর যৌন নিপিড়নের অনেকটাই স্বাভাবিক বংশগতিবিদ্যারই ফসল। একে মোটেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার কোনো সুযোগ নাই। বরং দীর্ঘ সময়ে সমাজে এই প্রবনতা মড়কের মত বংশবৃদ্ধি করেছে। টিএসসিতে সেদিন অন্তত ১৯টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো ছিল। সেই চিত্র অনেক সিসিটিভিতেই ধরা পরাটা স্বাভাবিক। এখন পুলিশ যদি বিশেষ কাউকে বাঁচাতে সিসিটিভির সেই ফুটেজ মুছে ফেলে, তাহলে অপরাধী ধরা পড়বে কিভাবে? বরং এই অজুহাতে হয়তো নিরিহ কাউকে কাউকে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে সংঘটিত ওই ঘটনাকে কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। এখনো তিনি প্রক্টরের দায়িত্বে কিভাবে আছেন সেটাও একটা রহস্য বটে। পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে সেদিন আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ এই ঘটনা থেকে নিজেদের দায় এড়াতে পারেন না। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজনেই সমান অপরাধী। দুজনের মিথস্ক্রিয়ায় ওই সময়ে ওই অপরাধ সংগঠিত হবার সুযোগ পেয়েছে। অতএব এই ঘটনায় শুধু অপরাধীকে খুঁজে বের করে সাজা দিলেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। অন্যায়কে যারা প্রশ্রয় দিয়েছে তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা সমাজ বিকাশে যতক্ষণ আমরা নারীকে মানুষ হিসেবে না দেখব, ততক্ষণ নারীর উপর প্রকাশ্যে বা গোপনে যৌন নিপিড়ন বন্ধ হবে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা একজন নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী, বিএনপি-র মত একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান একজন নারী, এমন বড় বড় অনেক কিছুতেই বাংলাদেশে নারীদের এগিয়ে যাবার ইতিহাস আছে। আজকে টিএসসিতে গুটিকয়েক সমমনা সংগঠন বা প্রতিবাদী মানুষ গিয়ে মানববন্ধন বা মিছিল-শ্লোগান দিয়ে সমাজে দীর্ঘ সময়ে গেড়ে বসা এমন অসুরদের লোলুপ হায়ানার থাবাকে থামানো যাবে না। প্রতিবাদটা আমাদের সমাজের ওই অগ্রসর নারীদের বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, মাননীয় স্পিকার, বা বড় বড় মাননীয় নারী নেত্রীদের কাছ থেকেই আসতে হবে।
আর এই ঘটনার যত দ্রুত সম্ভব অপরাধীকে ধরে বিচারের আওতায় এনে কঠোর সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে আমাদের মিডিয়ার কল্যানে দুদিন পরেই আমরা আবার অন্য ঘটনায় মনযোগী হব। পহেলা বৈশাখের ঘটনা অন্য সব নারী যৌন নিপিড়নের ঘটনার মত একদিন চোখের সামনে হারিয়ে যাবে বা চাপা পড়ে যাবে। নারীর প্রতি প্রকাশ্যে বা গোপনে যৌন নিপিড়নের ঘটনাকে রাষ্ট্র কোনোভাবেই বিচার না করে এড়িয়ে যেতে পারে না। এখন রাষ্ট্রযন্ত্র কখন কিভাবে কত দ্রুততার সঙ্গে সেই কাজে আকৃষ্ট হয় নাকি ভুলে যেতে উদ্যত হয়, তা সময়ই বলে দেবে।
সুতরাং সাধু সাবধান!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য