প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আশরাফ মাহমুদ | ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৬
‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’-এর খসড়া আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়েস ন্যুনতম ১৮ বছর রাখা হলে-ও “বিশেষ ক্ষেত্রে বা প্রেক্ষাপটে” যেকোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সর্বোত্তম স্বার্থ-বিবেচনায় আদালতের নির্দেশে এবং পিতামাতার সম্মতিতে বিয়ে ন্যুনতম বয়েসের আগে হতে পারবে।
“অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের স্বার্থ-বিবেচনায়” ব্যাপারটি কী আসলে? একটি মেয়ের সর্বোত্তম স্বার্থ কি কেবল বিয়ে হওয়া? একজন মানুষের জীবনের সার্থকতা কি বিয়েতে নিহিত?
আইনের এই “তবে” কিংবা “বিশেষ প্রেক্ষাপটের” সমালোচনাকারীদের প্রধানমন্ত্রী সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন না বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন“আমাদের আর্থ-সামাজিক বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।”
হ্যাঁ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা হচ্ছে যে বাঙলাদেশ বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি দেশ। এইদেশের ৫২% মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়েসেই, এর মাঝে ১৮% এর বিয়ে হয় পনের বছর বয়েসেই। সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বিশ্বাস, দরিদ্রতা, যৌনতা সংক্রান্ত অপরাধসমূহ (যেমন- ইভ-টিজিং, ধর্ষণ ইত্যাদি) থেকে মেয়েদের “রক্ষা” করার তাগিদ, যৌতুক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি নানা আর্থ-সামাজিক কারণসমূহ রয়েছে এই অস্বাভাবিক বাল্যবিবাহের হারের পেছনে। হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আর্থ-সামাজিক কারণগুলো বা সমস্যাগুলো সমাধান না করে বা করার চেষ্টা না করে যখন সেইসব সমস্যাকে সমাধান হিসেবে বিবেচনা করে আপনারা আইনে ফাঁক রেখে দেন তখন বাল্যবিবাহের হার বাড়ার সম্ভাবনা আর-ও আছে।
গ্রামে প্রচুর বাল্যবিবাহ হয়, পূর্বের আইনে ন্যুনতম বয়েস ১৮ বছর রাখার পরে-ও, এরকারণ আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত না করা, যথেষ্ট শাস্তির ব্যবস্থা না রাখা। তারপর-ও আইন থাকলে সেটি মানুষের অপরাধের হারকে কমায়। কিন্তু আপনাদের আইনের এই বিশেষ প্রেক্ষাপটে গ্রামের এই বাল্যবিবাহের হার আর-ও বাড়বে, যেহেতু আইনের ফাঁকের কারণে “বিশেষ প্রেক্ষাপটের” আশ্রয় নেবেন অনেক অপরাধী। প্রস্তাবিত আইন এইসব “বিশেষ প্রেক্ষাপট”কে ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত-ও করেনি।
শুধু গ্রাম না, শহর উপশহরে-ও প্রচুর বাল্যবিবাহ হয়। “অভিভাবকের সম্মতি”তে যখন মেয়েটির বয়েস ১৮ বছরের আগেই বিয়ের ব্যবস্থা রাখা হয় তখন আপনি বা আপনারা খেয়াল রাখেন না যে আমাদের দেশে অধিকাংশ অভিভাবকরা এই মনোভাব রাখেন যে মেয়ের বিয়ে দিতে পারা এক ধরণের দায় মেটানো, অধিকাংশ মেয়েদের বিয়ে হয় পরিবার ও অভিভাবকের চাপে, নিজ অসম্মতিতে; সেই অভিভাবক ও পরিবারের উপর সিদ্ধান্তের আইনি বৈধতা দিয়ে আপনি বা আপনারা মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ ও নারী-অধিকারকে অপমান করছেন।
প্রধানমন্ত্রী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের প্রেক্ষাপটে গর্ভপাতের কথা না বলে সেটিকে বাল্যবিবাহের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য ব্যবহার করেছেন। বাঙলাদেশে গর্ভপাত বৈধ নয়। বাল্যবিবাহের বয়েস না কমিয়ে যেটি আশা করছিলাম আপনার কাছে তা হচ্ছে গর্ভপাত বিষয়ক আইনের শিথিলতা, গর্ভপাতকে শর্তহীন বৈধতা দেয়া। গর্ভপাত আইনের কেনো পরিবর্তন প্রয়োজন সেটি নিয়ে আমি অন্যত্র আলোচনা করেছি। বাংলাদেশের গর্ভপাত-সংক্রান্ত আইন মূলত বৈষম্যমূলক এবং আন্তর্জাতিক সর্বজনীন মানব অধিকারের বিপক্ষে যেহেতু এইসব আইন নিশ্চিত করে না যে চিকিৎসা ও জীবন সংক্রান্ত মৌলিক ব্যাপারগুলোতে নারী নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের সমাধান বাল্যবিবাহ হতে পারে না; অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও বাল্যবিবাহ দুই খারাপ। একটি রাষ্ট্রের উচিত দুটো কোনোটি যেনো না ঘটে তা নিশ্চিত করা। একটি বন্ধ করার জন্য অন্যটিকে সুযোগ করে দেয়া নয়।
বাল্যবিবাহ যে কতো খারাপ এটি সম্পর্কে সকলে ধারণা রাখেন আশা করি। বাল্যবিবাহ ছেলে মেয়ে দুজনেরই জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই। মেয়েদের ক্ষেত্রে রয়েছে অপরিণত সন্তান জন্মদান, সন্তানের বিভিন্ন শারীরিক ক্রুটির সম্ভাবনা। বাল্যবিবাহ সুষ্ঠু জীবন বিকাশের জন্য অন্তরায়; যে বয়েসে একটি মেয়ের শিক্ষাদীক্ষা করার কথা, জীবন ও সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার কথা সেইসময়ে তাকে সংসার শিখতে হয়, অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়। প্রধানমন্ত্রী নারী স্বাধীনতা ও নারী অধিকারের কথা বলেন, অথচ তিনি কি বুঝতে পারেন না যে বাল্যবিবাহের আইনের এই ফাঁক দিয়ে তিনি নারী স্বাধীনতা ও নারী অধিকারের আন্দোলনকে কতোটুকু পিছিয়ে দিলেন।
প্রধানমন্ত্রী ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের অনেক দেশের তুলনা এনেছেন বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে। অনেক দেশেই এটি বড় সমস্যা, কিন্তু সেইসব দেশে এর বিরুদ্ধে আইন আছে অথবা সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে, যা বাঙলাদেশে নাই। বাঙলাদেশের অবস্থা ইউরোপের দেশগুলোর মতন নয়। আর ইউরোপ বা অন্য কোনো দেশ একটি অপরাধকে সায় দিলেই আমাদের-ও দিতে হবে এটি তো কুযুক্তি। ওইসব দেশে বাল্যবিবাহ নয়, বরং যৌন-স্বাধীনতা আছে, অর্থাৎ ১৬ এর পরে অনেক দেশে যৌনতায় লিপ্ত হওয়ার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু বিয়ের স্বাধীনতা নেই। বিয়ের একটি অংশ যৌনতা হতে পারে, কিন্তু বিয়ে যৌনতা থেকে অনেক জটিল বিষয়, যেটি অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পীড়াদায়ক। মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশ সম্পন্ন হয় প্রায় ২৫ বছর বয়েসেই। সুতরাং অনুমান করতে পারেন যে ১৮ বছরের নিচের একটি মেয়ে অথবা ছেলের মানসিক অবস্থা বিয়ে ও সংসারের মতন জটিল বিষয়ের জন্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ফলে জন্ম নেয়া সন্তানের পিতৃ-পরিচয় নিশ্চিত করাকে বাল্যবিবাহের “বিশেষ প্রেক্ষাপট” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন “আমি যতদিন সরকারে আছি, মনে করি এটা আমার দায়িত্ব। সমাজের এই সন্তানটাকে একটি স্থান করে দেওয়া। তার জন্য এই বিশেষ বিধান করে দিয়েছি।“ বাল্যবিবাহের সুযোগ না দিয়ে আপনার একজন সচেতন অভিভাবক, রাষ্ট্রনেত্রী হিসেবে দায়িত্ব হওয়া উচিত এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ যেনো না ঘটে কিংবা ঘটলে জন্ম নেয়া সন্তানের জীবন বিকাশ নিশ্চিত করা, বাল্যবিবাহকে বৈধতা দেয়া নয়।
প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ এনেছেন বাল্যবিবাহের বৈধতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে, বলেছেন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রদেশে ১৪ কিংবা ১৬ বছর বয়েসে বিয়ে হয়। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে অনেক কিছু হয়, তাদের অস্ত্র রাখার আইনি বৈধতা আছে, উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা আছে, অনেক প্রদেশে অ্যালকোহলের পাশাপাশি গাঁজা ইত্যাদি মাদক বৈধ, অবাধ যৌনতা বৈধ, বিবাহবিহীন সম্পর্ক ও বসবাস বৈধ, সমকামীদের অধিকার নিশ্চিত করা হয় অনেক প্রদেশে; অর্থাৎ আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রকে যদি বাঙলাদেশ রোল মডেল বানাতে চায় একজন প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে দাবি তোলা যায় সমকামীদের অধিকার নিশ্চিত হোক বাঙলাদেশে, যৌনশিক্ষার প্রচলন হোক আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের মতন আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। আমি জানি এইসব হবে না, তাই সজীব ওয়াজেদ জয় যখন বাল্যবিবাহের বৈধতার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে যখন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেন তখন তা বেমানান শোনায়।
অনেকে ধারণা করছেন যে এই আইনের ফাঁক, “তবে”“বিশেষ প্রেক্ষাপটের” সুযোগ নিয়ে অনেক ধর্ষক পার পেয়ে যাবেন, দেশে নারী অপরাধ বাড়বে। ধরুন, একটি মেয়েকে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেমিক ধর্ষণ করলো, এবং প্রধানমন্ত্রীর “বিশেষ প্রেক্ষাপট” অনুসারে সেই ধর্ষকে-ও বিয়ে করার বৈধতা দেয়া হয়। এছাড়া রয়েছে, পেডোফাইলিজম বা শিশুকামকে উৎসাহিত করার সম্ভাবনা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে তাই অনুরোধ গ্রামে থাকা না থাকা, আমাদের দেশের বাস্তবতা ইত্যাদি কুযুক্তিতে আস্থা না রেখে একটি মেয়ে, একটি পরিবারের ভালোর কথা ভেবে, একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’ এর “বিশেষ প্রেক্ষাপট” অনুসারে যেকোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের স্বার্থ-বিবেচনায় আদালতের নির্দেশে এবং পিতামাতার সম্মতিতে বিয়ে দেয়ার সুযোগ বন্ধ করুন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য