আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

দাসত্ব সহজ বলেই নারীর মুক্তি আসতে এত বিলম্ব!

চিররঞ্জন সরকার  

একথা ঠিক, নানা সীমাবদ্ধতা ও বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে নারীরা এগোচ্ছে। পরিবারে, সমাজের চারদিকে তাকালেই এই পরিবর্তনটা চোখে পড়ে। সবখানেই এখন নারীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। ‘কিছু একটা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা’ এখন পুরুষের মত নারীর মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়।

কিছু একটা করতে হবে, কিছু হতে হবে- এই প্রেরণা পুরুষের পক্ষে বহুকালের। সভ্যতা অনাদি অতীত থেকে এই চেতনারই সঞ্চার করেছে, পুরুষকে হতে হবে সফল ও কর্মঠ। নারীকেও হতে হয় সফল ও কর্মঠ, কিন্তু তার ঠিকানা ছিল গৃহকারাগার। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমগ্র পরিক্রমাই ছিল পরিবার নির্ধারিত কর্তব্যপালন এবং পুরুষমুখাপেক্ষী। নারী ভালো স্ত্রী হবে, ভালো মা হবে, সংসারে শ্রমদান করবে, সে হবে নতমুখী ও সহনশীল। রাত নামলে কামকলাপটিয়সী হলে সোনায় সোহাগা, না হলেও পুরুষের ‘রমণসহন রমণী’ হতেই হত। অষ্টগণ্ডা সন্তানের জন্ম দেওয়া আমাদের ঠাকুমা-দিদিমাদের দেখলেই তা বোঝা যায়। মেয়েরা যে পুরুষজাতির মতোই স্বতন্ত্র, সম্পূর্ণ মানুষ, এত অগ্রগতি-প্রগতির যুগে এসেও গোটা বিশ্ব সে কথা বিশ্বাস করতে পারল না!

সফল ও স্বাধীন নারীর নামের তালিকা দীর্ঘায়িত হচ্ছে ঠিকই, হওয়ার কথাই, কিন্তু আলোর বিপরীতে জমে থাকা অন্ধকারের মতোই নারীর প্রতি সূক্ষ্ম কিংবা প্রকট অসম্মানের মনোভাব যে রয়েই গেছে। এই দৈন্য, এই অসুস্থতা কমবেশি সব প্রতিষ্ঠিত নারীকেই সইতে হয়, যা পীড়াদায়ক।

আমাদের দেশে এখনও কোনো নারীকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার আগে দশবার জিজ্ঞাসা করা হয়- তুমি পারবে তো? তোমার তো ঘর-সংসার আছে! সেসবের দোহাই দিয়ে মাঝপথে দায়িত্ব ছেড়ে দেবে না তো? সংসার সামলানোটাও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়!

গুরুদায়িত্ব অর্পণ করার কথা বললেই ‘ঘর-সংসার’ সামনে এসে গেল। সংসার তাকে কর্তব্যচ্যুত করতে পারে- এই শঙ্কা প্রকাশ পায় সে নারী বলেই। যেসব পুরুষ মাল্টিন্যাশনালের এক্সিকিউটিভ, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক তাদের সকলেরই সংসার থাকে। সেসব তাদের পেশাদারিত্বের পথে বাধা নয়। তাহলে একজন নারীর বেলায় কেন সংশয়? কারণ, একজন নারীকে সেই পুরনো ভূমিকায় কল্পনা করতেই সমাজ অভ্যস্ত। একজন পুরুষের সংসার সামলান একজন নারী, কিন্তু নারীটি স্বয়ং যদি কৃতী হয়ে ওঠেন, তবে তাঁর গার্হস্থ্য কে সামলায়? এ নিয়ে আজও সমাজে অনেক শঙ্কা আছে। বিশেষত আমাদের দেশে, যেখানে পুরুষকে সংসারধর্মে হুকুম করতে এবং সেবাগ্রহণের ভূমিকা নিতেই শেখানো হয়। পুরুষ উপার্জন করে, সে প্রভু। নারী তার ভোক্তা, সে দাসী। আর্থসামাজিক সম্পর্কের এই সহজ নিয়ম পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি পাল্টেছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি কি পাল্টেছে?

অথচ বর্তমানে অবকাঠামোগত বিবিধ সুবিধা, প্রযুক্তিগত সুযোগ এবং সর্বোপরি একজন পেশাদার উপার্জনক্ষম নারীর আর্থিক স্বাধীনতা তাঁর ঘর-সংসার পরিচালনা এমন স্বচ্ছন্দ করে তুলতে পারে যে পেশাগত জীবনে সংসার অন্তরায় হয় না। আসল বাধা মনের মধ্যে। সেটি সমাজমানস বা ব্যক্তিমন যাই হোক না কেন।

চিন্তার দৈন্য, দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতাই একজন নারীর চলার পথ আজও কণ্টকাকীর্ণ করে চলেছে। কিন্তু তার চলার পরিসর আরও বিস্তৃত হওয়ার কথা ছিল। স্বাধীনতা সম্পর্কে নারীর চেতনা খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেকখানি পথ পেরিয়েছে। তারপরও সেই প্রচণ্ড শক্তি কোথাও কোথাও স্তিমিত মনে হয়।

একজন মেয়ে কী হতে চায়, কতখানি পূর্ণতা পায় তার চাওয়া? কোন চাওয়াটি আমরা বলতে পারি সঠিক? শেষ পর্যন্ত ঘরোয়া সুখ-শান্তি-তৃপ্তিই কি মানুষ হিসেবে একজন নারীর চরম লক্ষ্য, নাকি যে গুণাবলি, যে শক্তি নিয়ে তার জন্ম ও বিকাশ, তার কিছুমাত্র পরিভরণ ও অবদানই আদর্শ হওয়া উচিত? মেয়েরা একজন মেয়ে হিসেবে নিজে কী চায়?

মেয়েরা আসলে সমাজ থেকে, পরিবার থেকে, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কি শিখছে? একটি মেয়ে, যে শিক্ষিত, যার স্বনির্ভর হওয়ার যোগ্যতা ও সুযোগ আছে, সে জীবনকে কিভাবে দেখবে? তার লক্ষ্য কী হবে? তার চেতনা যখন বিকশিত হচ্ছে, শিক্ষক এবং অভিভাবকরা তাকে কোন পাঠ দিচ্ছেন, যাতে সে বুঝতে পারে, জীবন নিয়ে কী করতে হয়।

অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, একটি মেয়েকে সেই পাঠ অত্যন্ত সুন্দরভাবে দেওয়া হয় যে তাদের কাছে জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় ‘সংসার’ বা গার্হস্থ্য অবদানটুকু। তার যোগ্যতা, দক্ষতা প্রয়োগ করার ক্ষেত্র সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়। পরিবার ও প্রতিবেশ তাকে এভাবে ভাবতে শেখায় বা গার্হস্থ্য অবলম্বন করতে বাধ্য করে। এসব ক্ষেত্রে বিবাহ ও ঘর-সংসার তার সমগ্র জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ না হয়ে সমগ্র জীবনটিই হয়ে দাঁড়ায়। পূর্বসূরীদের মতোই তারা সংসার পরিচালন করে, সন্তানের জন্ম দেয় এবং প্রতিপালন করে, অর্থনৈতিকভাবে এবং বহির্জগতের যাপন প্রসঙ্গে স্বামী অথবা অপর কোনও পুরুষের ওপর নির্ভর করে। একদল এতে সুখী ও তৃপ্ত। একদল অসুখী ও অতৃপ্ত।
যারা অতৃপ্ত, তাঁরা গতানুগতিকতা থেকে বাইরে বের হওয়া, সনাতনপন্থীদের কাছে যারা ‘ভ্রষ্ট’। তাঁরা বিশ্বাস করে, মানুষ হিসেবে তাঁর নিজ পরিচয়, অবদান ও মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। প্রথম থেকেই তারা কিছু হতে চায়, কিছু করতে চায়। এই চাওয়া পূরণে প্রথম ও প্রধান পাথেয় সাহস ও আত্মবিশ্বাস। দ্বিতীয়, লেগে থাকার জন্য প্রয়োজন শক্ত ও সহনশীল বা ধৈর্যপরায়ণ মন।

আশার কথা হলো, সমাজে এই ‘ভ্রষ্ট’দের সংখ্যা বাড়ছে। এমন দিন আসবে, যখন শুদ্ধ গৃহিণীপনা ও স্বামীনির্ভরতায় সুখী, তৃপ্ত নারীর সংখ্যা হ্রাস পেয়ে প্রতিটি নারী তার আত্মপরিচিতি গড়ে তুলতে চাইবে। প্রতিটি নারী আত্মসচেতন হবে, সংসারের প্রতি দায়িত্ব নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।

কারণ, মেয়েরা অতি দ্রুত নিজেদের চিনে নিচ্ছে। স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা যারা আয়ত্ত করেছে, তারা সংসারের অন্যায় পক্ষপাত এবং অর্থহীন অনুশাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করছে।

আধুনিক ও প্রগতিশীল বিবর্তন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকেই সর্বোত্তম স্বাধীনতা বলে মনে করে। অবশ্যই তা সমাজ ও সভ্যতার নিরিখে শর্ত ও অনুশাসনের ঊর্ধ্বে নয়। প্রকৃত শিক্ষা ও চেতনার বিকাশ শুধু স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠাই শেখায় না, পারস্পরিক সত্ত্বাকে সম্মান জানায়। এমতাবস্থায় একজন স্বাধীনচিত্ত নারী সামাজিক শৃঙ্খলগুলির অর্থহীনতা বর্জন করতে চাইবেন বৈকি।

পুরুষমুখী ও পুরুষকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা বহন করে চলেছিল মেয়েদের শেকল-পরা চরণ দুটি। আজ শেকল খসানোর ঝমঝমানি বৃহৎ শব্দ হয়ে বেজে উঠছে। ওঠার কথাই ছিল। এক শ্রেণির নারী তাদের জীবনযাপনে যতো নির্ভরশীলতা, স্বাধীনতাহীনতা এবং অমর্যাদার শ্রীরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন, ততোই আরেক শ্রেণির কাছে মনে হয়েছে আমি এমন হতে চাই না, আমাকে স্বাধীন হতে হবে। তাদের মধ্যে দানা বাঁধে সমস্ত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে ‘কিছু একটা’ হয়ে উঠতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

অনেক ক্ষেত্রেই একজন মেয়ের জীবনে পরিবার অনুকূল হয় না। বিশেষত, বিবাহিত জীবনে একজন মেয়ের অবস্থান, সামাজিক ও ব্যক্তিগত উভয় ক্ষেত্রেই জটিলতর হয়ে ওঠে। নিজের লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে মানিয়ে নেবার প্রবণতা তৈরি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা এ সময়। কারণ স্বাধীনতার পথ সংঘর্ষের পথ, রক্তক্ষয়ী, ক্ষতোৎপাদী। স্বাধীনতার চেয়ে দাসত্ব সহজ বলেই নারীর মুক্তি আসতে এত বিলম্ব!

নারীর মুক্তি ও স্বাধীনতায় আর্থিক নিরাপত্তা ও স্বোপার্জন একটি অংশমাত্র। মূল প্রতিপাদ্য নারীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার মর্যাদা। স্বাধীনতার বোধ চেতনায় প্রবেশ করাতে হয়। সর্বাগ্রে নিজেকে বুঝতে হয় নিজের মর্যাদা এবং স্বাধীনতার অর্থ কী। জ্ঞান হওয়া মাত্রই সমাজ নানাভাবে বহুবিধ নিরর্থক সংস্কার নারীদের ওপর চাপিয়ে দিতে থাকে। অভ্যাসবশত, বিনা প্রশ্নে, নারীরা সেই সব মেনে নেয় এবং অবশ্যকর্তব্য হিসেবে তার দাসত্বশৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে।

তাই দিন এসেছে আরও অনেক বেশি প্রশ্ন করবার, নিজেকে এবং অবশিষ্ট জগৎকে। কারণ নির্মম বাস্তব হলো, যার আত্মমর্যাদাবোধ নেই, জগৎ তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার সমস্ত আয়োজন নিয়ে বসে আছে। নারী হোক বা পুরুষ, কিছু হয়ে ওঠার পথ মসৃণ হয় না কখনও। লক্ষ্য স্থির রেখে নিজের কাজটি করে যাওয়া এবং উৎকর্ষের সাধনাই মানুষ করতে পারে। স্বাধীনতা এবং মর্যাদা ছাড়া মানুষ মানুষের মতো বাঁচে নাকি?

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ