আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

অভিযুক্ত ধর্ষকের পিতা মিথ্যা বলছেন

কবির য়াহমদ  

ঢাকায় দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় অবশেষে থানা মামলা নিয়েছে, জানাজানি হয়েছে; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ মূলধারার গণমাধ্যমগুলো এনিয়ে প্রতিবেদন করছে। ইত্যবসরে অভিযুক্ত পাঁচ জন আত্মগোপনে চলে গেছে। আত্মগোপনে গেছে বলছি কারণ পুলিশের দাবি অনুযায়ি অভিযুক্ত ধর্ষকদের তাদের বাড়িতে পাওয়া যায় নি।

ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মার্চ মাসের ২৮ তারিখ। ভিকটিমরা থানায় মামলার জন্যে উপস্থিত হয়েছিলেন মে মাসের ৪ তারিখ। এরপর থানায় ওই অভিযোগ অপেক্ষমাণ হিসেবে থেকেছে আরও ৪৮ঘণ্টা, ৬ তারিখে মামলা হিসেবে লিপিবদ্ধ করে পুলিশ। এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এসময়ের মধ্যে অভিযুক্তরা নিরাপদ অবস্থানে চলে গেছে।

মামলা করতে দেরি করার কারণ হিসেবে ভিকটিমরা জানিয়েছে তারা হুমকির মুখে ছিল, নিয়মিতভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হতো। তাছাড়া ধর্ষণের সময় ভিডিওধারণ করা হয়েছিল, আর এটা দৈহিক ক্ষতি ও প্রাণনাশের ভয়ের চাইতে সবচেয়ে বড় ভয় ছিল। এ ভিডিওপ্রকাশের হুমকি হয়ত আইনের আশ্রয় চাওয়ার পথে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছে।

মামলার এজাহার, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়া সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত ধর্ষক শাফাত আহমেদ আপন জুয়েলার্সের মালিক চার ভাইয়ের একজন দিলদার আহমেদের বড় ছেলে। শাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ধর্ষণের শিকার তরুণীরা বনানীর রেইনট্রি হোটেলে গিয়েছিল। এছাড়াও মামলার অপর আসামিদের মধ্যে নাঈম আশরাফ ও সাদমান সাকিফ নামে দুজন শাফাতের বন্ধু এবং বিল্লাল তার গাড়িচালক। অপরজন শাফাতের দেহরক্ষী, মামলায় তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল মতিনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যম জানাচ্ছে নাঈমের বাবা একজন ঠিকাদার এবং তিনি একটি টেলিভিশন স্টেশনের বিজ্ঞাপন বিভাগে কর্মরত; আর সাদমানও একটি টেলিভিশন স্টেশনে কর্মরত।

এদিকে, ধর্ষণ মামলা হওয়ার পর প্রধান অভিযুক্ত শাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক দিলদার আহমেদ অনেকটা তার ছেলের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন, “ওই রাতে যদি কিছু হয়েও থাকে তাহলে সমঝোতার ভিত্তিতেই হয়েছে। [বিডিনিউজ ৭ মে, ২০১৭]” তিনি একই সঙ্গে এ অভিযোগের পেছনে ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে পুত্রের সাবেক স্ত্রীর যোগসাজশে এ মামলা হয়েছে বলেও দাবি করেছেন। দিলদার আহমেদের বক্তব্যের সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত শাফাত স্ত্রী-পরিত্যক্ত স্বামী, যার সঙ্গে আগে এক টেলিভিশন উপস্থাপিকার বিয়ে হয়েছিল এবং তাদের ছাড়াছাড়িও হয়েছিল।

দিলদার আহমেদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, তিনি তার পুত্রের ধর্ষণকাণ্ডকে অস্বীকার করেন নি, উলটো একে ঢেকে রাখতে “সমঝোতা” নামক এক শব্দ উল্লেখ করছেন। মানে তিনি নিজেই তার পুত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত। আর মামলায় পুত্রের সাবেক স্ত্রীর যোগসাজশ বলে যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন সেটা স্রেফ প্রতিশোধপরায়ণতা আর ধর্ষণের ঘটনাকে ঢাকা দেওয়ার অপচেষ্টা মাত্র।

এবার মূল অভিযোগের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণের জন্যে তাৎক্ষণিক পরীক্ষানিরীক্ষার যে বিষয়টি রয়েছে সেখান থেকে অভিযুক্তরা অনেকটাই পার পেয়ে যেতে পারে। কারণ ধর্ষণের প্রায় মাসাধিক কাল অতিক্রমের পর এ নিয়ে অভিযোগ এসেছে। ফলে শারীরিক পরীক্ষায় অভিযুক্তরা অনেকটা পার পেয়ে গেলেও অন্যান্য আলামত এক্ষেত্রে অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণের জন্যে সহায়ক হতে পারে। অভিযোগের পর ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের পাঁচ সদস্যদের সমন্বয়ে এক মেডিকেল বোর্ড গঠিত হয়েছে। ওই বোর্ড ইতোমধ্যেই দুই তরুণীর মাইক্রোবায়োলজি, রেডিওলোজী ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে। মেডিকেল বোর্ড প্রধান সোহেল মাহমুদ ঘটনার দেড় মাস পর তাদের পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হচ্ছে বলে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতার উল্লেখ করে জানিয়েছেন, ‘যেহেতু ওই দুই তরুণী বলছেন ধর্ষণের ঘটনাটি প্রায় দেড় মাস আগের, এ কারণে আদৌ কোনো আলামত পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’

এক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণের মূল দায়টা গিয়ে পড়বে পুলিশ প্রশাসনের উপর। তারা চাইলে এর সঠিক বিচার সম্ভব বলে মনে করি। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন নিশ্চিতভাবেই উঁকি দিচ্ছে, পুলিশ কি এর সঠিক তদন্ত করবে? যেহেতু পুলিশ নিজেই মামলা নিতে দুই দিন সময় পার করে দিয়েছিল সেহেতু প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাছাড়া অভিযুক্তদের সকলেই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান, এবং তারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রভাবশালীও, তাই পুলিশের পক্ষ থেকে কেমন তদন্ত হবে সে নিয়ে সন্দেহের জন্ম দেয়। তবে অগণন নেতিবাচক চিন্তার বাইরে পুলিশের ৪৮ ঘণ্টার মত দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের বিষয়টিকেও ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই, বিশ্বাস করতে চাই- পুলিশের এ সময় নেওয়াটা ছিল মামলাগ্রহণের পূর্বে নিশ্চিত হওয়া। জানি, এ যুক্তি অতিশয় দুর্বল এক, তবু শেষ পর্যন্ত বিচারপ্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপ তদন্তের উপর বিশ্বাস রাখার জন্যে এ দুর্বল যুক্তিকেই অবলম্বন ভাবা!

ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ধারণ এক্ষেত্রে হতে পারে শক্ত এক প্রমাণ। সাক্ষী, অভিযুক্তের জবানবন্দি, রেইনট্রি হোটেল/রেস্টুরেন্টের সিসিটিভি ফুটেজ, রেজিস্টার; সর্বোপরি অভিযুক্তদের পালিয়ে যাওয়াটা এক্ষেত্রে হতে পারে বড় প্রমাণ। আশা করি পুলিশ প্রশাসন এগুলোকে আমলে নিয়ে সঠিক তদন্ত করতে পারবে। এছাড়াও কোন মেয়ে নিজে ধর্ষিত হয়েছেন এমন দাবি এমনি-এমনি করেনা, এগুলোকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস করতে চাই।

বাংলাদেশ ধর্ষণের এক মহামঞ্চ হয়ে উঠছে দিনদিন। প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে, কিন্তু সে হিসেবে বিচার হচ্ছে কমই। মিডিয়ায় উঠে আসা ধর্ষণের বাইরেও অগণন ধর্ষণকাণ্ড ঘটছে, কিছু কিছু চাপা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বনানীর ধর্ষণের ঘটনা সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির কিছু লোকের মাধ্যমে সম্পাদন হয়েছে, এবং এটাও অন্য অনেক ঘটনার মত প্রায় চাপা দিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত এ ধর্ষণের ঘটনা চাপা দেওয়া যায় নি।

অভিযুক্ত ধর্ষকের বাবা “সমঝোতা” শব্দ ব্যবহারে ধর্ষণকে সেচ্ছাসঙ্গম হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছেন। কিন্তু দুই তরুণী নিজেই অভিযোগ দায়ের করেছেন, যাতে প্রমাণ হয় ওখানে “সমঝোতা” বলে কিছু ছিল না, ছিল শক্তি-প্রদর্শন। ফলে ধর্ষকের বাবার অভিযোগ মিথ্যা হয়ে যায়, আর তার অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হওয়া মানেই ধর্ষণের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া।

আশা করি সংশ্লিষ্টদের সঠিক তদন্ত ও এরপথ ধরে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পাদনের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হওয়া দুই তরুণী ন্যায়বিচার পাবে।

কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর; ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ