আজ বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Advertise

ধর্ষণ ও গণমাধ্যম

এস এম নাদিম মাহমুদ  

সকালে ল্যাবে আসার পর মোবাইল থেকে ফেইসবুকে ঢুকতে ১৮ মিনিটের একটি ভিডিও চোখে পড়লো। ইউটিউবের লিংকে গিয়ে দেখি ধর্ষিত এক মেয়ের সাক্ষাতকার। ভিডিওটি সেমি-ব্লার মুডে থাকলেও স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে মেয়েটিকে, যিনি একটি কক্ষে বসে সাক্ষাতকার দিচ্ছেন। ধর্ষণের বিবরণ দিচ্ছেন তিনি আর তার সাক্ষাতকার নিচ্ছেন একজন। আমি প্রথমে ধরে নিয়েছিলাম, এটা হয়তো শৃঙ্খলা বাহিনীর ইন্টারোগেশন কিন্তু পরবর্তীতে যখন সাক্ষাতকার গ্রহণকারি থানায় কিভাবে গেলেন এমন প্রশ্ন করলে, এটা নিশ্চিত হলাম যে সাক্ষাতকার গ্রহণকারী আমাদের কোন জ্ঞাতি ভাই।

এতোটা নিচে আমরা কেমন নামতে পারি একবার বলবেন কি? এটা কি ধরনের সাংবাদিকতার মধ্যে পড়ে? যেখানে আমাদের গণমাধ্যমে শুরু থেকে মেয়ে দুইটির প্রকাশ করেনি, সেখানে এক সাক্ষাতকারে সব হিসেব উল্টে দিয়েছে। ধর্ষিত মেয়েটি বারবার করে অপর ধর্ষিত মেয়েটির নাম উচ্চারণ করছিল, কিন্তু তা গোপন থাকলো না। সারাদেশের মানুষকে ওই ভিডিও মাধ্যমে পরিচয় করে দিলো, এই হলো ধর্ষিত মেয়ে। এই হলো আলোচিত ধর্ষিতা?

আমার মস্তিষ্কে কোন সময়ে একটি বিষয় কাজ করেনি তাহলো, এই ধরনের ভিডিও সাক্ষাতকার কেন প্রয়োজন? কেন ফোনালাপ বা অডিও রেকর্ড প্রচার করতে হবে?

আমার জানামতে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবাদের সত্যতা ধরে রাখার জন্য সাংবাদিকরা কিছু তথ্য রেকর্ড করে রাখতে পারে, আর সেইটাকে পুঁজি করে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা প্রকাশ পাবে সাংবাদিকদের লেখনিতে। সংবাদের গর্জন থাকবে সংবাদের তথ্যে। আর এর পিছনে শক্তি হিসেবে থাকে গুরুত্বপূর্ণ ওই অডিও ক্লিপ। হ্যাঁ, এটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদের একটি স্বীকৃত নিয়ম। কিন্তু আমরা তার অপব্যবহার শুরু করে দিয়েছি। মেয়েটিকে সামাজিকভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার পথ তৈরি করে দিয়েছি।

আমি জানি, সাধারণ মানুষের এই ধরনের সংবাদের উৎসাহ বেশি থাকে। ওরা আরো বেশি বেশি জানতে চায়। মেয়েটির সামাজিক মর্যাদা কি, কেমনে ওই ঘটনা ঘটলো ইত্যাদি কৌতূহল মিটানোর নেশায় সাংবাদিকতা চয়ে গেছে অতলে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকে যে মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে, তার সাহসিকতার প্রশংসা করছি। তার পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা এতোটা উদার নই। কিছুদিন পর এই নষ্ট সমাজের মানুষরা অন্যচোখে দেখবে মেয়েটিকে। বলবে, ওই দেখ ............ মেয়ে যায়।

সবচেয়ে মজার বিষয়, আমাদের গণমাধ্যম একটা বিষয় দৃশ্যত অন্ধভাবার চেষ্টা করেছে। তারা ভেবেছে, মেয়েটির সাক্ষাতকার নেয়া মানে নতুন নতুন তথ্য, নতুন মজমা। কিন্তু আসলে কি, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, গণমাধ্যমে যে তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়েছে, সেই তথ্যগুলোই এই ভিডিও কিংবা অডিওগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। তাহলে কেন আমাদের সরাসরি সাক্ষাতকারে এতো আগ্রহ? আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, মেয়েটি থানায় যে অভিযোগ করেছে, সেই তথ্যগুলোই তো সাক্ষাতকারগুলোতেও এসেছে, তাহলে কেন আমরা তার সরাসরি টেলিকাস্ট কিংবা কণ্ঠ প্রচারের আগ্রহী হলাম?

ভুক্তভোগীকে মেয়েটির ভবিষ্যৎ চিন্তা আমরা করিনি। আমরা আমাদের পাঠক-দর্শকদের কথা চিন্তা করেছি। আমরা আমাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখেছি। তাই হর হামেশায় ভিডিও-অডিও প্রচার করে গণমাধ্যমের স্বেচ্ছাচারিতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি।

মেয়েটি যদি স্বেচ্ছায় ভিডিও কিংবা অডিও প্রকাশে আগ্রহীও হয়, এরপরও বলবো আমাদের গণমাধ্যমের উচিত তা এড়িয়ে যাওয়া। কারণ, একটি আজকে যে ধর্ষিত মেয়ের সাক্ষাতকার তুলে ধরছি আগামীতে যে কোন মেয়ে ধর্ষিত হবে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে? আজ যে মেয়েটি ধর্ষিত হয়ে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, সেই সময় অন্যরা কি মুখ খুলবে তো?

আমি মনে করে, সমাজ-রাষ্ট্রের আলোক বর্তিকা হিসেবে গণমাধ্যমের আর একটু সচেতন হওয়া উচিত। আজ আমরা যে ভুল করেছি, সেই ভুলের মধ্যে দিয়ে কিছু শিক্ষা আমাদের মস্তিষ্কে থেকে যাক, যা দিয়ে ভবিষ্যৎ সময়গুলোতে পেশাদারিত্বের দক্ষতা নিরূপণ করতে পারি।

পরিশেষে, ধর্ষণ নিয়ে গণমাধ্যমের সার্বিক সচেতনতার জন্য সকল সহকর্মীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। একই সাথে গণমাধ্যমের ত্রুটি বা সমালোচনা করে আমাদের ভবিষ্যৎ ভালো করার সুযোগ তৈরি করে দিলেন, তাদেরকেও ধন্যবাদ জানাই।

এস এম নাদিম মাহমুদ, গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৪ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৫ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন