প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রেজা ঘটক | ১১ মে, ২০১৫
বাংলাদেশে যতগুলো ছাত্র সংগঠন আছে তার মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সবচেয়ে শান্তি প্রিয় একটি সংগঠন। এই সংগঠনের নামে ইতিহাসে কোনো সহিংস আচরন বাটি চালান দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন একটি নিরীহ সংগঠনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির উপর বাংলাদেশ পুলিশ যে বর্বর হামলা চালিয়েছে, তা কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এখন পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিসএসিতে নারীদের উপর যে যৌন নিপিড়নের ঘটনা ঘটে, তখনো সেখানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা লাঞ্ছনাকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। পুলিশের হাতে কয়েকজন লাঞ্ছনাকারীকে ধরে দিলেও, পুলিশ তখন তাদের ছেড়ে দিয়েছিল। তখন থেকেই সেই ঘটনার প্রতিবাদে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।
পুলিশের সেদিনের আচরন এবং এ আচরনের মধ্যে পার্কক্য হল, সেদিন পুলিশ ছিল নারীদের উপর যৌন নিপিড়ন দৃশ্যের একনিষ্ঠ দর্শক এবং ঘটনাস্থল থেকে নিপিড়কদের নির্বিঘ্নে চলে যাওয়ায় সহায়তাকারী বান্ধব। আর অদ্য সেই পুলিশ নিজেরাই নারীদের উপর নিপিড়ন চালিয়েছে। পহেলা বৈশাখের নারী লাঞ্ছনাকারীদের সঙ্গে এ পুলিশের অ্যাকশানের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।
বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। সংসদে প্রধান বিরোধীদলের নেতাও একজন নারী। বৃহত্তর বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাও একজন নারী। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী। বাংলাদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদ ও পদবিতে নারীদের অবস্থান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি অধীনে থাকা বাংলাদেশ পুলিশ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের উপর আজ যে বর্বর অসভ্যতা দেখিয়েছে, তা কোনো মতেই কেবল একটি ছাত্র সংগঠনের উপর হামলা নয়। অত্যন্ত শান্তি প্রিয় নিরীহ একটি ছাত্র সংগঠনের উপর পুলিশ যে আচরন করেছে, এটা গর্হিত অপরাধ। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এটা আইন শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী কর্তৃক সরাসরি আইন লংঘনের ঘটনা। এর দায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এড়াতে পারেন না।
নারীদের উপর যৌন নিপিড়নের বিচার চাইতে গিয়ে সেই নারীদের উপর পুলিশের বর্বর হামলাকে কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় আইনে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। যে সকল পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য এই ঘটনায় জড়িত, তাদের ছবিসহ নানান গণমাধ্যমে সেসব ফুটেজ প্রকাশ পেয়েছে। এদের খুঁজে পেতেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ ঘটনাকে কোনো জঙ্গি সংঘটনের হামলা হিসেবে চালিয়ে দেবারও কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ পুলিশ বিভিন্ন সময়ে জনসাধারণের উপর যে অন্যায় আচরন করে, এটা ওপেন সিকরেট হলেও প্রমাণিত সত্য। অথচ জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় এই পুলিশের বেতন দেওয়া হয়। যেখানে জনসাধারণের সেবা করাই পুলিশের কাজ, সেখানে পুলিশের নামে বাংলাদেশে প্রতিদিনই নানান কিসিমের অপরাধের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। বাংলাদেশে পুলিশ এখন একটি স্বীকৃত দুর্নীতিপরায়ণ সংগঠন। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করায় অভ্যস্থ যে সংগঠন, তার নাম বাংলাদেশ পুলিশ।
এই পুলিশ বাহিনীকেই কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রীয় সম্মানজনক স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা পদক পাওয়া একটি সংগঠনের সদস্যরা কিভাবে নারীদের উপর বর্বর হামলা করার দুঃসাহস পায়? এরা কারা? এদের পরিচয় আমরা জানতে চাই। এদের এখনই শুধু ডিপার্টমেন্টাল শাস্তির আওতায় আনলে হবে না, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের প্রচলিত আইনেই এদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। কারণ আমরা সবাই জানি, কাক কাকের মাংস খায় না। পুলিশ অন্য পুলিশের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তে সগোত্রীয় স্বজনপ্রীতি দোষে দুষ্ট থাকবে। তাই দেশের প্রচলিত আইনে এই অপরাধীদের বিচার করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পোষাক পরলেই একজন অপরাধী আইনের চোখে ছাড়া পাবার কোনো সুযোগ নেই।
পহেলা বৈশাখের নারী নিপিড়নের ঘটনায় শুরু থেকেই পুলিশ এক মহা-রহস্যময় আচরন করছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কোনো একটি সুনির্দিষ্ট পক্ষকে রেহাই দিতেই পুলিশ এই টালবাহানা করছে। যে কারণে আজ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে, পুলিশ সেই অপরাধীপক্ষকে বাঁচাতেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিচার চাওয়া পক্ষের উপর বর্বর হামলা চালিয়েছে। যা একটি রাষ্ট্রে কোনো ভাবেই মেনে নেবার সুযোগ নেই। বিচারহীনতার যে রাজনীতি বাংলাদেশে শুরু হয়েছে, তা যদি এভাবে বিচার চাওয়া পক্ষকে হামলা করে নস্যাত করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো দেশের সাধারণ মানুষ কোনো অপরাধের বিচার চাইতেই আর সাহস দেখাবে না বা উৎসাহী হবে না।
এমনিতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পারতপক্ষে কোনো ঘটনা পুলিশ পর্যন্ত না নিয়েই মিটিয়ে ফেলতে চায়। কারণ পুলিশের আচরন সম্পর্কে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ অবগত। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা, এটা মোটেও রূপকথা নয়, বাংলাদেশের মানুষ বছর বছর পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে এই পুলিশ বর্জন নীতিতে উপনীত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, তাহলে এই পুলিশ তাহলে রাষ্ট্রে কার সেবা দিতে প্রয়োজন? অবশ্যই শাসকদের আদেশ-নির্দেশ আর তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এই পুলিশের একমাত্র কাজ বলেই এখন স্বীকৃত। জনসাধারণের কোনো কাজে এই পুলিশকে কখনোই সক্রিয় দেখা যায় না।
এই পুলিশের সামনেই বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে সন্ত্রাসীরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আহত করেছে অভিজিতের স্ত্রী লেখক বন্যা আহমদকে। সেই ঘটনায় পুলিশ নিরব দর্শক ছিল। রাস্তায় পুলিশের সামনে কোনো ছিনতাই ঘটনা ঘটলে এই পুলিশ বরাবরই নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। কেবল প্রধানমন্ত্রী যখন রাস্তা দিয়ে চলাচল করেন, তখন এই পুলিশকে আমরা সব সময় সক্রিয় দেখি। এই পুলিশ বাহিনী যদি শুধু প্রধানমন্ত্রীর চলাচল নির্বিঘ্নে করার জন্য প্রয়োজন হয়, তাহলে এই পুলিশ মোটেও জনগণের পুলিশ নয়। এটি প্রধানমন্ত্রীর একটি নিরাপত্তা বাহিনী।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা পালনকারী পুলিশ যখন প্রকাশ্যে রাস্তায় নারীদের উপর বর্বর হামলা করে, তখন একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই ঘটনাকে আড়াল করার বা সেই দায় এড়ানোরও কোনো সুযোগ নেই। পহেলা বৈশাখের নারী লাঞ্চনার ঘটনাকে চাপা দিতেই পুলিশ আজ এই বর্বর হামলা করেছে। এটাকে যদি রাষ্ট্র নিরবে হজম করার চেষ্টা করে, তাহলে বাংলাদেশের সামনে কঠিন অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার অধীনে থাকা একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী এভাবে প্রকাশ্যে অপরাধ করে ছাড়া পেতে পারে না। আর যদি এই বাহিনী কোনো সুনির্দিষ্ট অপরাধীকে বাঁচানোর কৌশল হিসেবে এই নির্যাতন ও হামলার পরিকল্পনা করে থাকে, তাহলে সেই অপরাধীদের অপরাধকে বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেবার সামিল হবে সেটা। যা একুশ শতকের সভ্যতায় একটি রাষ্ট্রে কোনোভাবেই ঘটতে দেওয়া উচিত নয়। পুলিশ কখনোই জনগণের বন্ধু ছিল না, এখনো নাই। বরং পুলিশ জনগণের দুর্ভোগ বাড়ানোর একটি রাষ্ট্রীয় হাতিয়ার। এটা বন্ধ না করলে এই রাষ্ট্র সভ্যতার দিকে অগ্রসর না হয়ে বরং মধ্যযুগীয় বর্বরতার দিকেই ধাবিত হবে।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া আর কোনো সংগঠন পহেলা বৈশাখে নারীদের উপর নির্যাতনের বিচার নিয়ে মাঠে নেই। তাই সরকার বাহাদুর যদি মনে করে, ওদের পিটিয়ে রাস্তা দিয়ে হটিয়ে দিলেই মামলা খালাস, তাহলে তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্যই বুমেরাং হবে। দেশের যে কোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক সভা-সমাবেশে নারীদের নিরাপত্তা আরো হুমকির মুখে পড়বে।
বিষয়টিকে মোটেও হালকা করে দেখার সুযোগ নাই। বাংলাদেশের পুলিশের সকল দায় দায়িত্ব এককথায় প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। বিষয়টি নিয়ে যদি এখনই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সজাগ না হন, তাহলে আগামীতে এই পুলিশের সামনেই আরো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটাতে অপরাধীরা প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। যা সভ্য সমাজে মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আমরা মনে করি, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি পহেলা বৈশাখে সংঘটিত নারীদের উপর যৌন নিপিড়নের ঘটনারও যথাযথ বিচার করতে হবে এবং অপরাধীদের দৃষ্টন্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি বা দলীয়প্রীতি বা চেপে যাওয়ার প্রবনথা বরং এই ঘটনাকে ভবিষ্যতে আরো বাড়তে দেয়ারই সামিল। যা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
১০ মে ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের উপর পুলিশের বর্বর হামলার জন্য তীব্র ধীক্কার ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর অধীনে থাকা পুলিশ বাহিনীর এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিচার বিভগীয় তদন্ত ও এই ঘটনায় জড়িত অপরাধী পুলিশ সদস্যের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রার্থনা করছি। আমরা নিশ্চয়ই কোনো পুলিশি রাষ্ট্রে বসবাস করছি না যে, পুলিশের অপরাধের জন্য বা তাদের ভুল কর্মকাণ্ডের জন্য বিচার চাওয়া যাবে না। আমরা আশা করব, শীঘ্রই এই ঘটনার একটি গঠনমূলক সমাধান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পালিত হবে।
সবাই পুলিশ থেকে দূরে থাকুন। নিজের সম্মান নিজের কাছে রাখুন। মনে রাখবেন, পুলিশ কখনোই বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রে জনগণের বন্ধু নয়। যদিও আমাদের ট্যাক্সের পয়সায়ই পুলিশের বেতন হয়। তবুও পুলিশ থেকে সাবধান!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য