প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ০৬ আগস্ট, ২০১৭
সম্প্রতি ধর্ষণ যেন বাংলাদেশে এক মহামারি আকার ধারণ করেছে। এমন কোনও দিন বাদ যায়নি যেদিন সংবাদপত্রে ৪-৫টি ধর্ষণের ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়নি। বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনার খবরই সংবাদপত্রে আসে না। সামাজিক মর্যাদাহানিসহ বিভিন্ন কারণে ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়া হয়। আর সংবাদপত্রে যেসব ঘটনা প্রকাশিত হয়, তাও এখানে সীমাবদ্ধ থাকে। হয়তো বড়জোর মামলা হয়। কিন্তু এসব মামলার নিষ্পত্তি হয় খুবই কম। আর বিচার, সাজা? এমন রেকর্ড খুবই কম!
কয়েকটি ঘটনার দিক চোখ বুলানো যাক। টাঙ্গাইলের সখীপুরে এক কলেজছাত্রীকে প্রায় সাত মাস আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। দূর সম্পর্কের চাচা বাদল ওরফে বাদল বাবু পূর্ব পরিকল্পিতভাবে গত ১১ জানুয়ারি ভাতিজি কলেজছাত্রীকে (১৭) ফুসলিয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায়। পরিবারের লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ওই কলেজ ছাত্রীর কোনও খোঁজ পাননি। অবশেষে গত রবিবার বিকেলে দীর্ঘ ৬ মাস ১৭ দিন পর রতনপুর কাশেম বাজার এলাকায় চাচা বাদল মিয়ার পরিত্যক্ত ঘর থেকে ওই ছাত্রীকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে এলাকাবাসী। আটক রাখা অবস্থায় ওই ছাত্রীকে ঘুমের ওষুধ ও যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট সেবন করিয়ে ধর্ষণ করে আসছিল বাদল মিয়া (ইত্তেফাক, ৫ আগস্ট)।
সিদ্ধিরগঞ্জে ট্রাক থেকে উদ্ধার কিশোরীকে ৬ বার ধর্ষণ করে চালক ও হেলপার। চালক যখন ধর্ষণ করে তখন হেলপার ট্রাক চালায়। আর হেলপার যখন ধর্ষণ করে তখন ট্রাক চালায় চালক। এভাবেই কিশোরীকে গাজীপুর থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ আনতে ৬ বার ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বরাত দিয়ে পুলিশ এ কথা জানিয়েছে (যুগান্তর, ৪ আগস্ট)৷
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় বিয়ের প্রলোভনে এক স্বামী পরিত্যক্ত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। সেই সঙ্গে ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নির্যাতিত ওই নারী (জাগোনিউজ২৪ডটকম, ৪ আগস্ট)।
কিশোরগঞ্জে ‘স্ত্রী যেতে বলেছে’ বলে বাসায় ডেকে এনে নিজের স্কুলের সাবেক এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে প্রধান শিক্ষক (জাগোনিউজ২৪ডটকম, ৩ আগস্ট)।
রাজশাহীতে ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে যায়। ওই শিক্ষক ছাত্রীটিকে দুপুরের খাবারের প্রস্তাব দিয়ে একটি গাড়িতে উঠিয়ে একটি গেস্টহাউসে হাউসে নিয়ে যান। সেখানে একটি কক্ষে আটকে রেখে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করে (প্রথম আলো, ২ আগস্ট)।
খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে রাজধানীর বাড্ডায় তিন বছরের শিশু তানহাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে শিপন। এরপর সে লাশটি তানহাদের ভাড়া বাড়ির শৌচাগারে ফেলে যায় (প্রথম আলো, ৩১ জুলাই)।
খবরগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। সব ক্ষেত্রেই এক শ্রেণির পুরুষ গায়ের জোরে অথবা প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ধর্ষণের ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, এত এত ধর্ষণ, অবিচার, অথচ এ ব্যাপারে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তেমন কোনও উদ্বেগ নেই। নেই কোনও বিশেষ উদ্যোগ। যেন মেয়েদের ধর্ষণ কোনও আলাদা তাৎপর্য বহন করে না। যেন এটা প্রতিবাদের যোগ্য কোনও বিষয় নয়!
ধর্ষণ ঘৃণ্য অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অথচ আমাদের দেশে এই ঘৃণ্য অপরাধটাই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই, নেই বিশেষ কোনও আইনি ব্যবস্থা। এই সামগ্রিক উদাসীনতার সুযোগে ধর্ষকরাও যেন আদা-জল খেয়ে নেমেছে। বাদ যাচ্ছে না চার বছরের শিশুও।
এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে, সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের অন্তত রুখে দাঁড়ানোর কথা। প্রতিবাদ করার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তারাও এই ধর্ষণের মচ্ছবে তাল মেলাচ্ছেন। নিজেরাই ধর্ষক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। মাত্র কয়েকদিন আগে বরিশালে এক ছাত্রলীগ নেতা স্বামীকে বেঁধে তার নববধূকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছে। এ ঘটনায় সারাদেশে সমালোচনার ঝড় উঠলেও দল থেকে বহিষ্কার করে দায় এড়িয়ে গেছে ছাত্রলীগ। এর কয়েকদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। আর সর্বশেষ বগুড়ায় তুফান সরকার নামে এক শ্রমিকলীগ নেতা কর্তৃক এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর ওই মেয়ে ও তার মাকে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতনের পর তাদের মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে।
বগুড়ার শ্রমিক লীগের তুফান সরকার আসলেই এক মস্ত বড় সুনামি! সেই তো আসল ‘পুরুষ’, তার স্ত্রী আশা, স্ত্রীর বড় বোন পৌরসভার কাউন্সিলর রুমকি, শ্যালিকা মর্জিয়া, শাশুড়ি ও ক্যাডার এই বিশাল বাহিনী মিলে অসহায় কিশোরীকে ধর্ষণ করে, মারধর করে, জুলুম নির্যাতন করে মা-মেয়েকে মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে! এ আমরা কোন সমাজে বসবাস করছি যেখানে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল, যুবদল মিলে পূর্ণিমা শীলদের ধর্ষণ করে, ঘরবাড়ি ছাড়া করে, খুন-জখম-জুলুম নির্যাতন করে। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও তাদের সহযোগী সংগঠন একই কাজ করে! এসবের প্রতিকার কি কোনোদিনই হবে না?
তনু-মিতু-তানহাসহ আরও অসংখ্য ধর্ষণের শিকার নারীর কান্না আকাশে বাতাসে হাহাকার করে আর আমরা উন্নয়নের ঢেকুর তুলি!
এই বাংলাদেশ আমরা চাই না। প্রতিনিয়ত এদেশের মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হবে আর আমরা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-উন্নয়নের বড়াই করবো, তা হতে পারে না, হতে দেয়া যায় না। এমন দেশের জন্য একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আত্মদান করেননি!
আমরা চাই অবিলম্বে ধর্ষণের ‘তুফান মেইল’ বন্ধ হোক। সরকারের প্রথম এবং প্রধান এজেন্ডা হোক দেশ থেকে ধর্ষণ বন্ধ করা। এ জন্য যদি সরকারকে কঠোর হতে হয় তবে তাই হতে হবে। একটা চরম ঘৃণ্য সামাজিক অপরাধ বন্ধ করতে সরকার যদি উদ্যোগী হয়, তাহলে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষ নিশ্চয়ই সরকারের পাশে থাকবে!
(কৃতজ্ঞতা: আমার রাজনৈতিক সতীর্থ ডাকসুর সাবেক বিজ্ঞান-মিলনায়তন সম্পাদক মো. আবু আলী)
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য