প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ | ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে বার্ধক্যের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে থাকে। চিকিৎসা ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি, মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন- ইত্যাদির ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। বাংলাদেশেও যার ফলশ্রুতিতে গত ৩০ বছরে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে এবং বাড়ছে।
এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি প্রবীণ জনগোষ্ঠী রয়েছেন। ২০৫০ সালে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা হবে ৯.৬ বিলিয়ন যার মধ্যে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা হবে ২ বিলিয়ন!
প্রবীণ ব্যক্তির এই সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রবীণ ব্যক্তিদের নানাবিধ সমস্যাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ, মানবদেহে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। এই সমস্যাগুলো মূলত ২ প্রকার- মাস্কুলোস্কেলেটাল ও নিউরোলজিক্যাল। মোটা দাগে এগুলোকে ডিজেনেরেটিভ পরিবর্তন বলে।
মাস্কুলোস্কেলেটাল সমস্যার অর্থ হচ্ছে- মাংসপেশি ও হাড় সম্পর্কিত সমস্যা। বয়স্ক ব্যক্তিদের বিভিন্ন অস্থি সম্পর্কিত সমস্যা যেমন- অষ্টিও আরথ্রাইটিস, ফ্রাকচার, জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট, অষ্টিওপোরোসিস, স্পন্ডিলাইটিস ইত্যাদিতে ফিজিওথেরাপিস্টগণ সর্বাধিক ভূমিকা রাখতে পারেন। ব্যথা উপশম, মাংসপেশির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফিজিওথেরাপি সর্বাধিক কার্যকর।
অন্যদিকে প্রবীণ ব্যক্তিদের বিভিন্ন সফট টিস্যু সমস্যার মধ্যে রয়েছে ফ্রোজেন সোল্ডার, টেন্ডিনাইটিস, বার্সাইটিস প্রভৃতি। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার বিভিন্ন আডভান্স টেকনিক, যেমন- স্ট্রেচিং, স্ট্রেদেনিং, মাসেল রিহ্যাব প্রভৃতির মাধ্যমে একজন প্রবীণ ব্যক্তি তার বয়সজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন।
প্রবীণদের অন্যতম প্রধান আরেকটি শারীরিক সমস্যা হলো নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়ুবিক সমস্যা। এর মধ্যে প্রধান হলো- স্ট্রোক। পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ স্ট্রোক-জনিত বিকলাঙ্গতার শিকার হন। স্ট্রোক-পরবর্তী চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে বর্তমানে বিভিন্ন আডভান্স ফিজিওথেরাপি টেকনিক,যেমন- বোবাথ, কার এন্ড শেফার্ড, পি এন এফ অ্যাপোচ ব্যবহার করা হচ্ছে। এইগুলো বিজ্ঞানসম্মত ও গবেষণালব্ধ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যবস্থা। স্ট্রোক ছাড়াও পারকিনসন্স ডিজিজ, এম এন ডি, এ্যটাক্সিয়া, নার্ভ ডিমায়ালিনাসনে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অত্যন্ত কার্যকর ও ফলপ্রসূ।
অবিসিটি বা স্থূলতা প্রবীণ ব্যক্তিদের একটি বহুল সমস্যা। স্থূলতা অন্যান্য রোগ ও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি স্থূলতা প্রশমনে ও শারীরিক ফিটনেস আনয়নে ফিজিওথেরাপির ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, মাংসপেশি ও জয়েন্টের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার ধরণ পরিবর্তনে প্রবীণ ব্যক্তিদের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা কার্যকর বটে।
যেহেতু, বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশে প্রবীণ ব্যক্তিদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে ও প্রবীণ ব্যক্তিদের সমস্যার মাত্রা ও ধরণ পাল্টাচ্ছে; সুতরাং, এক বিশাল জনসংখ্যার ব্যথাহীন, সুস্থ ও সচলক্ষম জনগোষ্ঠী পেতে চাইলে এখন থেকেই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) বার্ধক্য বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবীণদের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, তাদের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়। একজন ফিজিওথেরাপিস্টই পারে ঔষধবিহীন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এক্সারসাইজ ও পরামর্শের মাধ্যমে একজন প্রবীণ ব্যক্তির সর্বোচ্চ কার্যক্ষমতা আনয়নে, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে। কারণ সচল প্রবীণই প্রমাণ করতে পারেন- তার বয়সের সাথে প্রাণ জুড়ে গেছে!
৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি এসোসিয়েশন (বিপিএ) কর্তৃক দিবসটি যথাযথ মর্যাদার সাথে পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য : Physical Activity for Life "সুস্থতার জন্য শারীরিক সচলতা"।
ইতোমধ্যেই দিবসটি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ফিজিওথেরাপি কলেজগুলোতে সচেতনতামূলক পোষ্টার ও ব্যানার দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)-এর তথ্যমতে বিশ্বে প্রতিবছর ৬০ লাখ মানুষ স্ট্রোকে মারা যায়। এর ফলে ৫০ লাখ মানুষ করছে পঙ্গুত্ববরণ। মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব না হলেও ফিজিওথেরাপি নিয়ে বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জীবনে গতিশীলতা আনা সম্ভব।
বিশ্বের ১৩৭টি দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ)পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০১ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ল্যনসেট এর গবেষণায় দেখা গেছে,বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে, ফলে বেড়ে যাচ্ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে ৬০ বছরের বেশি বয়সী ২শ’ কোটি ও ৮০ বছরের বেশি ৪০ কোটি মানুষ হবে। যাদের বেশিরভাগই স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া ও পড়ে যাওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন।
প্রতিবছর স্ট্রোকে ৬০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। পঙ্গু হচ্ছে আরও ৫০ লাখ মানুষ। ফিজিওথেরাপি নেয়ার মাধ্যমে পঙ্গু জনগোষ্ঠীর জীবনে গতিশীলতা ও তাদের বিছানায় পড়ে থাকা জীবনে প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ থেরাপি নিয়ে প্রতিবছর ১ কোটি ডিমেনশিয়া রোগী সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। ৩২ শতাংশ বয়স্ক মানুষ পড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপি গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে ২০৫০ সাল নাগাদ ফিজিওথেরাপি রোগীর সংখ্যা ৩শ’ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, "ফিজিওথেরাপি একটি বিজ্ঞানসম্মত, গবেষণালব্ধ এবং বিশেষায়িত চিকিৎসা পেশা। বাত, ব্যথা, খেলাধুলাজনিত আঘাত, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন ধরনের প্যারালাইসিস, প্রতিবন্ধী শিশু এবং পক্ষাঘাতগ্রস্তসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ফিজিওথেরাপি একটি অপরিহার্য চিকিৎসা পদ্ধতি। "
মূলত, ফিজিওথেরাপি একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীকে পরীক্ষা করে, রোগ নির্ণয় করে, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রদান করেন এবং বিভিন্ন ফিজিক্যাল মেথডের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ, প্রতিকার, পুনর্বাসনসহ স্বাস্থ্যসেবার বিশাল অংশজুড়ে চিকিৎসা-পেশাজীবী হিসেবে কাজ করে।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা-পদ্ধতি হলো- ম্যানুয়াল থেরাপি, মাংসপেশির সঞ্চারণ বৃদ্ধি, অ্যাক্টিভ এক্সারসাইজ, ইলেক্ট্রোথেরাপি, ক্রায়োথেরাপি, টেপিং, ড্রাই নিডলিংসহ নানা প্রকার গবেষণালব্ধ চিকিৎসা যার মাধ্যমে ঔষধবিহীনভাবে ব্যথা, অক্ষমতা, পক্ষাঘাত অথবা সার্জারি ছাড়াই বহু সমস্যার আধুনিক চিকিৎসা করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৮০০ ফিজিওথেরাপিস্ট আছেন যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিওথেরাপিতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, পুনর্বাসন কেন্দ্র, চেম্বার ও অন্যান্য এনজিওতে কাজ করছেন।
ফিজিওথেরাপি এর মূল উদ্দেশ্য হলো,দুর্বল মাংস পেশীকে শক্তিশালী করে দেহের সাধারণ এ্যালাইমেন্ট ঠিক রেখে যথাযথ ভাবে মুভমেন্ট করা এবং কিছু সহায়ক উপকরণ প্রদান করে শরীরকে কর্মক্ষম রাখা। সাধারণত স্ট্রোক পরবর্তী প্যারালাইসিস, গাছ থেকে পড়ে যাওয়া অথবা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হওয়া spinal cord injury রোগীদের ফিজিওথেরাপি সেবা অনেক গুরুত্ব বহন করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাঁটু, কোমর, ঘাড়, কাঁধে ব্যথা অনুভূত হয়। এই ব্যথা প্রতিরোধে ফিজিওথেরাপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সময়ের সাথে সংগতি রেখে এবং সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তায় ফিজিওথেরাপি সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। একই সাথে ফিজিওথেরাপিস্টদের দায়িত্বশীলতার জায়গাটি স্বচ্ছ হওয়া আবশ্যক। প্রচলিত ধারার চিকিৎসার পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি অর্ন্তভুক্তকরণের মাধ্যমে অনেক জটিল রোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব। অনেকাংশে সুস্থ থাকাও সম্ভব। সম্ভাবনার এই দ্বার আরও প্রসারিত হোক।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য