টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এনামুল হক এনাম | ০৯ এপ্রিল, ২০১৮
আজকে কী রান্না করেছেন?
মাংস?
রেসিপিতে মূল উপাদান কী ছিলো?
তেল, মরিচ, মশলা যাই দেন না কেন... আপনার মাংস রেসিপির মূল উপাদান কিন্তু মাংস, লবণ আর আগুন।
ঠিক একইভাবে যদি কেউ জিজ্ঞাস করে, ইউনিভার্সের রেসিপি কী?
রান্নাঘরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা ইউনিভার্স তৈরি করতে হলে আপনার কী প্রয়োজন?
চলুন মাস্টার শেফ “স্টিফেন হকিং”-এর সাথে "কসমিক কুক বুক" খুলি... দেখি কী লাগবে ইউনিভার্স রান্না করতে?
ম্যাটার বা পদার্থ হলো আপনার আশপাশের সবকিছু, বালুকণা থেকে শুরু করে পাহাড় পর্বত, আমাদের শরীরের প্রত্যেকটি কোষ থেকে দূরদূরান্তের গ্রহ-নক্ষত্র যেখানে লক্ষ কোটি সূর্য- সৌরমণ্ডল, গ্যাস, পানি... সবকিছুই পদার্থ বা পদার্থের যৌগ। মহাবিস্ফোরণের ফলে সম্প্রসারিত হতে থাকা, ছড়িতে ছিটিয়ে দূরে সরে যেতে থাকা প্রত্যেকটি অনুই রয়ে গেছে এই মহাজাগতিক মণ্ডলে। আমাদের আশপাশে থাকা প্রত্যেকটি পদার্থ, যা কিছু দেখছি দৃষ্টি সীমার মধ্যে, এমনকি এই শরীরে থাকা প্রত্যেকটি কণাও সেই আদি বিস্ফোরণের পরিবর্তিত রূপ।
শক্তি, না দেখলেও আমরা জানি শক্তি কী। আমরা শক্তিতে অনুভব করি, কখনো শক্তির সাংঘর্ষিক রূপ দেখি। সূর্যপানে যখন আমরা তাকাই, তখনও আমরা শক্তি অনুভব করি... দূরের একটি নক্ষত্র যে কিনা ৯৩ মিলিয়ন মাইল থেকে আগুনে পুড়ছে, তা আমরা পৃথিবীতে বসেও বুঝতে পারি। শক্তির কার্যকর ভূমিকার ফলেই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি এবং শক্তি আবহেই তা নিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে সীমাহীন পরিবর্তনশীল মণ্ডলে।
স্পেস বা জায়গা বা মহাশূন্য আমাদের তৃতীয় উপাদান। পদার্থ এবং শক্তির সমন্বিত বিস্ফোরণের ফলে উৎপন্ন “ফলাফল” বা “কর্মযজ্ঞ” ছড়িয়ে দেবার জন্য আমাদের প্রয়োজন সীমাহীন জায়গা। সীমাহীন জায়গা মানে সীমাহীন, অসীম... যার শেষ হওয়া সম্ভব নয়, চারপাশে প্রসারণের অনন্ত জায়গা।
এখন প্রশ্ন হলো, কোথায় থেকে এই পদার্থ, শক্তি এবং জায়গা এল?
উনিশ শতকের শুরুর দিকেও আমাদের ধারণা ছিলো না এইসবের উৎপত্তির কারণ! মানুষ ধরেই নিয়েছিলো, সৃষ্টি রহস্যের এই অধ্যায় কখনোই ভেদ করা সম্ভব নয়। কিন্তু একজন করলেন। উত্তর খুঁজলেন নিজের বিশ্লেষণ করা তত্ত্বে। সম্ভবত এ যাবৎকালে যতজন বিজ্ঞানী জন্ম নিয়েছেন তাদের মধ্যে সেরা... আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইনই প্রথম অনুধাবন করেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা ইউনিভার্স তৈরি করতে প্রয়োজন যে তিনটি উপাদান দরকার তার মধ্যে ভরযুক্ত পদার্থ এবং শক্তি মূলত একই জিনিষ... শক্তি এবং পদার্থ বলে আলাদা কিছু নেই তা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তাঁর সেই বিখ্যাত আবিষ্কার E = mc2 ই আমাদের বলে দেয় ভর এবং শক্তির এই সম্পর্কের কথা। ভরযুক্ত পদার্থই শক্তির আধার।
এই সূত্র ধরে আমরা সহজেই বলতে পারি, ইউনিভার্স তৈরির উপাদান তিনটি নয়, মূলত দুইটি। শক্তি এবং জায়গা বা মহাশূন্য (এনার্জি এবং স্পেস)।
তাহলে শক্তি এবং জায়গা এর উৎপত্তিস্থল কোথায়?
এটা হয়তো গত শতাব্দীতে পদার্থে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল। শত শত বিজ্ঞানী, গবেষক দিবারাত্রি পরিশ্রম করে গেছেন এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে। তাদেরই অবদানের কারণের আজ আমরা জানি শক্তি এবং জায়গা (এনার্জি এবং স্পেস) এর মূল উৎপত্তিস্থল “বিগ ব্যাং” বা মহাবিস্ফোরণ। বিগ ব্যাং এর পরেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শক্তি বা ভরের উৎপত্তি ঘটে যা বিলিয়ন বছরে সম্প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে গেছে সীমাহীন জায়গায়। এসব উপাদানই একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কযুক্ত।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে কে তৈরি করেছে এই এনার্জি এবং স্পেস বা শক্তি এবং জায়গা?
আসলেই কে?
মানুষ যে প্রশ্নের উত্তর জানে না, বা যে রহস্যের সমাধান করতে পারে না... সেই রহস্যের পেছনে অদৃশ্য শক্তি সৃষ্টিকর্তা আছেন বলে দাবি করে। কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়টিকে এত সহজে সমাধান দেয় না। বিশ্লেষণ ছাড়া ব্যাখ্যা, কিংবা প্রমাণ ছাড়া তথ্য বিজ্ঞান দেয় না। এটা বিজ্ঞানের চরিত্র নয়।
এককালে মানুষ যখন জানতো না কিভাবে বৃষ্টি হয়, তখন সে ধরেই নিয়েছিলো... আকাশের ওপারে একজন অদৃশ্য কেউ বসে আছেন, যখন প্রয়োজন তখন তিনি আসমান থেকে পানি ঢালেন। তারা এই ব্যক্তিকে চিনতো বৃষ্টির দেবতা হিসেবে। প্রাচীন গ্রন্থ ঘাঁটলে দেখা যায় সেখানে বৃষ্টি দেবতাকে খুশি করার জন্য অসংখ্য শ্লোক রচনা করা হয়েছে। কারণ কৃষি নির্ভর আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রের অতীতের পুরো অর্থনীতিই ছিলো বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল।
কিন্তু মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতি করেছে, এখন আমরা জানি বৃষ্টি দেবতা বলে কেউ নেই। জলাশয় থেকে সূর্যের আলোর তাপে পানি বাষ্প হয়ে আকাশে উঠে এবং সেখানে অবস্থান করে এবং একসময় বাষ্পগুলো ভারি হয়ে গেলে বৃষ্টি আকারে তা মাটিতে নেমে আসে... এটা একটি চক্র, বৃষ্টি চক্র। এখানে কোন দেবতার প্রয়োজন নেই। আজকাল মানুষ আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ইচ্ছে করলেই এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
একইভাবে ঝড়, তুফান, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণসহ যা কিছু মানুষ ব্যাখ্যা করতে পারতো না... তা নিয়ে অলৌকিক সব তথ্য প্রচার করতো, সব অলৌকিক কাজের পেছনে এক একজন দেবতাকে দাঁড় করিয়ে দিত। তার পূজা করতো। এককথায় বলা যায়, মানুষের অজ্ঞতাই মানুষকে নত করেছে দেবতার সামনে।
বিং ব্যাং এর পূর্বে নিশ্চয়ই কিছু ছিলো! না থাকলে বিগ ব্যাং এর সৃষ্টি হল কিভাবে!!!
প্রশ্ন যেখানে থাকবে, উত্তরও নিশ্চয়ই সেখানে থাকবে। রহস্য থাকলে সমাধান হবে, সমাধানের জন্য চর্চা হবে।
সামথিং আউট অব নাথিং!!
বিগ ব্যাং পরবর্তী সময়ে মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়া ম্যাটার বা পদার্থের সাথে আরেকটি উপাদানের উৎপত্তি হয়েছিল, “এন্টি-ম্যাটার”। ম্যাটার যদি ধনাত্মক বা পজিটিভ শক্তি হয় তবে এন্টি-ম্যাটার একটি ঋণাত্মক শক্তি।
সহজে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। ধরুন আপনি একটি টিলা বানাবেন, গর্ত খুঁড়ে একপাশে মাটি একত্রে রাখতে শুরু করলেন। ধরুন, ২০ ফুট বাই ২০ফুট একটি টিলা তৈরি করবেন। মাটি খুড়তে শুরু করলেন এবং টিলা একসময় তৈরি হয়ে গেল। তখন আপনার সামনে থাকবে ২০ফুটx২০ফুটের একটি টিলা, এবং পাশেই থাকবে ২০ফুটx২০ফুট একটি পুকুর। ১সেন্টিমিটার কম নয়... বেশিও নয়। অর্থাৎ টিলাটি যদি ধনাত্মক শক্তি হয় তবে একই পরিমাণ ঋণাত্মক শক্তি হল পুকুর! সত্যিকার অর্থে আপনি শুধু একটি টিলাই তৈরি করেননি, একই সাথে গর্ত বা পুকুরও তৈরি করেছেন। পারফেক্ট ব্যালেন্স নেগেটিভ এনার্জির পুকুর!
একইভাবে আমরা বিগ ব্যাংকে বিশ্লেষণ করতে পারি। বিগ ব্যাং এর পর যতটুকু পজিটিভ এনার্জি তৈরি হয়েছিল, একই পরিমাণ নেগেটিভ এনার্জিও তৈরি হয়েছে। আমাদের আশপাশের যা কিছু দেখছি তা যদি বিং ব্যাং এরপর সৃষ্ট পজিটিভ বা ধনাত্মক “ম্যাটার” হয়, তবে একই পরিমাণ নেগেটিভ বা ঋণাত্মক এন্টি-ম্যাটার নিশ্চয়ই আছে!
থাকলে সেটি কোথায়।
টিলাটি তৈরি করার পর যেভাবে পুকুরটি পাশেই ছিলো, ঠিক একইভাবে ম্যাটারের সাথে এন্টি-ম্যাটারও আছে আমাদের এই ইউনিভার্সেই, স্পেসে ছড়ানো। অর্থাৎ বিগ ব্যাং এর পর এই ইউনিভার্সেই একই পরিমাণ শক্তি ট্র্যাপ্টড বা বন্দি হয়ে আছে। পুরো স্পেসটাই একটি নেগেটিভ এনার্জির আধার। একই পরিমাণ ম্যাটার এবং এন্টি ম্যাটার এই একই ইউনিভার্সে! আর সূত্র অনুযায়ি আমরা জানি, সমপরিমাণ বিপরীত শক্তির ফলাফল শূন্য! গাণিতিকভাবে তাই প্রমাণিত হয়। সমপরিমাণ পজিটিভ এবং নেগেটিভ এনার্জি নিয়ে বিশাল স্পেসে সুষম ভারসাম্যে এই ইউনিভার্স প্রতি নিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। আপনি বলতে পারেন এই বিশাল ইউনিভার্স একটি বিশাল নেগেটিভ এনার্জির ব্যাটারি।
প্রশ্ন আসতে পারে, এই যে এত কথা, এত বর্ণনা, সবই মেনে নিলাম... কিন্তু বিগ ব্যাং এ ট্রিগারিং ফ্যাক্টর কী ছিলো? এমনি এমনিই তো আর এনার্জি মহাবিস্ফোরণে ইউনিভার্সে ছড়িয়ে যায়নি।
এই মুহূর্তে এককাপ কফি হাতে নিয়ে যখন আপনি বিষয়টি ভাবছেন, তখন চলুন আপনার কফির ভেতরে যাই। এই কফি তৈরি করতে আপনার পানি লেগেছে, কফি বিনস লেগেছে, দুধ লেগেছে, চিনি লেগেছে... সব মিশিয়ে আপনি কফি বানিয়ে আরাম করে খাচ্ছেন। চলুন কফির সবগুলো উপাদান আলাদা করে ফেলি। যেকোনো একটি উপাদানে মনোনিবেশ করি, ঐ উপাদানের এটমিক লেবেলে যাই, আরও ভেতরে প্রবেশ করি... সাব-এটমিক লেবেলে যাই, যেখানে আমরা পাবো এমন একটি জগত যেখানে আমাদের চারপাশে দেখা প্রাকৃতিক নিয়ম সেখানে অচল। সেই সাব-এটমিক লেবেল ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখবো “সামথিং আউট অব নাথিং” খুবই সম্ভব একটি বিষয়। এই লেবেলে প্রোটন পার্টিকেল কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মে আচরণ করে। রান্ডমলি একাধিক স্থানে স্থান দখল করে আবার আপনা-আপনিতেই মিলিয়ে যায়।
ব্যাপারটি যত সহজ ভাবছেন তত সহজ নয়। ভোজবাজির মত নিউক্লিয়াসের শক্তির আধারে প্রোটন আবির্ভাব হচ্ছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির নিয়মে যদি তা হওয়া সম্ভব হয় তবে বিগ ব্যাং ও একই নিয়মে আবির্ভাব হয়েছে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
আপনাদের যাদের খটকা থেকেই গেল, তাদের জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, বিষয়টা কোয়ান্টাম মেকানিক্সে প্রমাণিত।
এখানে আবার প্রশ্ন থেকে যেতে পারে, তবে কে কোয়ান্টাম ল তৈরি করেছেন?
উত্তরটা স্টিফেন হকিং সুন্দর করে দিয়েছেন, “আমি কাউকে আঘাত করতে চাই না, কাউকে দুঃখও দিতে চাই না, প্রাকৃতিক নিয়ম তৈরির জন্য কোন কর্তার প্রয়োজন নেই।“
মহাজাগতিক রসুই ঘরের খুঁটিনাটি, প্রত্যেকটি উপাদান নিয়ে মানুষ গবেষণা করছে। থেমে নেই বিজ্ঞানীরা। প্রাকৃতিক নিয়ম দিয়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু ব্যবহারিক বিজ্ঞান খুঁজে প্রমাণ। তাই চলছে গবেষণা। গত পঞ্চাশ বছরে বিজ্ঞান যেভাবে এগিয়েছে, আগামীতে কি হবে ধারণা করাই মুস্কিল! আপনার রান্নাঘর আর ইউনিভার্স... কিছু বিজ্ঞানের বাইরে নয়।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য