প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রণেশ মৈত্র | ২৬ জানুয়ারী, ২০১৯
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারংবার বলছেন, দুর্নীতির সাথে ‘নো কম্প্রোমাইজ’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তাঁর কথার পুনরুক্তি করে বলছেন “দুর্নীতির সাথে নো কম্প্রোমাইজ”। দুর্নীতিদমন কমিশনের চেয়ারম্যান অহরহই দেশবাসীকে শোনাচ্ছেন “দুর্নীতিবাজদের সাথে দুর্নীতির সাথে আদৌ কোন আপোষ নেই-তাকে দুর্নীতিবাজ যে কোন আপোষ নেই-তা সে দুর্নীতিবাজ যে কোন দলমতেরই হোক না কেন”।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় সন্দেহ নাই সামান্যতম। আসলেই তিনি চান দেশটি দুর্নীতিমুক্ত হোক এবং তাঁর উন্নয়ন প্রকল্পগুলি সাফল্যের মুখ দেখুক। কিন্তু তা কার্যকর করবেন কার মাধ্যমে ? যাঁদের মাধ্যমে দুর্নীতির উচ্ছেদ ঘটাবেন, দুর্নীতির প্রতি হাজারো বার “নো টলারেন্স” উচ্চারণ করা সত্বেও বস্তুত:ই কি তাঁরা তাই ? যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথা বলি- তা হলে তার জবাব না। তাঁদের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ। অভিযোগগুলি অর্ধেকও যদি সত্য: হয় এবং সেই অভিযোগকারীরা তার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেন তবে হয়তো রামায়ণ মহাভারতের মত বিশালকায় গ্রন্থ কয়েক খণ্ডে প্রকাশ করা যায়। সেই ছোট বেলা থেকে পুলিশ সম্পর্কে এমনই কথা গুণে আসছি। পাকিস্তান আমলের ২৩টি বছর গেল-বাংলাদেশের ৪৭টি বছর অতিক্রান্ত। দীর্ঘ এই ৭০ বছরের পথ পরিক্রমায় আসলে কোন পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে ? পুলিশের নিয়োগে জনপ্রতি যে পরিমাণ টাকা লাগে বলে শুনি তাতে রীতিমত আঁতকে উঠতে হয়। তবে পুলিশ বিভাগের সকলেই দুর্নীতিবাজ-এমন অভিযোগ আনছি না এমন অভিযোগ সত্যও না। যথেষ্ট পরিমাণ ভাল কর্মকর্তা আছেন বলেই ডিপার্টমেন্টটি এখনও টিকে আছে তবে খারাপ অংশ যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধন করছে তা ভয়াবহ। “পুলিশকে জনগণের বন্ধু” হিসাবে গড়ে তোলার প্রত্যয় এখনও কথার কথাই রয়ে গেছে মূলত। আর ঐ খারাপ অংশের কাজ কর্মের ফলে গোটা সরকারকে তার দায়িত্ব বহন করতে হচ্ছে।
ক’দিন স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য রকমের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলো। কোথায় তাদের কয়টা বাড়ী, কয়টা ফ্লাট, কি কি ব্যবসা, বাড়ী, গাড়ি- সব কিছুর তথ্যসহ। দুর্নীতি দমন কমিশন তখন তাদেরকে তথ্য প্রমাণাদিসহ তলব করলেন। তদন্ত শুরু হলো।
একটি দৈনিক পত্রিকায় দুর্নীতির মামলা সম্পর্কে প্রথম পৃষ্ঠায় খবর বেরিয়েছিল তদন্ত হয়, চার্জশীট হয় না”। বস্তুত: ঐ শিরোনামটি যথার্থ। বহুকাল যাবতই দেখে আসছি দুর্নীতির বড় বড় মামলায় শুধু আসামীকে তলব ও তদন্ত হয় দীর্ঘকাল ধরে-তার পর কোন চার্জশীট আদালতে দাখিল না করে তাঁরা চুপচাপ থাকেন। ফলে আমরা সাধারণ মানুষেরা হই বিভ্রান্ত। ধরে নিতেই হয় আসামী নিরপরাধ বলেই হয়তো তাঁর বিরুদ্ধে কোন চার্জশীট দেয়া হয় না। কিন্তু ঘটনা কি সত্যই তাই। অতএব অনার্জিত সম্পদ যার পাওয়া গেল-তাকে কিভাবে নির্দোষ ভাবা যাবে ? তা হলে কোথাও কোন গলদ আছে। গলদটি চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব তো দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের। তিনি চুপ করে থাকেন কোন জাদুমন্ত্র বলে?
বস্তুত: সর্বত্র স্বচ্ছতা কাম্য। সরকার জনগণের-তাই যেখানে যাই ঘটুক ভাল অথবা মন্দ সরকারিভাবেই জনগণ তা জানতে অধিকারী। কিন্তু সে অধিকারের স্বীকৃতি আমাদের ভাগ্যে আজও জুটলো না।
এই লেখাটি লিখতে হাতে এলো ২১ জানুয়ারির ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’। পত্রিকাটির ব্যাপক প্রচার নিয়ে কোন মহলেই বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই। সেই বাংলাদেশ প্রতিদিন ঐদিন লাল কালি দিয়ে চার কলামব্যাপী ব্যানার হেডলাইন দিয়েছে এই মর্মে “বেপরোয়া খেলাপি ঋণ” লিখেছে কর্পোরেট গ্যারান্টারের অশুভ সংস্কৃতি। ব্যাংকের এক মালিক কর্পোরেট গ্যারান্টিতে ঋণ নেন অন্য ব্যাংক থেকে। টাকা নিয়ে ফেরত দিতে চান না কেউই।
খবরে বলা হয়েছে কর্পোরেট গ্যারান্টির নামে ব্যাংকিং খাতে চলছে প্রতারণা। আইনের কঠোরতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক ব্যাংকের পরিচালকরা কর্পোরেট ঋণ গ্রহণ করেছেন অন্য ব্যাংক থেকে। এতে যাকে না নিরাপত্তা গ্যারান্টি, দেওয়া হয় না ঋণের বিপরীতে জমি, বাড়ী কিংবা অন্য কোন গ্যারান্টি। যার কারণে ভুয়া মানুষের নামে ব্যাংক ঋণ বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণও। আদালতে মামলা গড়ালেও তা স্থগিত করে প্রভাবশালীরা এ সুবিধা নিয়ে থাকেন। এতে করে খেলাপির পরিমাণ আরও বাড়তে থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে ব্যাংক ঋণের নামে অনেক সময় জনগণের জামানত নিয়ে যা খুশি তাই করা হয়। গরীব মানুষের প্রদত্ত অর্থ ঋণ দিয়ে রাখা হয় না কোন রকমের সম্পদ বন্ধক। আবার ভুয়া নামে বেনামে ঋণ প্রমাণের অভিযোগ রয়েছে অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অনিয়মগুলি হতে থাকে। খেলাপিরা আদালতে আশ্রয় নিয়ে সব কিছু থামিয়ে রাখে। ফলে ঋণ আদায় বন্ধ থাকে আদালতের হস্তক্ষেপে। আবার কোন কোন ঋণ খেলাপি পালিয়ে যান বিদেশে। এতে করে সত্যিকারের বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত হয়। দেশের টাকা বাইরে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হয়। এ সব খেলাপি অনিয়ম রোধে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সম্পদের নিরাপত্তার জন্য সম্প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তারা মনে করেন জবাবদিহিতা এ ব্যাপারে অপরিহার্য। ব্যাংকের মালিক ও কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা প্রয়োজন।
পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদেরকেও রাখতে হবে কঠোর নজরদারিতে। একই সাথে রাজনৈতিক চাপ যাতে ঋণ প্রদানের বা ঋণ ফেরত দানের সময়সীমা বৃদ্ধিতে যেন কোন ভূমিকা না রাখতে পারে তাই জরুরী ভিত্তিতে নিশ্চিত করা দরকার। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ঋণ প্রদাননীতি মালিকদের স্বার্থে নয়-ব্যাংকে যাঁরা টাকা রাখেন তাঁদের স্বার্থে অবিলম্বে সংস্কার করা অপরিহার্য।
ঐ পত্রিকাতেও অপর এক শিরোনাম “মামলা হলেও আদায় হয় না” তে বলা হয়েছে খেলাপি এক লাখ বার হাজার কোটি টাকা। খেলাপিদের ব্যবসা সচল। এতে বলা হয়েছে, “ব্যাংকিং খাতে যাতে রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ। জানা যায় দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর এই টাকা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। এর মধ্যে আবার ৪৫,০০০ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। অর্থাৎ পাঁচ বছরেও আদায় না হওয়া ঐ সব ঋণ “মন্দ” ঋণ হিসাবে ব্যাংকের হিসেব থেকে বাদ দিয়ে আলাদা খাতায় নেওয়া হয়েছে। সরকারের দুর্বলতা, রাজনৈতিক রক্ষা বেষ্টনী ও আইনি বাধা ফাঁক-ফোঁকরের মাধ্যমে খেলাপিরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
খেলাপি ঋণ পরিশোধে কাউকে কাউকে আটক করে জেলে নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ছেড়ে দিতেই হয় তাদের উপযুক্ত জামানত- সম্পত্তি প্রভৃতি আইনের চোখে খুঁজে না পাওয়ার কারণে। আর এ সব মামলায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের এক অংশের যোগসাজশও প্রকট। খেলাপিদের সম্পত্তির অভাব, সরকারি সম্পত্তি তৃতীয় নামের শত্রু সম্পত্তি, মামলার অধীনস্থ সম্পত্তির নানা ধরণের ভেজাল বাজি অসঙ্গতি দেখানোতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ঘটনা দিনে দিনে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা প্রকটতর হচ্ছে।
সুতরাং এক শ্রেণির ব্যাংক মালিক, ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারি দিব্যি ভদ্রবেশে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে মেরে দিচ্ছে, আদৌ ফেরতও দিচ্ছে না বরং রাজনৈতিক আশ্রয়ে ফুলে ফেঁপে দিব্যি কলাগাছে পরিণত হচ্ছে। ব্যাংকে সাধারণ মানুষ যারা হিসেব খুলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা।
ঢাকাসহ জেলা, উপজেলা শহরগুলিতে প্রকৃতি অনুসন্ধান চালালে যে বিপুল সংখ্যক বহুতল বিশিষ্ট দালান কোঠা দেখা যায় তার বেশীর ভাগেরই উৎস খেলাপি ঋণ। এ ক্ষেত্রে ঋণ খেলাপি দূর করতে হলে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে বহুমূলী পদক্ষেপ নিতে হবে;
এক. কোন ব্যাংক মালিক বা তার পরিবার পরিজন কোন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না উপযুক্ত জামানত ব্যতিরেকে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে জামানতের সম্পত্তি ব্যাংকের সম্পত্তিতে আপসে আপ পরিণত হবে;
দুই. কোন কর্পোরেট ঋণ নয়।
তিন. আদালত কদাপি ব্যাংকের টাকা আদায় সংক্রান্ত মামলা তিন মাসের বেশী স্থগিতাদেশ দিতে পারবেন না। শুনানি কার্য তার মধ্যে বাধ্যতামূলক করার জন্য প্রয়োজনে আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তিন মাসের শুনানি শেষ না হলে ব্যাংকের প্রাপ্য টাকা শর্তানুযায়ী ব্যাংক নিয়ে নেবে। এর বিরুদ্ধে কোন আপিল চলবে না।
চার. যে সকল ঋণ খেলাপিরা ভুয়া সম্পত্তি সরকারি সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি জাতীয় সম্পত্তি অবৈধভাবে জামানত হিসেবে দেখিয়েছেন এবং যে সকল কর্মকর্তা, ব্যাংকের আইনজীবী সেগুলি বৈধ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন বা স্বাক্ষর করেছেন তাঁদের প্রত্যেককে ২০ লক্ষ টাকা করে জরিমানা এবং ২০ বছর কারাবাস বাধ্যতামূলক করে আইন করতে হবে।
নতুন সংসদ এই বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিয়ে ভেবে অচিরেই সিদ্ধান্ত নিন যাতে ঋণ খেলাপি শব্দটাই আমরা ডিকশনারি থেকে তুলে দিতে পারি। এতে জনগণ উপকৃত হবে দেশের উন্নয়ন বেগবান হবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য