আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?

ডা. সাঈদ এনাম  

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন প্রতিবছরের ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘ওয়ার্কিং টুগেদার টু প্রিভেন্ট সুইসাইড’ অর্থাৎ ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করি একসঙ্গে’।

একজন মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন এর মধ্যে ব্যক্তিত্বে সমস্যা, গুরুতর মানসিক রোগ বা স্বল্পতার মানসিক, মাদকাসক্তি, এনজাইটি, ডিপ্রেশন অথবা প্ররোচনা ইত্যাদি।

এক গবেষণা দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৩৯ দশমিক ৬ জন আত্মহত্যা করে। ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে এই হার নারীদের মধ্যে বেশি। সাধারণত কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে এর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। স্বল্পশিক্ষা, দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহের জন্য অনেকে আত্মহত্যা করে। এ ছাড়াও প্রেম-সম্পর্কিত জটিলতা, আর্থিক অনটন, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব আত্মহত্যার পেছনের অন্যতম কারণ।

গ্রামের সাবসেন্টারে কিংবা উপজেলা হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে অনেক চিকিৎসককে আত্মহত্যার রিপোর্ট লেখতে হয়। আমাদের দেশে বেশিরভাগ নারী পুরুষ আত্মহত্যা করেন কীটনাশক পান করে। তাছাড়া গলায় দড়ি পেঁচিয়েও অনেককে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। এ দৃশ্য অত্যন্ত ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক। আত্মীয়স্বজনদের কান্না আহাজারি আর বিলাপে হাসপাতাল ভারী হয়ে উঠে। প্রতিবছর বাংলাদেশে এক লাখেরও অধিক নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেন। আর বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ পুরুষ ও নারী আত্মহত্যা করে, যা যে কোনো যুদ্ধে নিহতের চেয়েও অনেক বেশি। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন নারী বা পুরুষ আত্মহত্যা করছেন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে এই আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। কেউ মা-বাবার ওপর অভিমান করে, কেউবা পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করাতে আবার কারো কারো কারণ থাকে অজানা। তবে বেশিরভাগ আত্মহত্যা করেন ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার জন্য।

ডিপ্রেশন কী?
ডিপ্রেশন একটি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি যা একজন মানুষকে সবার অজান্তে তিলেতিলে শেষ করে দেয়।

মানুষের শারীরিক মানসিক কর্মক্ষমতা ও মারাত্মক কমিয়ে দেয় এই ডিপ্রেশন। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় তিনশ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন=১০ লাখ) ডিপ্রেশন এর রোগী রয়েছেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ৫ জনের ১ জন মানুষ কোনো না কোনো ধরনের ডিপ্রেশন বা এনজাইটিতে ভুগছেন।

অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্কের অবনতি এই ডিপ্রেশনের জন্য হয়ে থাকে, যা হয়তো থেকে যায় একেবারে অজানা। আবার উল্টোটি হয়। পারিবারিক বা সামাজিক টানাপড়েন থেকেই অনেক সময় মানুষ ডিপ্রেশনে ভোগেন।

শুরুতেই বলেছিলাম, ডিপ্রেশনের ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে আক্রান্ত রোগীরা নীরবে-নিভৃতে আত্মহত্যা করে বসেন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বিশ্বের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ এই ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশন বেশি দেখা যায় মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। অনেক ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন থেকে ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেশার হয়ে থাকে। ডিপ্রেশন শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধ, শিশু, কিশোর এমনকি সন্তানসম্ভবা মা কিংবা প্রসূতি মায়েদেরও ডিপ্রেশন দেখা দেয়, যা থেকে তারা আত্মহত্যা করে বসেন।

বাংলাদেশের ১৮ থেকে ২০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনো প্রকারের ডিপ্রেশন বা এনজাইটিতে ভুগছেন যাদের পরিবারের অনেকে হয়তো জানেন-ই না যে, তারা ডিপ্রেশনের রোগী, চিকিৎসা তো দূরের কথা। তবে আমার মতে সংখ্যাটা হয়তো আরও বেশি হবে কেননা এখনো আমাদের অনেকেই আছে ডিপ্রেশনকে কোন রোগই মনে করেন না। কিংবা ডিপ্রেশন নিয়ে সচেতন না।

বিশ্বের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ডিপ্রেশনের রোগী হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং এ ডিপ্রেশনকে কাটিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে আব্রাহাম লিংকন, চাঁদে ভ্রমণকারী এডুইন অলড্রিন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, উইনস্টন চার্চিল, বিখ্যাত "হেরি পোর্টার" এর লেখিকা জে কে রওলিং, গ্রেমি এওয়ার্ড খেতাবপ্রাপ্ত গায়িকা শেরিল ক্রো, যুক্তরাষ্ট্রীয় সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের স্ত্রী টিপের গোর নাম উল্লেখযোগ্য।

মার্কিন নভোচারী অলড্রিনের দাদা-দাদি ও ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন যারা এ নিয়ে আত্মহত্যা করেন এবং হেরি পোর্টারের লেখিকা রোলিং একসময় ডিপ্রেশনের জন্য মাঝেমধ্যে আত্মহত্যার কথা ভাবতেন। তবে তারা নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্ট সঙ্গে আলোচনা করেন।

ডিপ্রেশনের রোগীদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে, তাদের সঙ্গে ডিপ্রেশন নিয়ে আলাপ করতে হবে, এবং তাদের চিকিৎসার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ইদানীং অনেক মেডিকেল স্টুডেন্টেরও ডিপ্রেশন থেকে আত্মহত্যা খবর পাওয়া যাচ্ছে।

আসুন জেনে নেই ডিপ্রেশনের প্রধান কিছু লক্ষণ:
♦ সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকা
♦ উৎসাহ উদ্যম হারিয়ে ফেলা
♦ ঘুম কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
♦ রুচি কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
♦ ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
♦ কাজকর্মে শক্তি না পাওয়া
♦ মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
♦ মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
♦ নিজেকে নিঃস্ব অপাঙক্তেয় মনে করা
♦ অযাচিত অপরাধবোধ
♦ আত্মহত্যার কথা বলা, ভাবা।

এই লক্ষণগুলো টানা দু'সপ্তাহের বেশি থাকলে আমরা তাকে মেজর ডিপ্রেশনের রোগী বলি, এবং তিনি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছেন বলা যায়।

চিকিৎসা:
সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে থেকে নানান প্রকারের কার্যকরী এন্টিডিপ্রেশেন্ট ড্রাগ সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে একজন ডিপ্রেশনের রোগীকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। সাধারণত এমিট্রিপটাইলিন, সিটালোপ্রাম, এস সিটালোপ্রাম, মিরটাজাপিন এন্টিডিপ্রেশন হিসেবে খুবই কার্যকরী।

সারা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ডিপ্রেশনের এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করেই গত বছরের ৭ এপ্রিল (২০১৭) বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান করা ছিল "ডিপ্রেশন: লেট'স টক" অর্থাৎ "আসুন, ডিপ্রেশন নিয়ে আলোচনা করি"। সবশেষে আবারো বলছি, ডিপ্রেশনের রোগীরা সবার অগোচরে আত্মহত্যা করে বসেন। তাই তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলুন, সময় দিন এবং বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন।

ডা. সাঈদ এনাম, সাইকিয়াট্রিস্ট; ডিএমসি, কে-৫২, উপজেলা স্বাস্থ্য ও প প কর্মকর্তা, সিলেট; মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন ও ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিস্ট এসোসিয়েশন; লাইফ মেম্বার, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ