আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাফল্য না মিথ্যাচার?

এস এম নাদিম মাহমুদ  

সারাবিশ্ব যখন কভিড-১৯ দিশেহারা, তখন আমাদের দেশে বেশ একটি আশা জাগানিয়া খবর হলো, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একদল গবেষক Severe Acute Respiratory Syndrome coronavirus2 (SARS-CoV-2) সনাক্তকরণের কিট বের করেছে। তারা বলছেন, মাত্র ১৫ মিনিটে SARSPOC kit দিয়ে ব্লট ডট পদ্ধতিতে সনাক্তকরণ করতে পারবেন।

সারাবিশ্বই বর্তমানে র‌্যাপিড ডিটেকশন কিট তৈরিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই ধরেন জাপানের কুরাবো কোম্পানি ১৫ মিনিটে, দক্ষিণ কোরিয়ার পিসিএল, তাইওয়ানের একাডেমিয়া সিনিকা কোম্পানি ১০ মিনিটের মধ্যে SARS-CoV-2 সনাক্তকরণের পদ্ধতি তৈরি করে ফেলছে। আশা করি, সেইগুলো খুব শিগগির বাজারে আসবে।

তবে বাংলাদেশে বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে যে কিট আবিস্কারের খবর গণমাধ্যমে এসেছে, তার বিস্তারিত তথ্য আসেনি। যদিও তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে বলছেন, তিনি ২০০৩ সালের SARS-CoV ভাইরাস সনাক্তকরণের যে পদ্ধতিটি প্রয়োগ করেছিলেন, সেই dot blot পদ্ধতিটির মাধ্যমে কভিড-১৯ সনাক্তকরণ করতে চান। তার কথায় স্পষ্ট তিনি, এখন পর্যন্ত সেটি করেননি, তবে তার ধারনা একই পদ্ধতিতে এই ভাইরাসটি সনাক্তকরণ সম্ভব।

এই বিষয়ে বিস্তারিত লেখার আগে চলুন দেখি আসি ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুরের জাতীয় হাসপাতালে Khee-Chee Soo নেতৃত্বে তিনি যে দলে কাজ করেছেন সেখানে কী বলা হয়েছে।

Healthcare Worker Seroconversionin SARS Outbreak শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলছে, তারা সিঙ্গাপুর জাতীয় হাসপাতালে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ত থেকে সেরাম পৃথক করে তারা SARS-CoV এর Immunoglobulin (Ig) G অ্যান্টিবডি সিডিসির প্রটোকল অনুযায়ী ডট ব্লট enzyme-linked immunosorbent assay (ELISA) টেস্টের মাধ্যমে সনাক্ত করে। পরে এই সেটাকে নিশ্চিতকরণের জন্য টিস্যু কালচার ইনফেক্টভ ডোজ বা (TCID50) পদ্ধতিতে মনোক্লনাল অ্যান্টিবডির সাথে মিশ্রণ ঘটিয়ে নিউট্রালাইজ করে ফেলে। এই হলো তাদের আগের গবেষণা।

এইবার আসি SARS-CoV এবং SARS-CoV-২ বিষয় নিয়ে। বিজন কুমার শীল মনে করছেন, এই দুই ভাইরাস একই মেকানিজমে আমাদের শরীরে কাজ করছে। তিনি এটাও মনে করছেন, SARS-CoV এই অ্যান্টিবডি SARS-CoV-২ অ্যান্টিবডি একই। যদি একই হতো তাহলে এইভাবে প্যানডেমিক হলো কেন? কেন এতো বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে? এইসব বিষয়ের সাথে তিনি কতটা পরিচিত তা আমি জানি না। তবে কিছু বিষয় আলোচনা করা জরুরি।

দুই সার্সের পার্থক্য কী?
২০০৩ সালে ছড়িয়ে পড়া SARS-CoV এবং ২০১৯ শেষে ছড়িয়ে পড়া SARS-CoV-২ এর জিনোম সিকুয়েন্স ৭৯.৫ শতাংশ মিল রয়েছে ( আগ্রহীরা দেখতে পারেন (Lu et al., 2020; Zhou et al., 2020)। এই দুই ভাইরাস তাদের স্পাইক দিয়ে আমাদের শরীরে আসলে কোষের মেমব্রেনে থাকা angiotensin-converting enzyme 2 (ACE2) গ্রাহকের মাধ্যমে কোষের ভিতরে প্রবেশ করে অ্যান্টিজেন বা জীবাণু ছড়িয়ে দেয়। শরীরে এই নিদিষ্ট অ্যান্টিজেনের বিপরীতে অ্যান্টিবডি না থাকার ফলে আমরা অসুস্থবোধ করি।

সাধারণত যদি অন্যকোন অ্যান্টিবডি ACE2 গিয়ে বসলে SARS-CoV- 2 আমাদের শরীরে প্রবেশ করে না। আর এই মেকানিজমকে কাজে লাগিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি হয়। চলতি মাসে নেচারে প্রকাশিত Novel antibody epitopes dominate the antigenicity of spike glycoprotein in SARS-CoV-2 compared to SARS-CoV গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস কার্যক্ষম অংশ স্পাইকের প্রোটিনের সাথে SARS-CoV- 2 অন্তত ২৪.৫ অ্যামিনো এসিডের মিল নেই। যে কারণে, এই ভাইরাসটি অ্যান্টিবডির এপিটপ দ্রুত বদলায়। যে কারণে সার্স -১ যেগুলোর অ্যান্টিবডি ব্যবহার করা হয়েছিল সেই চারটি অ্যান্টিবডির অন্তত তিনটি যেমন m396, CR3014, SARS-CoV- 2 কাজে দিচ্ছে না। ফলে এই ভাইরাসটির আক্রমণ করার ক্ষমতা SARS-CoV-1 চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।

ডট ব্লট কী?
ডট ব্লট সারাবিশ্বে পরিচিত একটি পদ্ধতি। আমরা সাধারণত কোন নিদিষ্ট প্রোটিনকে চিহিৃতকরণের জন্য ওয়েস্টার্ন ব্লট পদ্ধতি প্রয়োগ করি। এটি সারাবিশ্বেই সবচেয়ে পুরাতন ও প্রসিদ্ধ পদ্ধতি। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এটি করতে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।

ঠিক এই পদ্ধতির শেষ ধাপটি হলো ডট ব্লট। সাধারণত একটি কৃত্রিম মেমব্রন বা নাইট্রোসেলোলোজ বা Polyvinylidene difluoride (PVDF) মেমেব্রনের উপর স্যাম্পল বা নমুনা রেখে একটি পরিচিত প্রাথমিক অ্যান্টিবডির সাথে মিশ্রণ ঘটানো হয়। এরপর যে নমুনা নেয়া হয়েছে, তার জন্য নিদিষ্ট অ্যান্টিবডি বা সেকেন্ডারি অ্যান্টিবডির সাথে রেখে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তা বিশেষ ক্যামেরার মাধ্যমে ওই স্যাম্পলের প্রোটিনটি সনাক্ত করন করা হয়। আর এই প্রক্রিয়াটি হতে সময় নেয় ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের মত।

এর সাথে তিনি যদি ইমূনোঅ্যাসে পদ্ধতি অনুসরণ করেন, সেটিও যে কয়েক ঘণ্টার বিষয়।

বড় বাধা কী?
আমি জানি না, বিজন কুমার শীল কোন ডটব্লটের কথা বলছেন, তবে প্রচলিত ডটব্লটে সেরোলজিক্যাল টেস্ট সার্স-১ যেসব অ্যান্টিবডি ব্যবহৃত হয়েছে সেইগুলো SARS-CoV- 2 ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তিনি যে অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে এই ভাইরাসের অ্যান্টিজেনকে নিষ্ক্রিয়করণ বা নিউট্রালাজিং করবেন, সেটি যে এখনো কেউ তৈরি করতে পারেননি। যদি তৈরি না করতে পারে, তাহলে ২০০৩ সালে সিঙ্গাপুরে ব্যবহৃত anti–SARS-CoV কতটুকু কাজে দিবে সেটাই এখন আলোচনার বিষয়। স্পাইকে অ্যামিনো এসিডের ভিন্নতায় ২০১৯ সার্সকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে তা সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরাই অবগত।

যার কারণে, ২০০৩ সালের ওই SARS-CoV-1 সনাক্তের জন্য ব্যবহৃত কিট বা পদ্ধতি SARS-CoV- 2 ক্ষেত্রে কাজে দিচ্ছে না। এমনকি অ্যান্টিবডি তৈরি করাও সম্ভব হচ্ছে না।

আর যে কারণে, বাজারে প্রচারিত ডিটেকশন কিটগুলো বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারেনি। ফলে রিভার্স-ট্রান্সক্রিপ্টেজ পলিমারেজ চেইন রিয়াকশন বা আরটিপিসিআর এখন নির্ভরযোগ্য সনাক্তকরণ পদ্ধতি।

২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত SARS-CoV- 2 কোন অ্যান্টিবডি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছে। এটা তৈরি করা সম্ভব হলে যেমন, ব্লট-ডট কিংবা ELISA মাধ্যমে যেমন সনাক্তকরণ করা যাবে, তেমনি ঔষধ বা ভ্যাকসিন তৈরিতে অগ্রগতি হবে।

আমি চাই, বিজন কুমার শীলরা কভিড-১৯ সনাক্তকরণ করুক। গবেষণাবিমুখ এই জাতির জন্য আলো ছড়াক। কিন্তু পরীক্ষা না করেই এর ফল গণমাধ্যমে প্রচারণার যে প্রবণতা আমাদের যেন ব্যথিত না করে। গত কয়েক বছরে অন্তত ৪/৫ টি ঘটনা এই দেশে মিডিয়ায় শিরোনাম হয়েছে, সেইগুলো আজও আলোর মুখ দেখেনি।

আমি চাইবো, এইবার অন্তত এই একটি গবেষণা যেন আলোর মুখ দেখে। সাফল্যের খবর যেন মিথ্যাচারে পরিণত না হয়।

এস এম নাদিম মাহমুদ, গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ