আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় কেন এত ভয়াবহ হয়ে ওঠে?

বন্যা আহমেদ  

আরেক সুপার সাইক্লোন, আম্পান, তার তাণ্ডবলীলায় তুষ্ট হয়ে সগর্বে বিদায় নিল। আমাদের চির অবহেলিত সুন্দরবন আবারো বুক পেতে না দিলে হয়তো এই ধ্বংসযজ্ঞ আরও ভয়ংকরী রূপ নিত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় তো অনেক জায়গাতেই হয়, কিন্তু বঙ্গোপসাগরে কেন বারবার সেটা এত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে? বারবার এই চরম ধ্বংসের সামনে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কি আর কিছুই করার নেই আমাদের?

'ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড' ওয়েবসাইটের এর হিসেব ঠিক হলে, আম্পানের পরে এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৩৬টি ভয়ঙ্করতম মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২৬টিই ঘটেছে বঙ্গোপসাগরে।

বিজ্ঞাপন

কেন?

উপরে নাসার এই ছবিটা দেখুন। পৃথিবীর বিষুবরেখার উপরে এবং নিচে কমলা রঙের অঞ্চলগুলোয় প্রতিবছর মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ দেখা যায়।

ঘূর্ণিঝড় একটা দানবীয় ইঞ্জিনের মত যার জ্বালানি হিসেবে কাজ করে উত্তপ্ত, আর্দ্র বাতাস। আর এর জন্য বিষুবরেখার আশেপাশের সমুদ্রের চেয়ে আর অনুকূল জায়গা আর কী থাকতে পারে? সমুদ্রের পৃষ্ঠ থেকে যখন এই গরম, আর্দ্র বাতাস উপরের দিকে উঠতে শুরু করে চোঙার মত তখন তার নিচের খালি জায়গায় নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। এর ফলে এর আশেপাশের উচ্চচাপের বাতাস প্রবল বেগে ছুটে এসে এই খালি জায়গাটা পূরণ করে। তারপর এই নতুন বাতাসও উত্তপ্ত এবং আর্দ্র হয়ে উপরে উঠতে শুরু করে আর তার চারপাশের পানিগুলো তখন আরও প্রবলবেগে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে আসতে থাকে। ফুঁসে উঠতে থাকে সমুদ্র মহাপ্রলয়ঙ্করী রূপে।

এর উপর আবার আরেক কাঠি বেশি ইন্ধন যোগায় আমাদের বঙ্গোপসাগর এই ঘূর্ণিঝড়গুলো আরও রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপসাগর এই বঙ্গোপসাগরের অবতল বা কনকেভ আকৃতি এবং অগভীর পানি যেন 'বারুদের' মত কাজ করে ঘূর্ণিঝড়ের 'আগুনে' - এর ফলে তারা ভয়ঙ্করী হয়ে উঠতে পারে চোখের নিমেষে। সাথে বঙ্গোপসাগরের দিকে বাংলাদেশের ফানেলাকৃতির ভৌগোলিক অবস্থানও ব্যাপারটা আরও তীব্র করতে সহায়ক হয়। আটকে থাকায় দানবের মত প্রবল গতিতে ছুটে আসতে থাকে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের উপকূলের দিকে। বুধবারে সে উপকূলে আঘাত করে প্রবল বেগে- এ সময়ে গতি কমে আসতে শুরু করলেও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলজুড়ে বিশাল ক্ষতির কারণ হয় সে।

এছাড়া আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল এত ঘন-বসতিপূর্ণ হওয়াতে স্বভাবতই ক্ষতির পরিমাণও হয় অনেক বেশি।

এর প্রত্যক্ষ নমুনা দেখেছি গত রোববারে, বঙ্গোপসাগরের ওপর যখন আম্পান ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিতে শুরু করে। রোববারেও সে আকারে এত বড় হয়ে ওঠেনি, কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, সোমবারে, ৪-৬ ঘণ্টার মধ্যেই সে ভয়াবহ আকার ধারণ করে সুপার সাইক্লোন বা ক্যাটাগরি ৫ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে যায়।

বঙ্গোপসাগরের তিন দিক থেকে স্থলভাগ দিয়ে আটকে থাকায় দানবের মত প্রবল গতিতে ছুটে আসতে থাকে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের উপকূলের দিকে। বুধবারে সে উপকূলে আঘাত করে প্রবল বেগে - এ সময়ে গতি কমে আসতে শুরু করলেও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলজুড়ে বিশাল ক্ষতির কারণ হয় সে।

বঙ্গোপসাগরের এই বিশেষ গঠনের কারণে মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়গুলো যেকোনো সময়ে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে এবং সময়ে সময়ে তা ওঠেও।

বাংলাদেশিরা এখনো ১৯৭০ সালের সেই ভোলা ঘূর্ণিঝড় ভুলেনি। এর পরও গত ৫ দশকেও আমরা দেখেছি আরও অনেক ধ্বংসলীলা, সবচেয়ে বড়টা ছিল ১৯৯১ যাতে লক্ষাধিক প্রাণহানি ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা পরিবেশ বদলের কারণে এ ধরনের সুপার সাইক্লোনের সংখ্যা আরও বাড়বে।

আবার ওদিকে যে সুন্দরবন বারবার আমাদের রক্ষা করছে তার রক্ষণাবেক্ষণ তো দূরের কথা সেখানে রামপালের মত কয়লার পাওয়ার প্ল্যান্ট বানানো থেকে শুরু করে এহেন কোন দায়িত্বহীন কাজ নেই যে আমাদের সরকার করছে না। করোনাভাইরাসই বলুন আর আম্পানই বলুন, আমরা জানি এতে ক্ষয়ক্ষতির শেষমেশ দায়ভারটা বহন করতে হয় গরিব মানুষদেরই- উপকূলের দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষদেরই সব যায়। এর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার।

গত কয়েক দশকে উপকূলে যে শেল্টার বানানো হয়েছে গত তিরিশ বছর ধরে সেগুলো এখন কাজে লাগছে, আগাম সতর্কতা অনেক বেড়েছে, স্যাটেলাইট মাধ্যমে খবর পাওয়া যাচ্ছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এগুলোর কোনটাই দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয়। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের সরকারগুলোর কাছে দাবি করার সময় এসেছে এ নিয়ে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করার - আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের তাগিদেই।

বিজ্ঞাপন

[কোলকাতার অবস্থা দেখে আমার ১৯৮৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, ওটাই আমার শেষ ঘূর্ণিঝড় দেখা দেশে। আমি তখন ঢাকা মেডিকেলের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। এখনো মনে আছে ঢাকা শহরে এতটাই পানি উঠেছিল সেই উন্মত্ত ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে যে আমরা নৌকা করে যাতায়াত করতে বাধ্য হয়েছিলাম কয়েকদিন। এবারের ধাক্কাটা পশ্চিমবঙ্গের উপরে দিয়েই গেছে বেশিরভাগ, সেখানকার আক্রান্ত জনপদ ও প্রিয়জনদের প্রতি রইল সমবেদনা]

তথ্যসূত্র:
https://spaceplace.nasa.gov/hurricanes/en/
https://www.bbc.com/news/world-asia-india-52718531
http://www.hurricanescience.org/history/storms/1970s/greatbhola/

বন্যা আহমেদ, লেখক, ব্লগার; ভিজিটিং রিসার্চ স্কলার, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ