আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

কীভাবে মুক্তচিন্তা করবেন

এনামুল হক এনাম  

আমাদের সমাজে বেশিরভাগ লোকজনই ভাবতে চায় যে সে মুক্তচিন্তা করে, আদতে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তবে আমাদের মধ্যে সত্যই কতজন মুক্তচিন্তা করতে পারে! বা আদৌ কি সবার দ্বারা মুক্তচিন্তা করা সম্ভব?

বিশ্বাস বা আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে কয়জন মানুষ আসলে নিজের চিন্তার ক্ষেত্র প্রসারিত করে? সামাজিক সংস্কৃতি,রাষ্ট্র, ধর্ম, রাজনীতি বা প্রচলিত বিশ্বাস তাদের সাথে যে পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য উপস্থাপন করে তা দ্বারা কি সবাই প্রভাবিত হয় না? কতজন প্রভাবিত না হয় জিরো গ্রাভিটিতে এসে চিন্তা করতে পারে? “কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য, পারিবারিক বা সামাজিক সংস্কৃতির প্রতি অগাধ আস্থা, যা জানি তাই সত্য… বাকি সব মিথ্যা, আমার মত, আমার পথই একমাত্র সত্য, বাকিরা পথভ্রষ্ট, বাকিরা মিথ্যা” সমাজে প্রচলিত এই ধরণের ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে বৃত্তের বাইরে চিন্তা করতে পারে আসলে কতজন!

বাস্তবতা হ'ল বেশিরভাগ লোক কীভাবে আত্ম-সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করতে হবে তা জানে না, এবং সমাজ বা পরিবার প্রদত্ত বিশ্বাসকে তারা অন্ধভাবে গ্রহণ করে। কিন্তু ব্যক্তি যদি নিজের চিন্তার ক্ষেত্র প্রসারিত করে প্রশ্ন করতে না শেখে, তবে আজীবন কূপমণ্ডূক থেকেই জীবনাবসান করে।

আদৌ কি একজন সাধারণ মানুষ মুক্তচিন্তক হতে পারে?
কীভাবে একজন সচেতন, বুদ্ধিমানের মানুষের দ্বারা মুক্তচিন্তা করা সম্ভব? সবার মুক্তচিন্তা করা জরুরি বা আবশ্যক নয়, সমাজে গুটিকয়েক মানুষও যদি মুক্তচিন্তা করে তবে সমাজ চিন্তাশীল হয়, শৈল্পিক হয়, উদ্ভাবনী হয়, আপামর জনসাধারণ চিন্তার খোরাক পায়।

কীভাবে মুক্তচিন্তা করবেন, সে সম্পর্কে একটি ছোট্ট এবং সংক্ষিপ্ত বাস্তব-ধর্মী গাইডলাইন দেওয়ার চেষ্টা করছি, যা আপনাকে বোধ হওয়ার আগেই প্রাপ্ত কুসংস্কার, বিশ্বাসের কারাগার থেকে মুক্ত করে সত্যের অনুসন্ধানী হয়ে নিজের চিন্তার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে সহায়তা করবে।

আজীবন যা সত্য মেনে এসেছেন, জরুরি নয় তা সত্য মানা।

কীভাবে একজন মুক্তচিন্তক হয়ে উঠবেন
আপনাকে প্রশ্ন করতে জানতে হবে, প্রশ্ন করা শিখতে হবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি অন্যের দ্বারা আপনার উপর চাপিয়ে দেওয়া বিশ্বাসকে প্রশ্ন করা। আপনার বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন- ধর্মীয়, রাজনৈতিক, দার্শনিক কিংবা সামাজিক– প্রাপ্তবয়স্ক আপনি যখন তাদের সমর্থন করার কোন যুক্তিযুক্ত প্রমাণ না পান, তখন সেগুলিকে অবশ্যই প্রশ্নের মাধ্যমে ঝালাই করে নেয়া উচিত। যাচাই-বাছাই করে যুগ যুগ ধরে লালিত ভ্রান্ত বিশ্বাস ত্যাগ কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। চেষ্টা করে দেখুন, কষ্ট হবে, কিন্তু এর চেয়ে আনন্দজনক আর কিছুই নয়।

প্রশ্ন করুন সেই ব্যক্তি, কর্তৃপক্ষকে, যার দ্বারা আপনি প্রভাবিত বা যার কাছ থেকে বিশ্বাস, সংস্কারপ্রাপ্ত হয়েছেন। বেশিরভাগ লোকজন সামাজিক বা বংশানুপরিক্রমায় প্রাপ্ত বিশ্বাস, সংস্কৃতিকে সত্য ও সঠিক বলে মান্য করে এবং অন্ধভাবে অনুসরণ করার পথ বেছে নেয়। তারা নিজের মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে চিন্তা করে না, প্রশ্ন করে না- পরিবর্তে তারা অন্যদের থেকে প্রাপ্ত যুক্তি, সংস্কার, কুসংস্কার, রীতি-নীতি তাদের জন্য একমাত্র অবলম্বন হিসেবে মেনে নেয়। কারণ চিন্তা করা কঠিন।

মনে রাখবেন একজন মুক্তচিন্তক কখনোই অবিবেচকের মত যুক্তিহীন ভাবে অপ্রমাণিত কিছু সাদরে গ্রহণ করে না। সে প্রশ্ন করে, জিজ্ঞেস করে এবং কর্তৃপক্ষের মতামতের সাথে বিজ্ঞান, যুক্তি, প্রমাণ মিলিয়ে দেখে, একই যুক্তিতে অন্যান্য মত, পথ বিশ্লেষণ করে, তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তা যদি তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধেও যায়, তবুও সে সত্যের অনুসন্ধান করে এবং উত্তর খুঁজে, মুক্তমনে।

প্রথমেই আমি আপনাকে যে পরামর্শ দিতে চাই তা হলো, আপনি আপনার ব্যক্তিগত আচরণ পর্যবেক্ষণ করুন। যদিও আমরা সবাই মনে করি যে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা আছে এবং আমরা সেই স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হই, বাস্তবে কিন্তু তা কখনোই হয় না। আমাদের বেশিরভাগ আচরণ, ক্রিয়াকলাপ বা কাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসলে অচেতনভাবেই পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে প্রাপ্ত বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশ্বাসের প্রভাবে নেয়া সিদ্ধান্ত যদি মনঃপুত নাও হয়, তবুও আমরা নিশ্চুপ থাকি, প্রশ্ন করি না, বিবেকবুদ্ধিকে কাজে লাগাই না। এক অর্থে, বিশ্বাস একটি অভ্যাস এবং আমরা আমাদের অভ্যাসের শিকার। মুক্তচিন্তক হয়ে উঠতে হলে আপনাকে আপনার চিন্তাভাবনা, ক্রিয়া এবং সামগ্রিক আচরণ সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়া দরকার। মনে রাখবেন, নিজের আচরণের প্রতি সচেতন হওয়া মানে নিজেকে প্রতিদিন আয়নায় দেখা। নিজেকে বিচার, বিশ্লেষণ করা, নিজেকে ভেঙে গড়া। নিশ্চিত ভাবেই এটা একধরণের সাধনা…কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়।

আপনাকে বলি, অনুগ্রহ করে অনুকরণ করা বন্ধ করুন। মুক্তচিন্তা করা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিজের চিন্তাশক্তিকে গতানুগতিকতার স্রোত থেকে দূরে রাখা। এটা সত্য নয় যে, সবার কাছে যা গৃহীত ও পছন্দনীয় তাই সত্য এবং এটাকেই মেনে নিতে হবে। আপনার মস্তিষ্ক আছে, বিচারিক ক্ষমতা আছে, তথ্য সংগ্রহ করার সুযোগ আছে, প্রমাণের ভিত্তিতে যুক্তির পাল্লায় ভাল মন্দ বিচারের বিবেক আছে। আপনি অন্যরা কী বলবে এই ভয়ে হাজার বছর ধরে লালিত ভুল পন্থা, ভুল সূত্র, ভুল যুক্তি, ভ্রান্ত বিজ্ঞান মেনে চলেন এবং প্রায় পশুর মানসিকতা প্রশ্নহীন জীবনে বেঁচে থাকেন! কেন?

পৃথিবীতে শিক্ষিত অশিক্ষিত প্রত্যেকটি মানুষই গবেষক। গ্রামে একজন অশিক্ষিত কৃষকও জানে কোন মৌসুমে কোন ফসল ভাল হয়, কখন পানি দিতে হয়, কতটুকু পানি দিতে হয়, কখন সার দিয়ে হয়, কোন প্রকার পোকার আক্রমণে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। এ জ্ঞান হাজার বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ গবেষণার ফল। অথচ অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন আপনি না পড়ে, না জেনে অন্যের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে কেন কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন? একজন মুক্তচিন্তক সবসময় সত্যের অনুসন্ধান করে, সে চিন্তা করে, প্রকৃতিতে চিন্তার খোরাক খুঁজে, আপনি যদি সত্যের সন্ধান করে থাকেন তবে আপনাকে পরামর্শ দেব বই পড়ুন এবং নিয়মিত। একসময় বই পড়তে হলে বই কিনতে হত, ইন্টারনেটের যুগে আজকাল যেকোনো বই আপনি সহজেই ডাউনলোড করে পড়তে পারেন, সংগ্রহে রাখতে পারেন এবং রেফারেন্স হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন। আজকাল বাংলা এবং ইংরেজিতে ভাল ডকুমেন্টারি পাওয়া যায় ইউটিউবে, অথেনটিক সাইট যেমন বিবিসি, সিএনএন, হিস্টোরি চ্যানেল, পিবিএস ডকুমেন্টারি, এনিমেল প্ল্যানেট, ডিসকভারি এইসব চ্যানেল দেখেও নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন। যেমন আপনার গ্রামের একজন বয়োবৃদ্ধ লোক আপনাকে বললো, বৃষ্টি হওয়ার কারণ হল মেঘের উপরে একজন দেবতা বসে আছেন, তিনি সবসময় পর্যবেক্ষণ করছেন নিচে মাটিতে কখন কোথায় পানি লাগবে, যখন যেথায় লাগবে সেখানে তিনি পানি বর্ষণ করেন। আপনি এই তথ্যে সন্তুষ্ট থাকতেই পারেন, মনে করতে পারেন একজন দেবতা আসমান থেকে পানি বর্ষণ করছে। কিন্তু অনুসন্ধিৎসু মন থাকলে ইউটিউব বা গুগলে একবার সার্চ দিতে পারেন, বৃষ্টি কেন হয়, What Causes Rain? তাই জানার জন্য পড়ুন, দেখুন, নিজের জ্ঞানকে প্রসারিত করুন।

সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা করুন। সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা কীভাবে করতে হয় তা শেখা মুক্তচিন্তায় অতীব জরুরি একটি বিষয়। আপনি যে তথ্যটি পেয়েছেন তা যদি বিশ্লেষণ ও সমালোচনামূলক-ভাবে মূল্যায়ন করতে না পারেন তবে আপনার মধ্যে আর গবাদিপশুর মধ্যে আদৌ তফাৎ নেই। সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা আপনাকে পক্ষপাতদুষ্ট মতামত এবং ভ্রান্ত তথ্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া এড়াতে সহায়তা করে সত্য আবিষ্কার করতে সহায়তা করবে। তাই উপযুক্ত বিষয়ে, উপযুক্ত সময়ে সমালোচনা করতে শিখুন।

বলে রাখি, অসময়ে, সকল বিষয়ে, সবার সাথে সমালোচনায় অংশগ্রহণ অপরিপক্বতার লক্ষণ। নিজের ওজন জানুন, সবার সাথে তর্কে জড়াবেন না।

মন খোলা রাখুন। মুক্তচিন্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নিজে মুক্ত মনের অধিকারী হওয়া। এর অর্থ হল, নতুন কোন তথ্য নেয়ার জন্য নিজেকে আগ্রহী রাখা, নতুন বিষয় শেখার জন্য নিজের মনকে উন্মুক্ত এবং ভিন্ন মত এবং ভিন্ন বিশ্বাসকে তৎক্ষণাৎ বাতিল করে না দিয়ে যুক্তি প্রমাণের ভিত্তিতে তা যাচাই করুন। যদি এমন কোন তথ্য প্রাপ্ত হওন যা আপনার বদ্ধমূল বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিরোধী অথচ তা সত্য, তা গ্রহণ করার মানসিকতা রাখুন। একজন মুক্তচিন্তক অন্ধভাবে কিছু গ্রহণ করে না তবে একই সাথে নিত্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধারণাগুলি বিবেচনা করার মত মানসিকতা ধারণ করে।

অন্যেরা কী করে এবং অন্যেরা কী বিশ্বাস করে সেই বিষয়ে চিন্তাভাবনা ছেড়ে দিন। নিজের মস্তিষ্ককে কাজে লাগান। বুঝুন, বুঝতে চেষ্টা করুন।না বুঝলে কেন বুঝতে পারছেন না তার কারণ খুঁজে বের করুন। পড়ুন এবং জ্ঞান অন্বেষণ করুন। এই পৃথিবীতে অর্জিত সকল জ্ঞানই মানুষের, আপনার বোধগম্য না হওয়ার কিছুই এখানে নেই।

গতানুগতিকতার দলে যোগদান এড়ানোর চেষ্টা করুন। প্রায়শই, আপনি যে জাতি, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল বা ধর্মের অন্তর্গত তাদের সাথে একই সুরে কথা বলেন। তা পরিহার করুন। যুক্তির বিচারে ন্যায্যতায় কথা বলুন তা যদি নিজের গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও যায়। প্রাণের ভয়ে কথা বলতে না পারলে চুপ থাকুন, অন্তত অন্যায্য, কুসংস্কার, কুযুক্তিকে সমর্থন করবেন না। এটি হতে পারে আপনার স্বতন্ত্রতার প্রথম পদক্ষেপ।

সারাদিনই রেডিও, টিভি, ইন্টারনেট, সংবাদপত্রে তথ্য পাচ্ছেন। সকল তথ্য বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই। সকল তথ্য বাতিল করে দেয়ারও প্রয়োজন নেই। নিজের মাথাকে খাটান। সংবাদ চক্রটি বুঝার চেষ্টা করুন। সংবাদ উপস্থাপন, পরিবেশন কিংবা বিজ্ঞাপন সবই হচ্ছে আপনাকে বা আপনাদের কেন্দ্র করে, আপনাকে বা আপনাদের প্রভাবিত করার জন্য। একটি নেগেটিভ সংবাদও শুধুমাত্র উপস্থাপনের কারণে পজিটিভ হয়ে যেতে পারে। কিংবা একটি পজিটিভ সংবাদও উপস্থাপনার কারণে আপনার কাছে নেগেটিভ হয়ে ধরা দেবে। সংবাদ পরিবেশনার কারণে আপনি একটি দল, মত, বা গোষ্ঠীর মত চিন্তা করবেন বা নিজের অজান্তেই তাদের পক্ষ নিবেন। তাই জরুরি নিজের বিচার বিশ্লেষণে মাথা খাটানো। বর্তমান শত চ্যানেলের ব্যস্ত টিভি বাক্সটি একটি রাজনৈতিক প্রচারণার মাধ্যম, মূল্যহীন বিনোদন এবং সত্য মিথ্যার সংমিশ্রণে তথ্যের সম্ভার । আপনার যদি কোনও বিষয়ে সত্যই কিছু জানা প্রয়োজন হয়, তবে অনলাইনে বেশ কয়েকটি সাইট বা নিউজ পোর্টার ঘেঁটে একটি গবেষণা করুন (তবে ব্লগগুলি নয়), সংক্ষিপ্ত গবেষণার ভিত্তিতে আপাত ধারণা নিন। অনুগ্রহ করে কখনোই প্রতিক্রিয়াশীল হবেন না।

আপনার জীবনে অনেক কাজই আছে অর্থহীন, মূল্যহীন, কেন আপনি কিছু কাজ করবেন যার প্রয়োজন আদৌ নেই। তাই নিজের প্রতিটি কাজের মূল্যায়ন করুন। আপনি তো এমন লোক নন যে অন্যের দয়ার উপর চলতে হয়। তাই অন্য লোকের দেখানো অর্থহীন কাজগুলো অনুকরণ করে যাবেন সারাজীবন। যদি এমনও হয় এই অর্থহীন কাজে আপনি আনন্দ পান, তবুও কাজগুলো মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরিহার করুন। সব সময় আনন্দই সবকিছু নয়। আপনি মুক্তচিন্তা করবেন, আপনার নীতি নৈতিকতার একটি মাত্রা থাকবে, যা সাধারণ মানুষের জন্য অনুসরণীয় হবে। দিনশেষে আপনি যখন আয়নার সামনে দাঁড়াবেন, তখন যেন নিজের কাছে নিজেকেই লজ্জিত হতে না হয়। আপনি হয়তো নিজের অজান্তেই "অন্যকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোনও নির্দিষ্ট সংস্কৃতি, পোশাক বা অন্যের চরিত্রে অভিনয়” করে যাচ্ছেন আজীবন। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই না বুঝে, না জেনে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি অন্ধের মত অন্যের চরিত্রে অভিনয় করে যায়, নিজের সত্তাকে তারা চিনে না, নিজেকে কখনোই আবিষ্কার কতে পারে না। একজন মানুষ হিসেবে নিজে আবিষ্কার করা অতীব জরুরি। নিজেকে, নিজের কার্যপ্রণালীকে মূল্যায়নের মাধ্যমে নিজেকে আবিষ্কার করুন।

শুরুতেই বলেছি, মুক্তচিন্তার প্রধান স্তম্ভই হলো প্রশ্ন করা এবং উত্তর খুঁজা। তাই কৌতূহলী হন। মুক্ত মনে চিন্তাভাবনা করুন এবং সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করুন। অন্যেরা আপনাকে সত্য বলে যা চালিয়ে দিতে চায় তা নির্বোধের মত গ্রহণ করবেন না, তবে এটি নিজে চিন্তা ভাবনা করুন, গবেষণা করুন। সর্বদা মনে রাখবেন যে কোন বিশ্বাস, সংস্কৃতি বা জ্ঞান বাই-ডিফল্ট-রূপে আপনি গ্রহণ করতে পারেন না। যে বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ধর্ম বা সমাজ প্রশ্ন করাকে নিরুৎসাহিত করে তা মূলত মুক্তচিন্তার চেতনা ধ্বংস করতে চায়। ধর্মপ্রচারক, রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য প্রভাবশালী দ্বারা ব্যবহৃত প্রথম পদক্ষেপটি হল সকল অজ্ঞাত, অজানা প্রশ্নের বিপরীতে অদৃশ্য শক্তি দাড় করিয়ে দেয়া বা পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য সরবরাহ করা। যা থেকে আপনি আদৌ কিছু শিখতে পারবেন না। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ধরেই নিয়েছে যে কোন ধরণের প্রশ্ন, যাচাই-বাছাই ছাড়াই আপনি তাদের সরবরাহ করা জ্ঞান, তথ্য গ্রহণ করেই যাবেন। একটা কথা পরিষ্কার করি, প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তি হওয়ার অর্থ এই নয় যে আপনি ধর্মীয় হতে পারবেন না; যতক্ষণ না আপনি নিজের দাবির সপক্ষে যুক্তি তথ্য প্রমাণ পেয়ে যাবেন ততক্ষণ আপনার অবলম্বন-কৃত বিশ্বাস, ধর্মই সত্য। স্মরণ রাখবেন, আপনার ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমর্থন করার জন্য আপনি অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হননি, এবং নিজের যুক্তির বিচারে আপনার ধর্ম বিশ্বাসে অটুট আছেন। জিরো গ্রাভিটিতে এসে নিরপেক্ষ ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করবেন, নিজের মত, বিশ্বাস, ধর্ম বা সংস্কৃতিকে সত্য প্রমাণের জন্য নয়।

নিজের বিশ্বাসকেই যদি সত্য প্রমাণ করতে হয় তবে আরব্য রজনীর উপন্যাসেও বিজ্ঞান খুঁজে পাবেন, ঠাকুরমার ঝুলির মধ্যেও যুক্তি খুঁজে পাবেন। বুঝে নিবেন আপনি কুযুক্তিতে আশ্রয় খুঁজছেন, ফ্যালাসিতে ভুগছেন।

আমার পথ, আমার মতই একমাত্র সত্য, বাকী সব বাতিল…এই ধরণের স্বৈরাচারবাদ থেকে সরে আসুন। কর্তৃত্ববাদবাদের ধারণাগুলি প্রায়শই কুযুক্তি দিয়ে ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। আইনি ও নৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত তবে কিছু ব্যক্তি তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে চান এবং তাদের পদক্ষেপকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য কর্তৃপক্ষ হিসাবে তাদের অবস্থানকে ব্যবহার করে কুযুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। নিজে এমন হবেন না এবং এইধরনের ব্যক্তিকে সতর্ক ভাবে এড়িয়ে চলবেন। নিজের যুক্তি, বিশ্বাস, ধারণা অন্যের উপর চাপিয়ে দেবেন না, তা চাপিয়ে দিতে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করবেন না। মানুষকে পরাস্ত করুন যুক্তিতে, প্রমাণে। মুক্তচিন্তক হিসেবে আপনার একমাত্র অস্ত্র যুক্তি।

যুক্তিতে কথা বলা শিখুন, যুক্তি প্রয়োগ করা শিখুন। অনেকগুলি সাধারণ যুক্তি আপনার জীবনে অতি সাধারণ বিষয়গুলি বুঝতে সহায়তা করবে, ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজের কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে আপনাকে সহায়তা করবে। কুযুক্তি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি কি তা জানুন, এতে নিজের যুক্তি প্রয়োগের অবস্থান মজবুদ হবে এবং অন্যের হাস্যকর কুযুক্তি বুঝতেও সুবিধা হবে। পরবর্তীতে এই বইয়ে পুরো একটি অধ্যায় আপনার জন্য থাকছে লজিক্যাল ফ্যালাসি বা কুযুক্তির বিশ্লেষণ নিয়ে।

সর্বোপরি মুক্ত-চিন্তাভাবনা উপভোগ করার চেষ্টা করুন। বেশি শুনুন, তারও বেশি পড়ুন, আর তারচেয়েও কম বলুন। বলার সময় স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনা করুন। যারা যুক্তি বুঝে না, লজিক্যাল ফ্যালাসি বুঝে না, বিশ্বাস কুসংস্কার দ্বারা প্রভাবিত এমন আহাম্মকদের সাথে তর্কে জড়াবেন না, তারা আপনাকে উলটো হাস্যকর বানিয়ে দেবে। মার্ক টোয়ান চমৎকার একটি কথা বলে গিয়েছেন এ সম্পর্কে, “Never argue with an idiot. They will drag you down to their level and beat you with experience.”

একজন মুক্তচিন্তক হিসেবে আপনার প্রধান কাজের একটি পর্যবেক্ষণ। সামাজিক পর্যবেক্ষক হিসেবে আপনি আপনার পারিপার্শ্বিক সমাজ, গোষ্ঠী, বিশ্বাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করুন। যুক্তি তর্কে জড়াবেন তারই সাথে যে ন্যূনতম বিজ্ঞানমনস্ক, যে যুক্তি বুঝে এবং যুক্তিতে কথা বলে, এবং সর্বোপরি যে আক্রমণাত্মক নয়।

এনামুল হক এনাম, কলামিস্ট, সাহিত্যিক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ