আজ শনিবার, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৩

Advertise

করোনাভাইরাসের বর্তমান অবস্থায় যা জানা দরকার, যা করা দরকার

ড. শামীম আহমেদ  

বর্তমান অবস্থা
করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত বিশ্বে সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ কোটি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে মৃত্যু হয়েছে এখন পর্যন্ত ২৮ লক্ষ মানুষের। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছে প্রায় ১০ কোটি মানুষ। বর্তমানে আক্রান্ত আছে প্রায় ২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ। জানুয়ারি ২০২০ থেকে এখন পর্যন্ত যেই ড্যাটা পাওয়া যায় তা দেখলে বোঝা যায় আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর হারের যে গ্রাফ তা ঊর্ধ্বমুখীই আছে, নিম্নমুখী হয় নাই। অর্থাৎ আক্রান্ত হচ্ছেই, মৃত্যু হচ্ছেই।

বাংলাদেশের অবস্থা
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ। মারা গেছে প্রায় ৯ হাজার মানুষ। বর্তমানে আক্রান্ত আছে ৫ হাজারের বেশি মানুষ। গতকাল মারা গেছে ৪৫ জন মানুষ। বিশ্বের চাইতে বাংলাদেশের গ্রাফের ঊর্ধ্বগতি খানিকটা কম। জনসংখ্যা এবং দেশের আয়তনের তুলনায় সেটি আরও কম বলা যায়। অর্থাৎ বেশিরভাগ দেশের চাইতে আমাদের অবস্থা খারাপ- এটা বলা যাবে না।

ভ্যাক্সিনে সংক্রান্ত অবস্থান
ভ্যাক্সিন এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি। কিন্তু যেহেতু সবগুলো ভ্যাক্সিনই ন্যূনতম ২টি ডোজ লাগে তাই আসলে মোটামুটি ১৫-২০ কোটির মত মানুষ ভ্যাক্সিনের ডোজ শেষ করেছে, অন্যরা অন্তত ১টি ভ্যাক্সিন পেয়েছে। ভ্যাক্সিন দেয়ায় অগ্রগামী আছে ইজরায়েল। তাদের সর্বমোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের ভ্যাক্সিনেশন শেষ হয়েছে। অর্থাৎ ইজরায়েলের অর্ধেক মানুষ ২টি করে ভ্যাক্সিন নিয়ে ফেলেছে। ইজরায়েলের পর যে দেশগুলো মোটামুটি এগিয়ে রয়েছে তারা হলো সিসিলি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চিলি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, হাংগেরি ইত্যাদি। এদের ২০-৪৫ শতাংশ জনগণ ভ্যাক্সিনের অন্তত একটি ডোজ নিয়েছে। বাংলাদেশের এখনও বহুদূর যেতে হবে।

ভ্যাক্সিন নিতেই হবে
এখন পর্যন্ত ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাক্সিনকে সবচেয়ে নিরাপদ ধরা হচ্ছে। এগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। এস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিন করোনাক্রান্ত মানুষকে মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তি থেকে বেশ সফলভাবে বাঁচাতে পারলেও এর কিছু পার্শপ্রতিক্রিয়া আছে যার জন্য অনেক দেশেই এর ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে। তবে উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ দেশে এস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিন ছাড়া গত্যন্তর নেই। এটিই নিতে হবে। অন্যদিকে চায়না ও রাশিয়ার ভ্যাক্সিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত নয় এবং উক্ত রাষ্ট্রগুলোর অনুগত রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কেউ এসব ভ্যাক্সিন ব্যবহার করছে না। যেমন পাকিস্তান চায়নার ভ্যাক্সিন ব্যবহার করছে। এছাড়াও সারা বিশ্ব জনসন ও জনসন ভ্যাক্সিনের জন্য অপেক্ষা করছে।

করোনাভাইরাসে ‘হার্ড ইমিউনিটি হবে না’
করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক মহামারি হওয়াতে এর কোন “হার্ড ইমিউনিটি” হবে না। সাধারণত একটি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যদি ৮০ শতাংশ মানুষের একটি রোগ হয়ে যায়, এবং ওই এলাকায় বাইরে থেকে কেউ না ঢোকে এবং ভেতর থেকে কেউ বের না হয়, তাহলে বাকি ২০ শতাংশের আর ওই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে সব দেশের মধ্যেই ব্যাপক যোগাযোগ আছে ফলশ্রুতিতে একটি দেশের ৮০ শতাংশ মানুষের যদি ওই রোগ হয়েও যায় বা ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাক্সিন দেয়া হয়, তবুও বাকি ২০ শতাংশের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।

একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০ কোটি। এর ৮০ শতাংশ মানুষের হয় করোনা হয়ে গেছে বা ভ্যাক্সিন নেয়া হয়েছে, অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষের হয় করোনা হয়ে গেছে অথবা ভ্যাক্সিন নেয়া হয়ে গেছে। তাহলে কি বাকি ৪ কোটি মানুষ নিরাপদ? নাহ। কারণ হচ্ছে,
১. যাদের করোনা হয়ে গেছে বা ভ্যাক্সিন নেয়া হয়েছে, তাদের আর করোনায় মৃত্যু সম্ভাবনা কম থাকলেও আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায় এবং তারা তখন বাকি ৪ কোটি মানুষ যাদের করোনা হয়নি, বা ভ্যাক্সিন নেয়া হয়নি, তাদের যে কাউকে আক্রান্ত করতে পারবে।

২. যুক্তরাজ্য থেকে একজন ডাক্তার তার বোনের বিয়ে খেতে চট্টগ্রামে গেলেন। এখন উনি যদি বিমানে করে করোনা নিয়ে আসেন, তাহলে দেশের ওই ৪ কোটি অনাক্রান্ত মানুষের যে কাউকে তিনি করোনায় আক্রান্ত করতে পারেন।

৩. যশোর থেকে মনজুর হাসান রিজন কবুতর আনার জন্য বেনাপোল বর্ডার দিয়ে কলকাতায় গেল। আসার সময় কলকাতা থেকে করোনা নিয়ে আসল।

এই তিনটিসহ আরও নানা কারণে অনাক্রান্ত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। সুতরাং করোনায় ‘হার্ড ইমিউনিটি’ হবে না।

করোনাভাইরাসের উৎস কোথায়?
করোনাভাইরাস কোথা থেকে আসল? এখন পর্যন্ত এর কোন সঠিক উত্তর বিজ্ঞানীরা দিতে পারেনি, অথবা রাজনৈতিক কারণে দেয়নি। উৎস না জেনেই যে ভ্যাক্সিন তৈরি হচ্ছে তা যে সম্পূর্ণ কার্যকরী হবে না, এটি সহজেই অনুমেয়। আজকেই একটি অপ্রকাশিত রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তদন্ত কমিটির ৪টি অনুমানের কথা জানা গেছে:
১. করোনাভাইরাস বাদুড় থেকে অন্য একটি প্রাণীর শরীর হয়ে মানুষের শরীরে এসেছে। অর্থাৎ হয়ত বাদুড় থেকে মাছে গেছে, মানুষ সেই মাছ খাওয়ায় তার কাছে এসেছে।

২. করোনাভাইরাস বাদুড় থেকে সরাসরি মানুষের শরীরে এসেছে। হয়ত বাদুড় কোন মানুষকে আঁচড়ে বা কামড়ে দিয়েছে, সেখান থেকে ছড়িয়েছে।

৩. কোন একটি দেশের ঠাণ্ডা ও প্রক্রিয়াজাত খাবার প্যাকেটে করে চায়নার উহানে এসেছে, সেটি খাওয়ার পর মানুষের শরীরে ছড়িয়েছে।

৪. উহানের ল্যাবরেটরিতে দুর্ঘটনার মাধ্যমে ছড়িয়েছে।

এর মধ্যে চায়না বলছে এটি মূলত অন্য দেশ থেকে প্যাকেট করা ঠাণ্ডা খাবারের মাধ্যমে উহানে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে সম্ভবত বাদুড় থেকে অন্য প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের শরীরে এসেছে। কিন্তু অনেকেই বলছেন এটি মূলত কীভাবে ছড়িয়েছে আমরা সহসা জানতে পারব না বা আমাদের জানতে দেয়া হবে না।

এখন করণীয় কী?
অনেক তাত্ত্বিক কথা বললাম। এবার মূল কথা। গুরুত্ব অনুযায়ী কোন কাজগুলি করবেন বলে দিই ক্রমানুসারে -
১. সুযোগ পেলেই ভ্যাক্সিন নিয়ে নেয়া। ফাইজার, মডার্না বা এস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড যেটা পাওয়া যাবে সেটাই নিয়ে নিতে হবে। এই তিনটি ভ্যাক্সিন একটি আরেকটির চাইতে কম বা অধিক কার্যকরী হলেও, তিনটি ভ্যাক্সিনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঠেকাতে যথেষ্টই কার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

২. দূরত্ব বজায় রাখা। করোনাভাইরাস মূলত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় সুতরাং যতটা পারা যায় মানুষের সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকতে হবে। দূরত্ব না থাকলে যেকোনো জায়গায়ই ঝুঁকিপূর্ণ । আপনি কক্সবাজারে বেড়াতে গেলে সেটি ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু কড়াইল বস্তিতে থাকলে সেটি নিরাপদ অথবা বিশ্ব ব্যাংকে অফিস করলে সেটি নিরাপদ, ব্যাপারটা এমন নয়। ভাইরাস বোঝে না আপনি বেড়াতে গিয়েছেন নাকি অফিস করতে গিয়েছেন। সুতরাং দূরত্ব বজায় রাখুন।

৩. মাস্ক পরা। দূরত্ব বজায় না থাকলেও যদি মাস্ক পরা থাকে, তবে কিছুটা প্রতিরোধ হয়। নিজে মাস্ক পরুন, অন্যকেও মাস্ক পরতে উৎসাহিত করুন। কেউ মাস্ক না পরলে তাকে অল্প অল্প লজ্জা দিন।

৪. হাত ধুয়ে নিন, মুখে হাত দেবেন না। কিছু স্পর্শ করলে হাত ধুয়ে নিন। যেমন বাসের হাতল, রিকশার হুড, অফিসে কলিগের টেবিল, বন্ধুর মোবাইল ইত্যাদি। সামর্থ্য থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন।

এর বাইরে প্রচুর দোয়া করতে পারেন। পৃথিবীতে এখনও ৭০০ কোটি মানুষের ভ্যাক্সিন দেয়া বাকি। ভ্যাক্সিন ছাড়া সবকিছুই আসলে টোটকা পদ্ধতি। আগে আমরা অনেকেই অনেক কিছু অবলম্বন করতে বলেছি। কিন্তু একবছরে যেহেতু অনেক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাই এখন উপরের ৪টি সতর্কতা অবলম্বন করতে বললাম, পারলে অবলম্বন করবেন। আর মানুষকে দোষারোপ করা বন্ধ করে নিজে সতর্ক থাকুন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

ড. শামীম আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক-বিজ্ঞান গবেষক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩১ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪০ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬০ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ৯৯ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ২৭ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২২ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৫ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৪ রাজু আহমেদ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ

ফেসবুক পেইজ