আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

চার কারণে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ভারতের মতো হবে না

ড. শামীম আহমেদ  

দীর্ঘদিন বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে মনে করি বেশ কয়েকটি কারণে আমাদের করোনা পরিস্থিতি ভারতের মতো হবে না। আমাদের দেশের করোনা পরিস্থিতি চিন্তা করতে গেলে আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে। মানুষের ও নীতিনির্ধারকদের আচরণগত স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের প্রয়োগ করতে হবে। শুধুমাত্র পরিসংখ্যান ও গ্রাফ-চার্ট দিয়ে করোনা ব্যাখ্যা করতে গেলে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যাবে না।

আসুন সামাজিক বিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্যের ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় দেখি কেন বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি ভারত থেকে ভিন্ন হতে পারে।

১) গ্রামীণ অর্থনীতির বৈচিত্র্যময়তা: ঢাকা থেকে যেসব শ্রমজীবী মানুষ রোজার ইদে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান, তাদের একটা বড় অংশ সহসাই আবার ঢাকায় ফিরে আসেন না। দীর্ঘদিন মঙ্গা নিয়ে গবেষণা করার সময় দেখেছি ঢাকার অনেক শ্রমজীবী মানুষ যারা রিকশা, ভ্যান চালান, শহরের রাস্তাঘাটে খুচরো জিনিসপত্র (ছাই থেকে চুড়ি) ফেরি করেন, ঝালমুড়ি, বাদাম বিক্রি করেন, ফুটপাথে কিংবা রাস্তার পাশে মুদি দোকান চালান, ঘর-বাড়িতে কাজ করেন, ক্ষুদ্র শিল্পভিত্তিক কারখানায় কাজ করেন; তারা রোজার ইদে গ্রামে গেলে অনেক সময় কোরবানির ইদ পর্যন্ত ঢাকায় ফেরেন না।

মধ্যবর্তী এই দুই-আড়াই মাস গ্রামে-গঞ্জে অনেক কাজ থাকে, ওই সময়ে জমিতে কাজ করলে অনেকক্ষেত্রেই ঢাকার চাইতে বেশি মজুরি পাওয়া যায়। এছাড়া অনেকের গ্রামে নিজস্ব জমি থাকে, সেখানে কাজ করলে, নিজের বাড়িতে থেকেই কাজ করা যায়, ঢাকায় ভাড়া দিতে হয় না। নিজের জমি না থাকলেও অন্যের জমিতে কাজ করলে বা গ্রামে রিকশা বা ভ্যান চালালেও আয় অনেক সময় ঢাকার চাইতে বেশি আয় না হলেও খরচ যেহেতু অনেক কম হয়, তাই অনেকেই পরিবারসহ এই সময়টা গ্রামেই কাটিয়ে আসতে চান। অনেকে এই সময়টা দেশে যেয়ে বিয়ে করেন, গ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য দেখেন, ফলে এদের অনেকেই ঢাকায় ফিরতে একটু সময় নেবেন। ফলে, সংক্রমণ কম ছড়ানোয় সেটা ভূমিকা রাখতে পারে।

২) কেন্দ্রীয় সরকার ভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা: বাংলাদেশের সরকার একটি কেন্দ্র সরকার। আমেরিকা, ক্যানাডা কিংবা ভারতের মতো আমাদের দেশে নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকার নেই। ভারত, আমেরিকাসহ অনেকে দেশে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির পেছনে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে প্রাদেশিক সরকারের সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বয়হীনতা। এইসব দেশের একেক রাজ্যের সরকার একেকভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মহামারীতে তারা সমন্বিতভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা দেখেছি আমেরিকার নিউ ইয়র্কে যখন অবস্থা খুব খারাপ তখন অন্য প্রদেশ থেকে অক্সিজেন বা ভ্যান্টিলেসন সাপোর্ট যথাসময়ে পাওয়া যায়নি। ক্যানাডার অন্টারিও সরকারের আহ্বানে ট্রুডোর কেন্দ্রীয় সরকার সাড়া না দেয়াতে প্রাদেশিক সরকারের প্রধান ডগ ফোর্ডকে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে হয়েছে। ভারতেও নানা রাজ্যের সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছিল প্রকট; এমনকি দেশের করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতার মধ্যে বাংলায় নির্বাচন হয়েছে, জনসভা হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে এক সরকার ব্যবস্থা এবং সমস্ত দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় নানা দুর্বলতা থাকলেও সমন্বয়হীনতা তুলনামূলকভাবে কম। ফলে বিভাগভিত্তিক বা জেলাভিত্তিক বিপর্যয় এখানে প্রকট হবে না বলে ধারণা করি।

৩) ভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভারত ভ্যারিয়েন্ট শুরুর দিকেই চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ফলে সেটি পুরো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে এমনটা মনে করছি না।

৪) ভ্যাক্সিনেসনে এগিয়ে থাকা: বিশ্বের অনেক দেশ যখন ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে কোন চুক্তিই করেনি, বাংলাদেশ তখন সারা দেশে ভ্যাক্সিনেসন শুরু করে দিয়েছিল। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শহরকেন্দ্রিক একটি বড় জনগোষ্ঠী যারা রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারত, তারা ভ্যাক্সিন নিয়ে নিয়েছে। সুতরাং আমি ধারণা করছি এখন ভ্যাক্সিনের সরবরাহ কম থাকলেও শুরুর দিকে একটি নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা নেবার কারণে আমাদের এখানে করোনা প্রতিরোধে বেশ কিছুটা অগ্রগতি হয়ে গিয়েছে।

সার্বিকভাবে বলতে পারি ১৭ কোটি মানুষের দেশে বেশিরভাগ মানুষকে ভ্যাক্সিন দিতে আরও বহু মাস লাগলেও, আপাত দৃষ্টিতে আমরা অন্তত ভারতের মতো বিপর্যয়ে পড়ব না বলেই মনে হচ্ছে। তবে নিঃসন্দেহে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোর হারই নানাধাপে বাড়বে এবং আবার পর্যায়ক্রমে কমে আসবে। ততদিন পর্যন্ত যত বেশিসংখ্যক মানুষকে ভ্যাক্সিন দেয়া যায় ততই মঙ্গল। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নেয়াও সমানভাবে জরুরি।

ড. শামীম আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক-বিজ্ঞান গবেষক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ