আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

মানুষই কেন পৃথিবীর বুকে টিকে যাওয়া একমাত্র প্রজাতি?

এনামুল হক এনাম  

বিবর্তনবাদে শুধু মনুষ্য জাতিই কি যোগ্য হিসেবে পৃথিবীতে টিকে গেল! তৎসময়ে কি মানুষের পূর্ব পুরুষ ছাড়া দু-পায়ে দাঁড়ানো আর কোন প্রজাতির উদ্ভব হয়নি?

যদি হয়ে থাকতো তবে সেই প্রজাতিগুলো কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো? হারিয়ে যাওয়া সেইসব প্রজাতিগুলো কি ছিলো? আর কেনই বা তারা হারিয়ে গেল?

মাত্র কয়েক যুগ আগেও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর মানুষের কাছে ধোয়াশাচ্ছন্ন ছিলো। ডারউইন প্রচুর তথ্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করলেও কিছু Missing Links সবাইকে বিভ্রান্ত করছিলো। বিজ্ঞান সেযুগে ঠিক ততটা উন্নতও ছিলো না। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের যথেষ্ট পরিমাণ অগ্রগতি, ডিএনএ বিশ্লেষণের সুযোগ, নতুন নতুন ফসিল আবিষ্কার মানুষের সামনে খুলে দিয়েছে জ্ঞানের ভাণ্ডার, অনেক প্রশ্নের উত্তর যা এক সময়ে ছিলো সম্পূর্ণ অজানা তাও বর্তমানে হয়েছে সহজ বোধ্য।

হ্যাঁ, দু-পায়ে এই পৃথিবীর পথে হেঁটে বেড়ানো প্রাণি আমরা একা ছিলাম না। মনুষ্য সাদৃশ্য আরও কিছু প্রজাতি ছিলো যারা নিজ বুদ্ধিতে, কর্মে এই পৃথিবীতে বেঁচে ছিলো হাজার বৎসর। দু-পায়ে হাটা Ape Like Creature বা উল্লুক সাদৃশ্য প্রাণিগুলো আজ থেকে প্রায় ছয় মিলিয়ন বৎসর আগে আফ্রিকা থেকে হেটে হেটে ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর বুকে। এইসব প্রাণির অনেক উত্তরসূরি ছিলো, যাদের প্রায় সবাই ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেলে মানুষের পূর্বসূরিরাই আফ্রিকায় রাজত্ব করেছে আফ্রিকা জুড়ে।

বিলীন হয়ে যাওয়া এমনি কয়েকটি প্রাণির মধ্যে একটি Homo ergaster (হোমো ইরগাস্টার), যারা ছিলো শিকারি এবং জানতো হাতে তৈরি পাথর বা কাঠের অস্ত্রের ব্যবহার। প্রাপ্ত ফসিলের হাড়ের নিরীক্ষণে জানা যায় এই অপ্রজাতি খুবই দ্রুত দৌড়াতে পারত, এতটাই দ্রুত যে বর্তমান সময়ের অলিম্পিক জয়ী যেকোনো দৌড়বিদকে তারা চোখের নিমিষেই হারিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখতো। দৌড় দক্ষতার কারণ? “শিকার” করা এবং নিজে যাতে হিংস্র প্রাণি দ্বারা শিকার না হয় সেই জন্যই ছিলো এই পারদর্শিতা। Homo ergaster রা আফ্রিকার ঘন জঙ্গল এলাকা বা রেইনফরেস্ট এলাকায় বসবাস করতো। অতিমাত্রায় তাপমাত্রার তারতম্য, খাদ্য সংকট, এলাকার মরুকরণের পরও এই প্রজাতি বহু শতাব্দী পর্যন্ত পরিবেশ প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পেরেছিল। এদের শরীর অপেক্ষাকৃত কম রোমশ ছিল, তাই গরমকালে ঘর্মাক্ত শরীরে আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে পারতো। এরা সাধারণত দিনের মধ্য ভাগে খাদ্য সংগ্রহের জন্য শিকারে বের হত, যখন বড় বড় প্রাণিগুলো বিশ্রামে থাকে। মাংসাশী এই Homo ergaster প্রথম আফ্রিকা থেকে এশিয়াতে এসে নিজেদের বংশ বিস্তার করে।

এশিয়াতে নতুন পরিবেশ প্রকৃতিতে Homo ergaster এর মানসিক এবং শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তনে বিবর্তিত রূপ Homo erectus (হোমো ইরেক্টাস)।  প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে Homo erectus তৎকালে তুরস্ক থেকে চীন অবধি ছড়িয়ে গিয়েছিল। এরা নিজেদেরকে ছোট ছোট শিকারি দলে ভাগ করে শিকারের সন্ধানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বসতি স্থানান্তর করতো। এদের দেহ অনেকটাই আধুনিক মানুষের মত দেখতে ছিল।

সুপার ভলকানো বা বৃহৎ আগ্নেয়গিরির প্রভাব: সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায় হোম সেপিয়েন্স আফ্রিকা ছেড়ে যায় প্রায় ১লাখ ২০হাজার বছর পূর্বে। শ’খানেক জনের দলে দলে ভাগ হয়ে তারা ছড়িয়ে যায় এশিয়া হয়ে ইউরোপে। একটি দল ভারতের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকে। সদ্য প্রাপ্ত ফসিলগুলোও এ তথ্য দারুণ ভাবে সমর্থন করে। ৭৪হাজার বছর আগে তোবা পর্বতের বৃহৎ আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ মানুষের এই পথ চলায় প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণটি তৎকালের ২লক্ষ বছরের মধ্যে সর্ব বৃহৎ ছিলো। আগ্নেয়গিরিটি প্রচুর পরিমাণ সালফার আকাশে ছড়িয়ে সূর্যকে ঢেকে দিয়েছিলো দীর্ঘ সময়ের জন্য, যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেশ কয়েক ডিগ্রি নিচে নেমে আসে। আগ্নেয়গিরি ছাই তোবা পাহাড় থেকে ছড়িয়ে পুরো এলাকাকে ঢেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে যা বাতাসে উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় যা আজও ভারত বর্ষ পাওয়া যায়।  

তোবা পর্বতের আগ্নেয়গিরির প্রভাবে এই এলাকার আদি মানবদের জীবন ও জীবিকায় পরিবর্তন হয়েছিলো। পরবর্তী ৪০হাজার বছর সময়ে এই পরিবর্তন আমাদের আধুনিক মানুষ হতে সহায়তা করে। মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বি প্রজাতিগুলো এ সময়ে আবহাওয়ার প্রতিকূলতায় টিকতে না পেরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।    

প্রতিদ্বন্দ্বিতা: হোমো ইরেক্টাস (Homo erectus) আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens) থেকে আকৃতির দিক দিয়ে কিছুটা বড় এবং অধিক শক্তি সম্পন্ন ছিল। তাহলে কেনো হোমো ইরেক্টাস বিলুপ্ত হয়ে গেল আর মানুষ টিকে গেল পৃথিবীতে? উত্তর সহজ... মগজ। মানুষের পূর্ব পুরুষদের মগজ ছিলো অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির, তাই বুদ্ধি এবং বেঁচে থাকার নতুন নতুন উপায় আবিষ্কারের ক্ষমতা ছিলো অন্য প্রজাতিগুলো থেকে অনেক বেশি। হোমো ইরেক্টাস এবং হোমো সেপিয়েন্স এর মাথার খুলি পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন। মানুষের পূর্ব পুরুষ হোমো সেপিয়েন্সদের নিজেরদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ভাষার উদ্ভব এ প্রজাতিকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। যার ফলে তারা মত বিনিময়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করেছিলো এবং পরিকল্পনায় ছিলো অপ্রতিরোধ্য। এ সময়ে নতুন নতুন হাতিয়ার আবিষ্কার এবং অস্ত্রের ব্যবহার মানুষকে করে তুলে অদম্য। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে তারা ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীময়। প্রাপ্ত ফসিলে দেখা যায় একই সময় হোমো ইরেক্টাসের ব্যবহৃত হাতিয়ার ছিলো অতি সাধারণ এবং শিকারে অকার্যকর।

নিয়াডারথাল?
প্রযুক্তি উন্নতি সাধন এবং পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা একই সময়ে মানুষের পূর্ব পুরুষকে এগিয়ে রেখেছিলো আরেক প্রতিদ্বন্দ্বি নিয়ানডারথাল থেকে। নিয়ানডারথালরা ৩০হাজার বছর আগে বরফ যুগের সময়ে খাদ্যাভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। হোমো ইরেক্টাসরাও প্রায় ৩০হাজার বছর আগে বিলুপ্তির পথে হাটে। যারা তাদের বংশধর রেখে যায় ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপপুঞ্জে। প্রাপ্ত ফসিলে প্রমাণিত তারা ছিলো হোমো ইরেক্টাসের বংশধর, বিজ্ঞানীরা যাদের নাম দিয়েছেন হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস (Homo floresiensis), যাদের “হাবিট” বলেও ডাকা হয়। হাবিটই ছিলো সর্ব শেষ মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বি যারা ১২হাজার বছর পূর্বে সর্বশেষ প্রজাতি হিসেবে আমাদের রেখে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফ্লোরেস দ্বীপে ২০০৩সালে লিয়াংবোয়া গুহায় আবিষ্কৃত “হাবিট” প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন, অনেকেই মনে করেন এরা তৎকালে মানুষের পূর্ব পুরুষদের শিকারে পরিণত হয়েছিলো।

এনামুল হক এনাম, কলামিস্ট, সাহিত্যিক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ