আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

জল রাজনীতি, জলে সম্প্রীতি

আলমগীর শাহরিয়ার  

"তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
বাঙলা ভেঙে ভাগ করো !
তার বেলা?

ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা
জমিজমা ঘরবাড়ী
পাটের আড়ৎ ধানের গোলা
কারখানা আর রেলগাড়ী!
তার বেলা ?"

অন্নদাশঙ্করের এ ছড়াটি আজ খুব মনে পড়ছে। সাত চল্লিশে দেশভাগের পর বন্ধ হয়ে যায় পূর্ব বাংলার সঙ্গে পশ্চিম বাংলার সড়ক, রেল ও নৌ-পথ যোগাযোগ। কলোনিয়াল কন্সপিরেসি আর ধর্মাশ্রিত রাজনীতির ডামাডোলে বন্ধ হয়ে যায় একই ভাষা ও ভূগোলের মানুষের সুপ্রাচীন কাল থেকে অব্যাহত থাকা সাংস্কৃতিক লেনদেন। প্রচলিত থাকা যোগাযোগের পুরনো সব রুট আর বন্ধনগুলি।

নয়া সীমান্ত, বিভাজন রেখা, কাঁটাতার, জাতীয়তাবাদী নয়া চেতনা ও পরিচয়ে একই ভাষার মানুষের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব বাড়ে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা রায়টের বীভৎস ক্ষত, ভয়—ভূতের মত মনের কোণে থেকে যায় অনঅপসৃয়মান আবছায়া হয়ে। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের নয়া জিগিরে সীমান্ত সিলগালা হয়। ইতোমধ্যে ভাগ হয়ে পড়ে আসাম, সিলেটের করিমগঞ্জ; ভাগ হয় পাঞ্জাব, ভারতবর্ষ। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক পাঞ্জাবের সাদত হাসান মান্টো জন্মভূমি ছেড়ে লাহোরে ছুটেন, শিল্পী আব্বাসউদ্দীন কুচবিহারের কালজানি নদী আর কলকাতার স্মৃতি পেছনে ফেলে ঢাকায় পাড়ি জমান—নয়া বিশ্বাসী নিশানের ছায়াতলে। কিন্তু পেছনে নাড়িপোঁতা জন্মভূমি, শৈশব ফেলে যাওয়ায়—তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কি কোনদিন ফুরোয়? এরকম বাস্তুচ্যুত হন লাখো মানুষ। অল্প সংখ্যক বাই চয়েজ, বিরাট সংখ্যক বাই ফোর্স। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসে আমরা দেখি কলকাতায় বিক্রমপুরের মালখানগরের সম্পন্ন পরিবারের পরিচয় সংকটে পড়া প্রতাপ কিংবা অসহায়, নিঃস্ব হারিত মণ্ডলেরা রিফিউজি পরিচয়ে আমৃত্য দেশভাগের ক্ষত বয়ে বেড়ায়। আরও প্রান্তিক রিফিউজিরা যেতে বাধ্য হয় দূরে কোথাও দণ্ডকারণ্যে।

স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলে পশ্চিম বাংলার সঙ্গে রেল যোগাযোগ পুনঃস্থাপন হয়। দীর্ঘ সত্তর বছর পর ফের শুরু হচ্ছে বন্ধ থাকা নৌপথ যাত্রা। আজ শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় বিআইডব্লিউটিসির ক্রুজ শিপ ‘এমভি মধুমতি’ ঢাকার নিকটবর্তী নারায়ণগঞ্জের পাগলা ঘাট থেকে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করবে। একই দিনে ভারতের ক্রুজ শিপ ‘মেসার্স আর ভি. বেঙ্গল গঙ্গা’ কলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছাড়বে। নদী পথে যেতে যেতে পূর্ণিমা রাতে এপার বা ওপারের কোন সত্তরোর্ধ্ব যাত্রী যদি আনমনে আব্দুল আলীমের গাওয়া গান গেয়ে ওঠেন,

"সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই
বল আমারে তোর কি রে আর
কুল কিনারা নাই, কুল কিনারা নাই
ও নদীর কুল কিনারা নাই।।
পাড়ির আশায় তাড়াতাড়ি
সকাল বেলা ধরলাম পাড়ি
আমার দিন যে গেল সন্ধ্যা হলো
তবু না কুল পাই।।"

রাজনীতি-প্ররোচিত সাম্প্রদায়িক উন্মাদনায় ভাগ হয়ে যাওয়া একই দেশ, ভাষা, ভূগোল ফের যুক্ত হবে—অন্যভাবে। নিশ্চয়ই এ এক ঐতিহাসিক ক্ষণ। আবুল হাসানের কবিতা মনে পড়ে- "যতদূর থাকো ফের দেখা হবে। কেননা মানুষ যদিও বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক।"

বিভেদ বিভাজন নয়, ভাটির মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করে তিস্তার জল নিয়ে উজানে মমতাদির রাজনীতি নয়, কিংবা সীমান্ত রক্ষীর গুলিতে কুড়িগ্রামের দরিদ্র কিশোরী ফেলানির অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তে ঝুলে থাকা লাশ নয়, হঠাৎ বারুদের গন্ধে, আর গুলির শব্দে, বিকাশমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্তর্জালে ঘৃণার নয়া চাষবাস নয়; দুই বাংলার সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর মিলনই মৌলিক হোক। ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রী ও সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী শেখ হাসিনার শাসনামলে সত্তর বছর পর দুই বাংলার যোগাযোগে নৌ-পথ যাত্রা পারস্পরিক আস্থা ও সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আরেক মাইলফলক হয়ে থাকবে।

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ