আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

সুম্পিটারের উদ্যোক্তা, উদ্ভাবন এবং বাস্তবতা

অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী  

বিশ্ব যখন অতি মহামারির সঙ্কটে বিধ্বস্ত প্রায়, সে সময়ে উদ্ভাবন এবং উদ্যোক্তা উন্নয়ন অর্থনৈতিক গতিময়তার জন্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি আইএমএফের পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতকে ছড়িয়ে যাবে। এটি নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনার সুচিন্তিত কার্যক্রমের ফল। আসলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও অজানা শত্রু ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে। সাধারণ মানুষ লকডাউনে থাকার সময় দিবারাত্রি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং ভাইরোলজিস্টদের বক্তব্য শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। যদিও প্রতিটি মানুষেরই মাস্ক ব্যবহার করে নিজে, পরিবার, প্রতিবেশী ও সহকর্মী এবং ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষকে সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকা উচিত। তারপরও দেশের যে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে; সেক্ষেত্রে জোসেফ এ্যলুইস সুম্পিটারের বক্তব্য উদ্ভাবন করা একমাত্র কাজ, যেটি মৌলিক ইতিহাস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তিনি উচ্চারণ করেছিলেন যে, একজন উদ্যোক্তা পারে সর্বোত্তম ঘটনা ঘটাতে যা বর্তমানের ভিত্তিকে এগিয়ে নেয় আগামীকালের ভিন্ন নতুন উৎপাদন প্রক্রিয়া কিংবা ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্তি ঘটিয়ে থাকে। বর্তমান অতি মহামারির সময় অধিক হারে সুম্পিটারের বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য এ কারণে যে, আজকাল মুক্তবাজার অর্থনীতিতে, যুগোপযোগী উদ্ভাবনের মাধ্যমে ‘জীবন ও জীবিকার’ মধ্যে সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। এটি করতে গিয়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাংলাদেশের মৌলিক চিন্তা-চেতনা এবং প্রায়োগিক কলাকৌশল অনেক গুরুত্ব বহন করে চলেছে। জিডিপি এর প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একদিকে ধীরগতি, অন্যদিকে স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিক।

আইএমএফের পূর্বাভাসে বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল সময়েও মাথাপিছু আয় ৪% বৃদ্ধি পেতে পারে। এ জন্য অবশ্য নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হলেও সফল বাস্তবায়ন করা দরকার। অব্যর্থ নিশানায় সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধিকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যাদের ওপর বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের অবশ্যই হিসাব করে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এটি এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আরও বলশালী করবে বলে বিশ্বাস করি। মাথাপিছু আয়কে গতিময় এবং ইতিবাচকভাবে কাজ করতে হলে বৈষম্য হ্রাস, করোনাকালীন নতুন দারিদ্র্য সৃষ্টি রহিতকরণ এবং কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ক্রয়ক্ষমতা এবং সুষম বণ্টন ব্যবস্থার দিকে জোর দিয়ে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এ নীতিমালা বাস্তবায়নে এক ধরনের নিষ্ঠা মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ে বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে প্রয়োজন রয়েছে।

সুম্পিটারের অর্থনীতি একটি সময়ে বিস্তৃতভাবে মানুষের মৌলিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে পন্থা হিসেবে বিবেচিত হতো, যেখানে প্রচলিত অর্থনীতির সমালোচনা করেছিলেন তিনি। আজকাল অর্থনীতিকে ব্যাংকিং এবং ব্যাংকবহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে অর্থায়ন এবং ঋণ সঙ্কটের সঙ্গে সমান্তরালে লড়াই করে জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বায়ন এবং স্বল্প সম্পদকেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদ্ভাবন এবং উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে সুম্পিটারের সবচেয়ে বড় অবদান। এদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে কেউ কেউ মাস্ক তৈরি করেছেন, গোপনে অর্থ সাহায্য করেছেন এবং কোন কোন স্থানে পচনশীল শাকসবজি বিতরণ করেছেন লকডাউনের সময়ে, যখন সরবরাহজনিত সমস্যার জন্য একস্থান থেকে অন্যস্থানে পক্ষ প্রেরণ করা যেত না। আবার একটি জেলায় সিভি ব্যাংক তৈরি করে চাকরির উদ্যোগ নিয়েছেন। এগুলোকে উদ্ভাবন বলা চলে।

সুম্পিটার তার লেখনীতে মূলত উদ্ভাবনের ভূমিকা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করেছেন। অবশ্য উদ্ভাবন বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোক্তা সম্পর্কে সুম্পিটার তার ধারণা সুস্পষ্ট ও বিবর্তিত করেছিলেন। ১৯১২ সালে তিনি যে মতামত তুলে ধরেছিলেন ‘থিওরি অব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট’ গ্রন্থে, পরবর্তীতে অবশ্য তার প্রাথমিক ধারণা থেকে সরে এসেছিলেন। তিনি নতুন সংমিশ্রণকারী উদ্যোক্তাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে মতামত দিয়েছিলেন এবং এক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড মূলক পরিবর্তনের ঘটনাপ্রবাহকে মূল কার্যকরণ হিসেবে অর্থনৈতিক বিকাশকে অভিহিত করেছিলেন, যেটি তার অর্থনৈতিক মডেলে স্থিতাবস্থা থেকে মুক্ত করে বরং সার্কুলার ফ্লোর মাধ্যমে গতিময় পথের উল্লেখ করেছিলেন।

বস্তুত এদেশে ২০০৯ থেকে করোনার পূর্ব পর্যন্ত যে অদম্য গতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে, যেখানে গ্রামীণ অঞ্চল রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ কারণে যে সরকার নানামুখী ব্যবস্থাপনায় ২০০৯ থেকে জনমানুষের অর্থনীতির গতি প্রকৃতিকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট ছিল। অবশ্য সুম্পিটার তিন দশক পরে ‘ক্যাপিটালিজম, সোশ্যালিজম এবং ডেমোক্রেসি’ গ্রন্থে গতিশীল মূলধন ব্যর্থ হয় বলে অভিহিত করেন এবং পুঁজিবাদী উদ্যোগের কারণে একচেটিয়া কারবারের সৃষ্টি হয় এবং উদ্যোক্তাদের অন্তর্ধান শেষ পর্যন্ত ঘটতে পারে বলে মনে করেছিলেন। যদিও সে সময়ে অনেকে সুম্পিটারের পরিবর্তিত সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক সমস্যা যা আমেরিকায় শুরু হয়েছিল, পরবর্তীতে ইউরোপে স্থানান্তরিত হয় এবং এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের সূচনা হয়, তখন আবার সুম্পিটারের শেষোক্ত গ্রন্থের বক্তব্য পরিস্ফুট হয়। এমনকি বর্তমান মহামারির সময়েও বিশ্বায়নের ব্যর্থতা এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে লোকবল উৎসারিত হওয়া। সবক্ষেত্রে স্থানীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার সুনিশ্চিত করত, অর্থনীতির উন্নয়নে গতিময়তা আনয়নের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়টি গুরুত্ব পায়, যা উদ্ভাবনী শক্তি দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমস্যা মোকাবেলায় সক্ষম হবে। হয়ত বিশাল ক্লাউড কম্পিউটিং সম্ভব নয়, কিন্তু স্থানীয় মানুষের প্রয়োজনে উদ্ভাবনী শক্তির নিয়ামক হিসেবে কাজ করলে অস্থায়ী উদ্যোক্তাদের স্থানে নতুন উদ্যোক্তাদের আবির্ভাব ঘটবে এবং একচেটিয়া কারবারির ন্যায় করা পুঁজিবাদী উদ্যোক্তাদের সর্বগ্রাসী আচরণ কিছুটা হলেও সংহত করা যেতে পারে।

সুম্পিটার উদ্ভাবনাকে তুলনা করেছেন ভোক্তার পছন্দের সঙ্গে যাতে সেগুলো উল্লিখিত আছে এবং সেগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাওয়া যাবে না। এতে অর্থনৈতিক পরিবর্তন কারণ হিসেবে বিবেচিত না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তিনি মনে করতেন যে, ঐতিহ্যগত কারণে কাঠামোগত পরিবর্তন প্রক্রিয়ার বিকাশ উদ্ভাবন দ্বারা পরিচালিত, যেটি পাঁচটি ধারণার ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে: একটি নতুন পণ্য বা ইতোমধ্যে পরিচিত পণ্যকে নতুন প্রজাতির মাধ্যমে প্রবর্তন করা, কোন পণ্য উৎপাদন বা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে নতুন কোন পদ্ধতি প্রয়োগ করা। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, অতি মহামারির সময়ে সব ব্যবসা কমে গেলেও অনলাইনের ব্যবসা এবং ইন্টারনেট ব্যবসায় নিদারুণ গতিময়তা দেশে-বিদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন বাজারের সম্প্রসারণ, কাঁচামাল বা আংশিক সমাপ্ত পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে নতুন উৎস অর্জন করা একচেটিয়া অবস্থান তৈরি কিংবা ধ্বংসের মধ্যে নতুন শিল্প স্থাপন করা।

এক সময় ছিল যখন কোরবানির ক্ষেত্রে ৮০% এর অধিক গবাদিপশু ভারত থেকে আসত। কিন্তু যখন কয়েক বছর আগে এটি প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে, তখন খুব দ্রুত দেশে গবাদিপশু শিল্প খামারিরা বিকল্পভাবে এদেশে গড়ে তুলে সিংহভাগ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হন। তিনি মনে করতেন যে, কেউ ব্যবসায় লাভ খুঁজতে গেলে নতুনত্ব আনতে হবে। এর ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনশীল অবস্থায় বিদ্যমান সরবরাহে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। উদ্ভাবন প্রতিযোগিতার অপরিহার্য চালক হিসেবে বিবেচিত হবে এবং অর্থনৈতিক গতিবিদ্যাকে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে। তিনি মনে করতেন যে, উদ্ভাবনই অর্থনৈতিক কেন্দ্রের সৃজনশীল ধ্বংসলীলার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এদেশে ব্রিটিশশাসিত আমলে আমাদের স্থানীয় তাঁতশিল্প ধ্বংস হয়ে সস্তা ও মিলজাত কাপড় ব্রিটিশরা রপ্তানি করেছিল। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, শিল্প বিবর্তন প্রক্রিয়ার অংশজাত, যা অবিচ্ছিন্নভাবে অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতর থেকে বিপ্লব ঘটায় এবং অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় পুরনোকে ধ্বংস করে নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে এগিয়ে চলে।

উদ্ভাবন প্রক্রিয়ার চালকসমূহকে তিনি চার ভাগে বিভক্ত করেছিলেন- আবিষ্কার, প্রয়োগ, প্রসারণ এবং অনুকরণ। তার এই চিন্তা-চেতনার মৌলিকত্ব অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করতে পারে। আমরা যদিও তেমন বেশি আবিষ্কারে সক্ষম নই, কিন্তু অনুকরণ করে তার ফল ভালই ব্যবহার করতে জানি। এক্ষেত্রে বেক্সিমকো ফার্মা করোনার ওষুধ রেমডিসিভির প্রথম বাংলাদেশে প্রস্তুত করে। পাশাপাশি কাছাকাছি সময়ে ওই ব্র্যান্ডের ওষুধ প্রস্তুতে এসকেএফ ফার্মা পারঙ্গমতা দেখিয়েছে। বস্তুত অনুকরণ করে হলেও কোভিডের ওষুধ তৈরি করা খুবই ভাল কাজ এবং মানবহিতৈষী ঘটনা বলে মনে করি। আসলে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো, উদ্যোক্তাদের কর্মকাণ্ড, বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া এবং উদ্ভাবকদের আবিষ্কারকে প্রয়োগের জন্য বিনিয়োগ, সুষ্ঠু অবস্থান এবং কর্মসংস্থানের জন্য সম্পূর্ণ নতুন সুযোগ তৈরি করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। প্রসারণ ও মৌলিক উদ্ভাবন- যেটি সময়ের সঙ্গে প্রযোজ্য, যখন অনুসরণকারীরা লাভজনকভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করে, নতুন পণ্য যা প্রক্রিয়াজাত হওয়ার মধ্যে থাকে এবং সেক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত কলাকৌশলকে কাজে লাগাতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

এখন যখন আমরা চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তখন অবশ্যই প্রযুক্তি খাতে বিশাল বিনিয়োগ সরকারের চেয়ে বেসরকারি খাতে দরকার। একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৈশিষ্ট্যকে প্রগতিশীল করতে হলে পুনরাবৃত্তি এবং দৈনন্দিন গৎবাঁধা কার্যক্রম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেখানে কোন ধরনের বৃত্তাকার প্রবাহে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় পরিবর্তনের জন্য ধাক্কা দেয়া বাঞ্ছনীয় হতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে অপরিবর্তনশীলতা থেকে মুক্ত করতে হলে সময়কে স্থির ধরে রাখলে চলবে না এবং পুনরুৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হারে পরিবর্তনশীলতা নতুনত্ব এবং কারিগরি ও লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভব। সুম্পিটার প্রথমদিকে বিশ্বাস করতেন যে, উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে নতুনত্ব সম্পাদন করা একমাত্র মৌলিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। চারিত্রিকভাবে উদ্যোক্তারা হলেন বুদ্ধিসম্পন্ন, সতর্ক, শক্তিবর্ধনকারী এবং সংকল্পমনা। উদ্ভাবনের চারটি পরিপূরক কার্যক্রমের সঙ্গে উদ্যোক্তার কর্মকাণ্ড বিভ্রান্ত হতে পারে না এবং এগুলো হচ্ছে ঝুঁকি গ্রহণ, ত্রুটি সংশোধন ও প্রশাসন, স্বাতন্ত্র্য সূচক এবং উদ্যোক্তাবিহীন গতিপ্রকৃতির কর্মকাণ্ড। সমগ্র জীবন সুম্পিটার উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করলেও তার কাজের ধরনকে দু’ভাবে ভাগ করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মকাণ্ডকে ‘প্রথম দিকের তত্ত্ব’ এবং দ্বিতীয় দিকের কর্মকাণ্ডকে ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের তত্ত্ব’। আসলে তার দুটো তত্ত্বের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও মৌলিকত্বে পার্থক্য রয়েছে। তত্ত্ব সব সময়ে বাস্তবতার কাছে পরিবর্তনশীল হয়ে থাকে।

প্রথমদিকের উদ্যোক্তা সম্পর্কিত তত্ত্বে তিনি মনে করতেন যে, উদ্যোক্তাদের কাজ হলো শোষণের মাধ্যমে উৎপাদনের ধরনটির সংস্কার সাধন কিংবা বিপ্লব ঘটানোর একটি আবিষ্কার, কিংবা সাধারণভাবে বলা চলে যে, উৎপাদনের জন্য একটি প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিগত সম্ভাবনাকে একটি নতুন পণ্য বা একটি নতুন উৎস ধারা সৃষ্টির মাধ্যমে একটি নতুন উপায়ে একটি পুরনো উৎপাদন কোন শিল্পের পুনর্গঠন এবং পণ্যসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ সুনিশ্চিত করা দরকার। দেশে আজ যে উন্নয়ন হচ্ছে, সেখানে চেষ্টা করা হচ্ছে ভৌত অবকাঠামোগত সংস্কার সাধন করার। দেশে উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি উদ্যোক্তাদেরও ব্যাংকের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে। উদ্যোক্তা হতে গেলে ব্যাংক ঋণের পাশাপাশি ব্যবসা করার সহজ পদ্ধতির উপাদানসমূহ যেমন প্রণোদনা, নামজারি, ট্রেড লাইসেন্স, জমির রেজিস্ট্রেশন, পরিবেশের ছাড়পত্র, স্থানীয় মস্তানদের চাঁদাবাজি বন্ধ করা, নির্মাণ অনুমোদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ, টেলিফোন ও ইন্টারনেটের সংযোগ, অনুমতি, ছাড়পত্র এবং কেমিক্যালস ব্যবহারের প্রয়োজন হলে পূর্ণ শর্তাবলী দেখা সাপেক্ষে অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রথমদিকে সরকার বেশ কিছু কার্যক্রমে প্রণোদনা দিলেও বৃহৎ অঙ্কের শিল্প-প্রতিষ্ঠান ছাড়া ছোটরা ব্যাংক থেকে পাচ্ছে না। আবার অনেকে করোনার সুযোগ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করছে না। যারা আসলে ক্ষতিগ্রস্ত নয় কিংবা হলেও ঋণের কিস্তি শোধ করতে সক্ষম, তাদের অবশ্যই ঋণের অঙ্ক ফেরত দিতে হবে।

ত্রিশের দশকের শেষের দিকে সুম্পিটার তার পূর্বতন উদ্যোক্তা সম্পর্কিত তত্ত্ব থেকে সরে গিয়ে নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। নতুন তত্ত্বে সুম্পিটার উদ্যোক্তাকে অন্য সকল পক্ষের সঠিক অঙ্ক হিসেবে তৈরি না করে বরং ধারণা, উদ্যোক্তা এবং ব্যাংকারদের মধ্যে সম্পর্ককে আলাদাভাবে বিবেচনার ব্যবস্থা নেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যাংকারদের যে বিবেচনা তা থেকে সরে আসেন। যেখানে পূর্বে ভাবা হতো ব্যাংকাররা সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আর্থিক সরবরাহের জন্য অনুমোদিত উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে কষ্ট করে কাজ করে থাকেন। এর পরিবর্তে প্রথম বাস্তবসম্মত ব্যাংকারের কথা তিনি বলেন, যারা বিচক্ষণতা ও নৈর্ব্যক্তিকতার সঙ্গে ব্যাংকিং করে উদ্যোক্তাকে নমনীয়তার সঙ্গে তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। অথচ সুম্পিটারের দ্বিতীয় তত্ত্ব সে সময়ে কার্যকারিতা পায়নি। অবশ্য এ সময়ে তিনি ব্যবসায় অধ্যয়নের ক্ষেত্রে গাণিতিক মডেলের ব্যবহার বরং বন্ধ্যা জ্ঞানীর চক্রের সৃষ্টি করে বলে অভিমত দেন এবং তাত্ত্বিক, পরিসংখ্যানগত ও ঐতিহ্যগতের মধ্যে ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দিয়ে ছিলেন।
তার এ বক্তব্য পল স্যামুলসনসহ অনেক অর্থনীতিবিদদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। কেননা, তারা গাণিতিক মডেল এবং ইকোনমোট্রিক্স কারণে-অকারণে অর্থনীতিতে ঢোকাতে শুরু করেছিলেন। এ সময়ে সুম্পিটার সুস্পষ্টভাবে গাণিতিক মডেলের ব্যবহারকে অবজ্ঞা করেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্লেষণ, অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

সুম্পিটার দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, মানুষের মধ্যকার কিছু দুর্বলতার কারণে বিশেষত কেউ যদি কোন ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ধারণায় আবদ্ধ হয়ে যায়, তবে সে সমস্ত অর্থনীতিবিদের কাছে পরিমাণগত গণনা পদ্ধতি অধিকতর গণ্য, যা অস্তিত্বহীন হলেও বিশেষভাবে গণ্য এবং কখনও এ সমস্তগুলো অপরিমেয় থাকে। সময়ের বিবর্তনে দেখা যায় যে, অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য আধুনিক অর্থনীতিগুলোয় ক্রমবর্ধমান জটিলতার উদ্ভব ঘটে থাকে। অথচ আজকের জ্ঞান এবং কারিগরি দক্ষতাভিত্তিক অর্থনীতির গতিশীলতা দ্বারা নির্ভরশীল প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সাধিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের সঙ্গে উদ্ভাবনের প্রজন্ম নির্ভর না করে বরং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে। সুম্পিটারের দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্যোক্তার তত্ত্বটি বর্তমানে অতিমারী এবং নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কার্যকর।

যারা এ দুঃসময়ে পরসম্পদ, জায়গা-জমি লুণ্ঠনে ব্যস্ত তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া দরকার। উদ্যোক্তা নেতৃত্বে কর্মক্ষম করার জন্য জ্ঞানের বিকাশ সাধন করে এমন ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটানো এবং নতুনত্বের বোধগম্য করে গড়ে তোলা দরকার। নব্য সুম্পিটারিয়ান অর্থনীতির উদ্ভাবন এবং উদ্যোক্তা ধারণার বিবর্তিত রূপ বর্তমানকালে সবচেয়ে বেশি কার্যক্ষম ও সর্বজনীন যা কিনা এখনও বিকাশমান রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সুম্পিটারের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রায়োগিক কৌশল বর্তমান পর্যায়ে কাজ করতে সক্ষম, বিশেষ করে কোভিড-১৯ দেখা দেয়ার পর। এখন উদ্যোক্তাদের বর্তমান বাস্তবতায় তাদের কার্যক্রম এবং দক্ষতাকে সঙ্কটপরবর্তী অবস্থায় জনকল্যাণের কারণে উপযোগী হিসেবে ব্যবহার করতে হবে- যেখানে দুর্নীতি-ঘুষ ও অন্যায়-জুলুম এবং মানুষের মধ্যকার অতিলোভ বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী, ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ই৪কোনমিস্ট; শিক্ষাসংক্রান্ত বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত; আইটি ও উদ্যোক্তা বিশেষজ্ঞ; সাবেক উপাচার্য প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ