প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
মানুষ, বৃক্ষের মতো আনত হও, হও সবুজ...। এমন আহ্বান যিনি জানিয়েছেন, তিনি প্রকৃতিবিদ ও বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। এই নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৃক্ষের সতেজতা, সরলতা। সবুজের হাতছানি দিয়ে তিনি মানুষকে ডেকেছেন। সবুজ দেশ আর সবুজ মানুষ গড়তে কাজ করেছেন।
সেই মানুষটি আজ সকালে ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮৮ বছর বয়সে শেষ পর্যন্ত না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
দ্বিজেন শর্মাকে প্রথম দেখি সংবাদ অফিসে।
আমি সংবাদে চাকরি করেছি ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত। পুরানা পল্টনের সংবাদ অফিসে তখন আমি যে রুমটিতে বসতাম সেটা ছিল নক্ষত্রখচিত। আমরা একরুমে বসতাম বজলুর রহমান, সন্তোষ গুপ্ত, মকবুলার রহমান, আবুল হাসনাত, মুনীরুজ্জামান, সোহরাব হাসান এবং আমি। মাঝে মাঝে বসত শিল্পী বীরেন সোম। মাঝে মাঝে রফি হক। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা ওই রুমে প্রায়ই আসতেন আড্ডা দিতে। সেখানেই প্রথম দেখেছি দ্বিজেন শর্মাকে। সাহিত্য নিয়ে, রাজনীতিসহ নানা বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা হতো। দ্বিজেনদা বলতেন কম, শুনতেন বেশি। মাঝে মধ্যে এক-আধটা প্রয়োজনীয় প্রশ্ন ও মন্তব্যের মাধ্যমে আলোচনাকে ঘন করে তুলতে পারতেন।
দ্বিজেন শর্মার জন্ম ২৯ মে ১৯২৯ সালে, মৌলভীবাজার জেলার শিমুলিয়া গ্রামে। পিতা চন্দ্ৰকান্ত শৰ্মা এবং মাতা মগ্নময়ী দেবী। তিনি একাধারে নিসর্গবিদ, বৃক্ষপ্রেমিক, অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক, বিজ্ঞানলেখক,গবেষক ও শিক্ষক। উদ্ভিদ, ফুল, পাখি নিয়ে মেতে থেকেছেন সারাটি জীবন। এগুলো নিয়ে বলতে লিখতে পড়তে ভালোবাসেন।
বৃক্ষপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মা অনেক গাছ লাগিয়েছেন। গাছের পরিচর্যা করেছেন। সবুজ প্রকৃতির জন্য লড়ে গেছেন।
কলকাতা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন দ্বিজেন শর্মা। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন।
১৯৫৮ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষক হিসেবে। বরিশালের ব্ৰজমোহন কলেজ ও ঢাকার নটরডেম কলেজ, সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজ ও বাংলা কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অনুবাদকের চাকরি নিয়ে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো চলে যান। দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন প্রবাসজীবন। সেই সুবাদে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও জার্মানি ভ্ৰমণ করেছেন। সবখানেই বোটানিক গার্ডেন খ্যাত প্রধান-প্রধান পার্ক ও বাগান দেখেছেন আনন্দ ও আগ্রহে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি দেখেছেন কাছের অনেক মানুষের নিষ্ঠুর প্রাণসংহার। তারপর বিজয়ী ও বিধ্বস্ত দেশ আবার ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী সাম্যমূলক চেতনায়, দ্বিজেন শর্মাও সপরিবারে ঠাঁই গড়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত দেশে, সাম্যের স্বপ্নাবেশ নিয়ে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বদেশের সিক্ত হওয়ার প্রয়াস রক্তাক্ত আঘাতে টলে উঠে, সমাজতন্ত্র নির্মাণ প্রয়াসও হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়। এমন সব বিপুল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছেন দ্বিজেন শর্মা, আবার দূরত্ব বজায় রেখে অবলোকন করতে পেরেছেন সবকিছু। ফলে জীবন ও সভ্যতার টালমাটাল পথপরিক্রমণের মধ্যে অটল থেকেছেন তিনি, জীবনবিকাশ সাধনায় কোনো ছেদ টানা বা এর থেকে অব্যাহতি নেওয়ার অবসাদ তাঁর মধ্যে কখনও দেখা যায়নি, বরং আরও প্রবল জীবনবাদী হিসেবে তিনি বরণ করে নিয়েছেন বাস্তবতা। জীবনবাদী বটে, তবে সেই সঙ্গে একধরনের নিস্পৃহতাও বহন করেছেন দ্বিজেন শর্মা, যে নিস্পৃহতা বিজ্ঞানীর, সবকিছু পর্যবেক্ষণ-নিরীক্ষণ-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যাচাই করার মানস।
অনেক লিখেছেন বিজ্ঞান, শিক্ষা ও প্রকৃতি বিষয়ে। পেয়েছেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদের ড.কুদরাত-ই-খুদা স্মৃতি স্বর্ণপুরস্কার, এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার এবং শিশু একাডেমী পুরস্কারসহ নান পদক ও সম্মাননা।
জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন স্ত্রী দেবী শর্মার সঙ্গে, রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে। ছেলে মেয়ে দুজনই দেশের বাইরে। রবীন্দ্রসাহিত্য ও সংগীত, দুটোই তাঁর পছন্দের। ত্রিশের বেশি বই লিখেছেন।
মফিদুল হক তাঁর এক লেখায় দ্বিজেন শর্মা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘তাঁর অবলম্বন হৃদয় ও মনন, মননের চর্চায় তাঁর পরিবর্তনময়তার বিরাম নেই, আর হৃদয়বৃত্তিতে তিনি সর্বত্র সতত অপরিবর্তনীয়, একইভাবে উদার ও ভালোবাসায় আপ্লুত। তাই তো দ্বিজেন শর্মা থাকতে পারেন বৃক্ষসম চিরসবুজ। কাজটি কঠিন, কিন্তু যিনি পারেন, তিনি আপনাতেই পারেন। জয় হোক আমাদের এই মানববৃক্ষের।’’ হ্যাঁ, দ্বিজেন দা যতদিন বেঁচেছেন বৃক্ষের মত সবুজ, দৃঢ় ও খাঁড়া হয়েই বেঁচেছেন।
ফতুয়া পরা, কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ, সদা প্রফুল্ল, সংবাদে দেখা দ্বিজেন দার সেই সপ্রতিভ চেহারাটা চোখে ভাসছে। এমন ভালো মানুষ, জ্ঞানী মানুষ, সাদাসিধে মানুষ, একই সঙ্গে সংবেদনশীল মানুষ দ্বিজেন দা ভিন্ন অন্য কেউ দেশে আছেন বলে আমার জানা নেই।
দ্বিজেন দার এই প্রয়াণ সত্যিই জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আরেকজন দ্বিজেন শর্মার জন্য আমাদের কতদিন, কত বছর কত শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে কে জানে!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য