টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
অসীম চক্রবর্তী | ১০ মে, ২০১৮
অনেকেই হয়তো জানেন না, পৃথিবীর নানা অংশে প্রতিদিন অন্তত একশো মিলিয়ন বার বজ্রপাত ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করে। প্রতিটা বজ্রপাত কমপক্ষে এক বিলিয়ন ভোল্ট ইলেক্ট্রিসিটি তৈরি করে, যা দিয়ে একশ ওয়াটের একটি বাল্ব তিনমাস জ্বালানো যায়। কয়েক সেকেন্ডের বজ্রপাতের আর্থিং ২৭৭৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হিট উৎপন্ন করে । যা নিমেষেই ছারখার করে দিতে পারে যেকোনো কিছু। আদতে হচ্ছেও তাই। গত দুই সপ্তাহে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রাণহন্তারক বজ্রপাত নিমেষেই ছারকার করে দিচ্ছে এক একটি কৃষকের প্রাণ, পরিবার এবং স্বপ্ন।
গত কয়দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ছবি বারবার চোখের সামনে ভাসছে। ধান গাছের চারা মুঠি ধরা হাতে বজ্রপাতের শর্টসার্কিটে কয়লা হয়ে যাওয়া এক কৃষকের মুখ। গত কয়দিন ধরে প্রতিবার ভাত খাওয়ার সময়ে যে মুখ বারবার চোখের সামনে এসে অদৃশ্য চপেটাঘাত করে যাচ্ছে। মনখারাপের মাত্রা আরো বহুগুণ বেড়ে গেলো আজকের সকালে আমার গ্রামের দুজন জেলের মৃত্যুর খবরে। ভাত মাছ বাঙালির প্রধান খাদ্য, কিন্তু সেই কৃষক আর জেলেদের জীবন আজ এক ভয়ংকর সংকটে। সেই চপেটাঘাত আর নিজের অপরাধী মনকে শান্ত করতে এবং সংকট থেকে উত্তরণের পথ বিশ্লেষণে এই লেখার সূত্রপাত।
এবার আসুন পদার্থ বিজ্ঞানের সহায়তা নিয়ে কেনো বজ্রপাত হয় তার একটি সহজ বিশ্লেষণ করি। সূর্যের রশ্মি থেকে উৎপাদিত শক্তি গরম আবহাওয়া সৃষ্টি করে। এর সাথে আরো তৈরি করে টর্নেডো, হ্যারিকেন এবং বৃষ্টি। সূর্য তার চারদিকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন হলো দৃশ্যমান আলো, রেডিও তরঙ্গ, গামা রশ্মি এবং এক্স রশ্মি’র সমষ্টি। এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন মহাকাশ থেকে শুরু করে মাটি পর্যন্ত সর্বত্র বিস্তার করে। পৃথিবীর সারফেইস সূর্য থেকে এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন শুষে নেয় এবং তা হিটে রূপান্তর করে।
যেহেতু আমাদের পৃথিবী ঘূর্ণায়মান এবং সূর্যের চারপাশে ঘুরছে তাই সূর্যের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন পৃথিবীর সব প্রান্তে সমান ভাবে পৌঁছায় না। তাই একই সময়ে পৃথিবীর কোনো অংশে অধিক গরম আবার অন্য অংশে অধিক ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। এই অসমান তাপমাত্রা পৃথিবীর আবহাওয়াকে পরিবর্তন করতে সাহায্য করে।
যখন একটি অঞ্চলের সারফেইস অধিক হিট উৎপন্ন করে তখন তা ওই অঞ্চলের উপরের বাতাসকেও গরম করে তোলে। এতে অধিক জলীয়বাষ্প হয়। উষ্ণ জলীয়বাষ্পময় বাতাস ঠাণ্ডা বাতাসের চেয়ে হালকা। তাই এর গতি থাকে ঊর্ধ্বপানে। অনেকটা বাবলের মতো। ঠিক ওই সময়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঊর্ধ্বপানে ধাওয়া বাতাসের শূন্যস্থান পূরণ করে। যাকে ইংরেজিতে বলে কনভেকশন।
যার ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্প কণা বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। এই মুক্ত ইলেকট্রন গুলো মেঘের তলদেশে জমা হয় এবং ইলেকট্রন হারানো পজিটিভ চার্জিত বাষ্পকণা মেঘের একেবারে উপরপৃষ্ঠে চলে যায়। যার ফলশ্রুতিতে মেঘগুলো শক্তিশালী ধারক বা ক্যাপাসিটর এর বৈশিষ্ট্য লাভ করে। মেঘের দুই স্তরে চার্জ তারতম্যের কারণে সেখানে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের শক্তি মেঘে সঞ্চিত চার্জের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
এভাবে বাষ্পকণা এবং মেঘ একে ওপরের সাথে সংঘর্ষ করতে করতে একসময়ে মেঘের উপরিভাগে গিয়ে জমা হয় সব পজিটিভ চার্জ আর সব নেগেটিভ চার্জ এসে যূথবদ্ধ হয় মেঘের তলানিতে। যা খুবই শক্তিশালী নেগেটিভ বৈদ্যুতিক স্পেস তৈরি করে যার প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর সারফেইসে অবস্থানরত সকল ইলেকট্রন ভূপৃষ্ঠের আরো গভীরে চলে যায়। ফলে নির্দিষ্ট এলাকার ভূপৃষ্ঠ হয়ে পড়ে পজিটিভ বিদ্যুৎ ক্ষেত্র।
আমরা জানি পজিটিভ নেগেটিভ একে অন্যকে আকর্ষণ করে। ঠিক যেমন আপনি আকর্ষিত হন আপনার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি। এই আকর্ষণকে একে অন্যের কাছ পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য দরকার মাধ্যম। আমরা সবাই জানি বাতাস বিদ্যুৎ অপরিবাহী। তাহলে মেঘের তলানির নেগেটিভ চার্জ আর ভূপৃষ্ঠের পজিটিভ চার্জ কেমনে একে অপরকে আকর্ষণ করে বজ্রপাত সৃষ্টি করবে ?
যারা এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন তাদের জন্য, মেঘের দুর্দন্ড প্রতাপপূর্ন বিদ্যুৎ ক্ষেত্র প্রচণ্ড চাপের মাধ্যমে বাতাসের অপরিবাহী চরিত্র বিনাশ করে দেয়। যা Dielectric Breakdown নামে পরিচিত। এই ব্রেকডাউনের ফলে বাতাস মেঘ এবং ভূপৃষ্ঠের মধ্যে বিদ্যুৎ চলাচলের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে শর্ট সার্কিট তৈরি করে দেয় এবং বজ্রপাতের সৃষ্টি করে। ঠিক যেমন বর্তমান যুগে মেসেঞ্জার, মধ্যে যুগে পোস্টম্যান আর তারও আগে কবুতর প্রেম বার্তা পৌঁছে দিয়ে হৃৎকমলে কম্পন সৃষ্টি করে।
শুধুমাত্র আমেরিকায় বছরে প্রায় হাজার খানেক মানুষ মারা যায় বজ্রপাতে। যা ঐদেশে অন্যসব প্রাকৃতিক কারণে ঘটিত মৃত্যুর চেয়েও বেশি। আমেরিকার ফ্লোরিডায় বজ্রপাতের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। তবে গত কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে খুবই উচ্চহারে। যার প্রধান কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণ। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে, বজ্রপাত ক্রমাগত পরিবেশ দূষণের ফলে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফল। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে বেশি বেশি পানি বাষ্পীভূত হয়ে অতিরিক্ত মেঘমালার সৃষ্টি হচ্ছে। এত বজ্রপাত তুলনামূলকভাবে বাড়ছে।
এছাড়াও এ ব্যাপারে ২০১৪ সালে University of Berkeley থেকে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। প্রতি ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত ১২ শতাংশ বেড়ে যায় বলে উক্ত গবেষণা থেকে জানা যায়। এ শতাব্দী শেষে বজ্রপাত ৫০ ভাগ বেড়ে যেতে পারে বলে গবেষকরা আশংকা করেন।
তবে কিছু নিরাপত্তা বিধান মেনে চললে বজ্রপাত রোধ করতে না পারলেও বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। যেমন-
মোদ্দাকথা যেহেতু বজ্রপাত সংগঠিত হওয়ার সময়ে উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় সেহেতু উচ্চ বিদ্যুৎ পরিবাহী বস্তু থেকে নিজেকে এবং পরিবার পরিজনকে দূরে রাখুন ।
বজ্রপাত রোধ করতে প্রধান কাজ হলো আপনার চারপাশের পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু দূষণ রোধ করা। প্রচুর পরিমাণে গাছপালা লাগানো। হাওর অথবা খোলা মাঠে তাল জাতীয় গাছ লাগানো। যাতে পাতা পচে এবং ছায়া পড়ে ক্ষেত নষ্ট না হয় আবার বজ্রপাতের হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়।
কেবল জনসচেতনতা তৈরি করে প্রায় আশি ভাগ বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি রোধ করা সম্ভব। সুতরাং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হলো বজ্রপাতজনিত মৃত্যু রোধ করার সবচেয়ে মোক্ষম পদক্ষেপ। স্ব-উদ্যোগে পরিবেশ দূষণ বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া, প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো আর বজ্রপাতের সম্ভাব্য সময়ে নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা নিলেই বজ্রপাতের হিংস্র থাবাকে বহুলাংশে রুখে দেওয়া সম্ভব।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য