প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
দেবজ্যোতি দেবু | ১৭ মার্চ, ২০২০
দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাস যাবত নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রান্ত আতঙ্ক বিশ্বব্যাপী চলমান আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ কে 'মহামারি' ঘোষণা করা হয়েছে। উন্নত বিশ্বের অনেকগুলো দেশ ও এলাকা লক ডাউন করে রাখা হয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে আশাবাদী কিংবা নিশ্চিন্ত থাকার মত কোন লক্ষণ চোখে পড়ছে না!
বিদেশ ফেরত কয়েক হাজার যাত্রীকে (যাদেরকে বিপজ্জনক বলে মনে হয়) মানসম্মত সেবা দেয়ার মত প্রস্তুতি সরকারের নেই! হাসপাতালগুলোতে নেই জরুরী সেবার সুব্যবস্থা! সন্দেহজনক রোগীকে কোথায় চিকিৎসার জন্য নেয়া হবে সেই বিষয়ে কোন সঠিক দিকনির্দেশনা এখন পর্যন্ত জানানো হয়নি! পর্যাপ্ত সেবা না পেয়ে চিকিৎসকদের গালি দিতে পারবেন ঠিকই, কিন্তু যাদের গালি দিচ্ছেন তাদের নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সরকার করেছে কী না সেই খবরটা কেউ নিয়েছেন একবারও?
বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য খুঁজতে বসে দ্বিধায় পড়ে গেছি। দৃশ্যমান কোন সাফল্য আছে কি? এখন পর্যন্ত তারা 'আশংকার কোন কারণ নেই' বলে বলে সাধারণ মানুষকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন। আর পরিসংখ্যানে দিনে দিনে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার বাস্তব চিত্র সকলের চোখের সামনে ভাসছে।
না, করোনাভাইরাসের এই সংক্রমণ আমাদের দেশের ভিতর থেকে ছড়াচ্ছে না। গত এক মাসে যে সকল প্রবাসী বাঙালি দেশে ফিরেছেন তাদের মাধ্যমেই ছড়াচ্ছে। এটা আমি বলছি না, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং সরকারি দলিল বলছে। তারমানে আরও এক মাস আগে থেকেই যদি দেশে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হতো তাহলে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ ছড়ানোর আশংকা অনেকটাই হ্রাস পেত বলে ধারনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এমনটা হয়নি। তাহলে এর বিকল্প হিসেবে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন আমাদের সরকার?
বিদেশ ফেরত যাত্রীদের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে ডাক্তারি পর্যবেক্ষণে না রেখে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হচ্ছে, যেখানে তাদের ১৪ দিন গৃহবন্দী হয়ে থাকতে বলা হচ্ছে।
'কোয়ারেন্টাইন' শব্দটার সাথে আমি পরিচিত ছিলাম না। অর্থ খুঁজতে গিয়ে জানলাম কোয়ারেন্টাইন অর্থ 'সঙ্গরোধ'। অর্থাৎ, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত একটি ঘরে নিজেকে আবদ্ধ রেখে মানুষ, পশু-পাখিসহ সবকিছুর সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। এমনকি আলাদা বাথরুম, প্লেট, গ্লাস, কাপড়, তোয়ালে ব্যবহার করতে হবে যা অন্য কারো সংস্পর্শে আসবে না।
সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের দেশের বাস্তবিক অবস্থা দেখে আমি এটাকে কোনভাবেই কার্যকর কোন সিদ্ধান্ত বলে মানতে পারছি না। কারণ, এখন পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য যাদের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে তাদের অধিকাংশই সেটা মানছেন না। তারা পরিবার নিয়ে পিকনিকে যাচ্ছেন, লোকালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বিয়েতে যাচ্ছেন। মোট কথা প্রতিদিন তারা শত শত লোকের সংস্পর্শে আসছেন যা এই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য সর্বোচ্চ হুমকি স্বরূপ।
এছাড়াও আছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। যাদের সাথে ২৪ ঘণ্টা থাকছেন প্রবাসীরা। যার ফলে নিজে বাইরে না আসলেও পরিবারের যে সকল মানুষ বাইরে আসছেন তাদের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়ানোর আশংকা শতভাগ থেকেই যাচ্ছে। ১৬ মার্চ বাংলাদেশে চিহ্নিত হওয়া করোনা আক্রান্ত তিনজন রোগীই একই পরিবারের। যতটুকু জানতে পেরেছি, করোনা আক্রান্ত প্রবাসীর পরিবারের সদস্য এরা। তার মানে এটা স্পষ্টত প্রমাণিত যে, হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখাটা বাংলাদেশের জন্য কোনভাবেই ফলপ্রসূ কোন সিদ্ধান্ত না।
আমি যে পেশায় আছি, প্রতিদিন কম করে হলে ১৫ থেকে ২০ জন বিদেশ ফেরত বাঙালির সাথে দেখা হয়। তাদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে বাংলাদেশী টাকা দিতে হয়। তার মানে প্রতিদিনই অসংখ্যবার আমাকে বৈদেশিক মুদ্রা হাতে নিতে হয়। এখন সেই মুদ্রার মাধ্যমে যে ভাইরাস ছড়াবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? ৮ ঘণ্টায় কতবার আমি হাত ধুতে যাবো? কতটুকুই বা সচেতন থাকা যায় এমন অবস্থায়? ঐ সকল প্রবাসীদের কতজনই বা পর্যাপ্ত নিয়ম মেনে ঘর থেকে বের হয়েছেন?
নিজের নিরাপত্তার জন্য প্রায় প্রত্যেক সেবা গ্রহীতাকেই আমার প্রশ্ন করতে হয়, 'আপনি কি বিদেশে থাকেন? দেশে কবে এসেছেন?' অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখি উনারা ২ থেকে ৬ দিন, কোন কোন ক্ষেত্রে ১০ দিন আগে এসেছেন। তারমানে তারা সরকারের হোম কোয়ারেন্টাইনের নীতিমালা মানছেন না।
আমি বুঝি তারা এমন প্রশ্নে বিব্রত বোধ করেন। কিন্তু আমাদের সরকারি অব্যবস্থাপনা এবং প্রবাসীদের অসচেতন কার্যকলাপের কারণেই আমাকে এমনটা করতে হয়।
ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে টাকা/মুদ্রাটাও যে একটা ক্ষতিকর মাধ্যম হতে পারে, সেই বিষয়ে এখনও কাউকে মাথা ঘামাতে দেখলাম না! সিলেট শহরে আমার মত আরও শত শত মানুষ এই পেশায় জড়িত আছেন। কখনো ভেবে দেখেছেন বিষয়টা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে?
হয়তো ভাবছেন আমি শুধু প্রবাসী বাঙালিদেরই একা দোষারোপ করে সরকারি অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করতে চাইছি!
না, আমি মোটেও তাদের একার ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছি না। তাদের দায় যেমন আছে তেমনই দায় আছে তাদের পরিবারের মানুষদের। কারণ সর্বপ্রথম আস্কারাটা পরিবার থেকেই আসে। দায় আছে আমরা সকলের যারা তাদেরকে নিয়ম ভেঙে এভাবে প্রকাশ্যে চলাচল করার প্রতিবাদ না করে প্রতিনিয়ত তাদের সংস্পর্শে আসছি। দায় আছে বিমানবন্দরের সেই সকল দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের যারা বিজনেস ক্লাসের যাত্রীদের ক্লিনচেক দিয়ে শুধুমাত্র ইকোনমিক ক্লাসের যাত্রীদের সন্দেহের তালিকায় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। এবং অবশ্যই দায় আছে সরকারি অব্যবস্থাপনার।
দীর্ঘ আড়াইটা মাস! এতো লম্বা সময় পার করে আসার পর আমাদের যে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে থাকার কথা ছিল, আমরা আছি তার ঠিক বিপরীতে। আমি আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য এসব কথা বলছি না, বলছি সরকারি উদাসীনতা দেখে। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দাঁড়িয়েও একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন বলেন ইতালি ফেরত যাত্রীদের সম্পর্কে কোন তথ্য উনার কাছে ছিলা না, উনি ফেসবুক থেকে জেনেছেন! তখন ঠিক কোন ভরসায় আমি নিশ্চিন্ত থাকবো? কীভাবে বিশ্বাস করবো যে আমার দেশের সরকার সঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে করোনা মোকাবেলায় প্রস্তুত আছে?
কিছুদিন আগেও যে দেশে একজনও আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি, ১৭ মার্চ এসে সেই দেশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০ জন! এই সংখ্যা খুব দ্রুতই বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারও যদি পর্যাপ্ত সচেতনতা এবং কার্যকর কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায় তাহলে সংক্রমণের পরিমাণ অনেকাংশেই কমানো যাবে বলে বিশ্বাস করি। তাই দয়া করে সর্বমহলে সবার স্বার্থে সচেতনতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করুন। নিজে বাঁচুন, অন্যদেরও বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য