আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

করোনার হানায় অপ্রস্তুত উন্নয়ন দৌড়ে বুঁদ পৃথিবী

মাসকাওয়াথ আহসান  

মানব সভ্যতার ওপর করোনাভাইরাসের অতর্কিতে হামলায় গোটা পৃথিবীকেই অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে। কারণ পৃথিবী সবসময় উন্নয়নের দৌড়ে বুঁদ। প্রতিদিনের জীবনকে আরও কতটা বিলাসী করে তোলা যায়; সেইখানে যতটা মনোযোগ মানুষের; জীবনকে কতটা নিরাপদ করে তোলা যায়; তা নিয়ে মাথাব্যথা কারোরই নেই।

করোনা যেখানে প্রথম হামলা চালিয়েছে; সেই চীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেশায় মাতোয়ারা। চীনে নববর্ষে একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানানোর সময় বলে, "ধনী হও"। সেই ধনী হতে গিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের বিনাশ করেছে চীন। ইকোনোমিক সুপার পাওয়ার হওয়ার আত্মঘাতী জেদে চীন মনে রাখেনি; ধরিত্রী কেবল টাকাওয়ালা মানুষের নয়; জীবজগতের প্রতিটি প্রাণি ও উদ্ভিদের সমান অধিকার ধরিত্রীর ওপর।

করোনার হামলা থেকে কোন শিক্ষা চীন পেয়েছে বলে মনে হয়না। এ যাত্রা করোনার হামলা প্রতিরোধ করে; আবারো প্রতিরোধপনায় ছদ্ম কৃতিত্ব নিতে শুরু করেছে দেশটি। অথচ মনে রাখেনি পরিবেশবিনাশী টাকার -কারখানা করোনার কারণে মাস তিনেক বন্ধ রাখায় চীনে কার্বন নিঃসরণ কমে এসেছিলো। বেজিং-এর আকাশ থেকে হারিয়ে যাওয়া পাখিরা আবার ফিরে এসেছিলো দূষণ কমে যাওয়ায়।

চীন যেহেতু টাকার খনি; টাকা উপনিবেশ গড়তে চীনারা গোটা পৃথিবীতেই ঘোরাঘুরি করে। চীনা সওদাগরদের স্পর্শ পৃথিবীর যে জনপদ পেয়েছে; সেখানে করোনা ভাইরাসের স্পর্শ ছড়িয়ে পড়েছে। চীনারা টাকা উপার্জনের বোধহীন দৌড়ে জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলায়; পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরে 'কোয়ালিটি টাইম' কাটাতে চেষ্টা সবচেয়ে বেশি করে। সেই কোয়ালিটি টাইমের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘোরা চীনা পর্যটকেরাও করোনার বিষ ছড়িয়েছে অজ্ঞাতে।

করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর, যে ইউরোপ আর পশ্চিমা বিশ্বের সাফল্যের গল্প উপকথা হয়ে ছড়িয়ে আছে; সেই ইউরোপের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাকে তাসের ঘরের ভেঙে পড়তে দেখছি আমরা। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার পরিসংখ্যান নিয়ে যে ইউরোপ সভ্যতার গর্ব অনুভব করে; সেইখানে করোনা মড়কে আক্রান্তদের মাঝ থেকে ডাক্তাররা দৈবচয়নে বাঁচানোর জন্য বেছে নিয়েছেন অল্প-বয়েসিদের। বয়েসিদের ঠেলে দেয়া হয়েছে নিয়তির হাতে; উপায়হীন মৃত্যুর দিকে।

শেষ পর্যন্ত নিয়তিই যদি নির্ধারণ করে মানুষের ভাগ্য; তাহলে উন্নয়নের বেস্টসেলার গপ্পোগুলো আমরা আর শুনবো কেন! করোনা যখন ইটালির মানুষের জীবনের শুল্ক নিচ্ছে; তখন জনশূন্য ভেনিসের খালে ফিরে আসে রাজহাঁস আর ডলফিনেরা। এই ধরিত্রীতে তো তাদেরও সমান অধিকার।

উন্নয়নের ডাইনোসর মডেল নিয়ে মানুষ যখন অস্বীকার করেছে প্রকৃতি ও পরিবেশ; দখল করেছে পাখির আকাশ, মাছের সমুদ্র; তখন করোনাকে মরিয়া হতে দেখা যায় ডাইনোসর মানুষকে বিলুপ্ত করে প্রাণিজগতের অন্যান্যদের দখল আবার দাবি করতে।

করোনার হামলায় সভ্যতার শিক্ষা বা শৃঙ্খলা বলে যদি কিছু থাকে; তা ভেঙে পড়ে মানুষের উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করছি আমরা। ইটালি কিংবা জার্মানির মানুষের সামনে এ যেন আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়; সাইরেন ছাড়া বাকি সব ভীতি উপস্থিত চারপাশে। ভীত হয়ে নিত্য-ব্যবহার্য সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে পৃথিবীর সব জায়গার মানুষ একই রকম উন্মাদ আচরণ করেছে।

করোনার ভয়ে প্রার্থনা গৃহ শূন্য হয়ে পড়েছে। সৃষ্টিকর্তাও যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। উন্নত বিশ্বই যেখানে করোনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে; তখন দক্ষিণ এশিয়ার মতো অনুন্নত জনপদে প্রতিরোধ ভাবনা যে ইউটোপিয়া; তা আমরা খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারি।

কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জনমনোরঞ্জক শাসকেরা 'ডাইনোসর উন্নয়নে'র গল্প বলে বলে জনপদের মানুষের মনে কাল্পনিক উন্নয়ন বিশ্বাস গেঁথে দিয়েছে। করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাই দক্ষিণ এশিয়ার অনেকেই মনে করছে চীনের মতো খানিকটা প্রতিরোধ গড়া হয়তো তাদের পক্ষেও সম্ভব। কিংবা ক্যানাডার মতো নাগরিকদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব হয়তো তাদের সরকারগুলোও নিতে সক্ষম। জনতুষ্টিকর উন্নয়নের ফাঁপা বুলি থেকে এইরকম কাল্পনিক প্রত্যাশা তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক।

আর আছে দক্ষিণ এশিয়ার খানিকটা ধনাঢ্য; কিছু শিক্ষা-সার্টিফিকেট জোগাড় করা লোকেরা। এরা এমনিতেই পৃথিবীর সবচেয়ে আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। তার ওপরে এমন করোনা আক্রান্ত সময়। ফলে দিনমান তারা কেবল উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে চিন্তিত। যাদের জীবন রোজ এনে রোজ খাওয়ার; সেই দারিদ্র্যে বিশীর্ণ মানুষের কথা তারা এমনিতেও ভাবে না; ফলে করোনার সময় ভাবার প্রশ্নই ওঠেনা।

পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যে কোন পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম না বাড়ানোর একটা শৃঙ্খলা তবু আছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় মৃতের সংখ্যা বাড়লে 'কাফনের কাপড়' কিংবা 'চিতার খড়ির' দাম বাড়িয়ে দিতেও সক্ষম এখানকার ব্যবসায়ীরা। কিংবা মিডিয়া করোনা নিয়ে ব্যস্ত; তাই বস্তি পুড়িয়ে দালানের ব্যবসার আয়োজন করে ক্ষমতাবানেরা। অথবা গুম কারিগরেরা যথারীতি চালিয়ে যায় তাদের মাংসের কারবার।

সে কারণে অনাদিকাল ধরে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জীবন নিয়তি নির্ভর। করোনার মড়কে পৃথিবীর সব জায়গার মানুষের জীবনই যেখানে নিয়তির কাছে আত্মসমর্পিত; সেখানে দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা কোন নতুন উপসর্গ নয়।

যে কোন বিপদের নতুন ঢেউ এলে, নীতিনির্ধারকেরা রূপকথার গল্প নিয়ে হাজির হয়; যাদের উপায়হীন প্রান্তিক মানুষ করে রাখা হয়েছে; তারা দলবদ্ধ হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে। আর উপায়-অলা সমর্থ হয়ে ওঠা মানুষেরা দক্ষিণ এশিয়ার বিজন গ্রামে 'ক্যানাডার সচেতনতা প্রচার করে' অত্যন্ত রেগে রেগে। তাদের সব কিছুর ওপরে রাগ। পকেটে টাকা হলেই রাগ বাড়ে; বাঁচার অধিকার বাড়ে। কোয়ারেন্টিন শব্দটি নিও-এফলুয়েন্সের স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়ায়। ফেসবুক লাইভ করে জ্ঞান দেয়া শেষে ম্যাডাম আকলিমা নদী বুয়াকে নির্দেশ দেয়, এই বুয়া হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইউজ না করে; আমার বাসার কোন কিছু স্পর্শ করবেনা যেন।

উন্নত দেশের সরকারগুলো যে করোনাহত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে; সেইখানে দক্ষিণ এশিয়ার পথিকৃৎ বাতেন স্যার, সরকার অমুক করলো না তমুক করলো না বলে দিনমান ক্রোধ বিকিরণ করে। দিনমজুরের ছেলে বাতেন ভাই আজ 'সফল' মানুষ হয়ে আর দিনমজুরের কথা ভাবেনা। বিলাসী সোফায় বসে আর্তনাদ করে, শাটডাউন কমপ্লিট শাটডাউন।

করোনার ভয় সহমত ভাইয়ের কাছে কোন ব্যাপার নয়। সে বাজিয়ে যায় তার ভাঙা রেকর্ড; এই সরকার থাকতে করোনাকে ভয় করিনা।

এইসব ডামাডোলে কয়েকটা দিন টাকার কার্বন কারখানাগুলো বন্ধ থাকলে; কিছু বৃক্ষ কিছু পাখি কটাদিন ভালো করে বেঁচে থাকবে। কারণ এতোসব ডাইনোসর উন্নয়নের সাঁজোয়া বহর নিয়ে এতো বিজয় মিছিল করার পরেও মৃত্যু যখন নিয়তি নির্ভর রয়ে গেলো; তখন কিছুদিনের জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশের দখলে থাকুক না ধরিত্রী।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ