আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

পৃথিবী থমকে গেছে

আব্দুল করিম কিম  

থমকে গেছে পৃথিবী। পৃথিবীর পূর্বগোলার্ধ থেকে পশ্চিম গোলার্ধ, মক্কা থেকে ভ্যাটিকান, নিউইয়র্ক থেকে থিম্পু, হিথরো থেকে সদরঘাট সব জায়গার মানুষ মৃত্যুর ভয়ে নিজেকে গুঁটিয়ে নিয়েছে। চোখে দেখা যায়না-এমন এক শত্রু সাদা-কালো-বাদামি, বৌদ্ধ-মুসলিম-খৃষ্টান-ইহুদি-হিন্দু, উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সকল ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণির মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। ব্রিটিশ রাজপুত্র থেকে শুরু করে ইতালির ফুটপাতে কাজ করা অভিবাসী যুবক-এই অদেখা শত্রুর হামলার শিকার হয়েছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর জন্য গবেষকেরা অনেক সতর্কবার্তা প্রকাশ করেছেন। সেসব সতর্কবার্তায় অজ্ঞাত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা মানব জাতি আক্রান্ত হতে পারে সে আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সেসব আমলে নেইনি। এখন প্রকৃতির হোক আর ঈশ্বরের হোক সাজা আমাদের পেতে হবে। আমরা নিজেই অপরাধী।

বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করা নভেল করোনা ভাইরাস-১৯ শুরুতে চায়নাকে লণ্ডভণ্ড করে দিলেও এখন অবশিষ্ট বিশ্বকে জয় করতে বেড়িয়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের রাজধানী বলে খ্যাত নিউ ইয়র্ক নগরীতে সে ইতিহাসের অকল্পনীয় ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। বিশ্বকে শাসন করা রোম সাম্রাজ্যের একাধিক রাষ্ট্রকে ইতিমধ্যে মৃত্যুপুরি বানিয়ে দিয়েছে নভেল করোনা ভাইরাস। বিশ্বের শক্তিমান রাষ্ট্রসমূহের কাছে থাকা বিলিয়ন বিলিয়ন কোটি ডলার মূল্যের মারণাস্ত্র বেকার পড়ে আছে। শত্রু নিধনে সেই অস্ত্র কোন কাজেই লাগছে না।

আমাদের জীবদ্দশায় পৃথিবীর মহাশক্তিধরদের এমন অসহায়ত্ব চাক্ষুষ দেখতে পারবো স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে পৃথিবীর মানুষের জন্য যে মহাদুর্যোগ আসছে তা আমরা জানতাম। আর জানতাম বলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়ার সংকল্পে আমরা কিছু বোকা মানুষ পরিবেশ রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছি। পৃথিবীর দেশে দেশে আমরা মানুষকে পরিবেশ ও প্রকৃতি বিনষ্টের কার্যকলাপ বন্ধ করতে চিৎকার করেছি।

সবাই যখন বিত্তের পেছনে ছুটেছে, আমরা তখন একটি গাছ বাঁচানোর জন্য লড়েছি। সবাই যখন বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem)-কে ধ্বংস করে নিজের জীবনমান উন্নত করছে, আমরা তখন একটি বিপন্ন প্রাণিকে রক্ষার জন্য পকেটে থাকা সামান্য টাকাটুকু ব্যয় করেছি।

নদীর পানি, জলাধারের পানি বিনষ্ট করে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে যখন একের পর এক সুইমিংপুল ভরা হচ্ছে, আমরা তখন পানি দূষণরোধে পথে নেমেছি। ঘরের খেয়ে আমরা বনের মোষ তাড়াই-এমন কথা বলে আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, মানুষ যখন অনাচার করে ঈশ্বর তখন পয়গম্বর প্রেরণ করে তাদের সাবধান করেন। যারা পয়গম্বরের কথা শুনে অনাচার বন্ধ করে, তারা বেঁচে যায়; আর যারা শোনেনা তারা ধ্বংস হয়।

এই সময়ের মানুষদের সবচেয়ে বড় অনাচার ছিল পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem)-কে বিনষ্ট করা। আর এই অনাচার বন্ধের জন্য পরিবেশবাদীরা মানুষকে সতর্ক করেছে। পৃথিবীব্যাপী যারা পরিবেশ রক্ষার কথা বলেছে, তারা বারবার বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি চলমান অনাচার বন্ধ করা না গেলে বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হবে। বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হলে জলবায়ুর পরিবর্তন হবে। আর জলবায়ুর পরিবর্তন হলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া মানেই মানুষের শরীরে নতুন নতুন রোগবালাইয়ের উৎপাত বাড়বে।

মানুষের শরীরের সুস্থতা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তার চারপাশের পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশের উপর যে যৌগিক চাপ তৈরি হয় তা অনেক গুণ স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে।

যেমন সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি বেশিমাত্রায় পৃথিবীতে প্রবেশ করলে মানুষের শরীরে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। ভূপৃষ্ঠের কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ার ফলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের একটি অংশ জলাশয় ও সমুদ্রের পানির সাথে মিশে পানির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আনে। হিমালয়ের বরফ অতিরিক্ত গলে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে আঞ্চলিকভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং লোনা পানি নদনদীতে প্রবেশ করে মিঠা পানিকে লবণাক্ত করবে। এর ফলে প্রাণিকুলের অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। লবণাক্ত পানি ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তরকে হুমকির মুখে ফেলবে। জমির উর্বরতা নষ্ট হবে। বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার বৃদ্ধির ফলে গোটা পৃথিবীর তাপমাত্রা হুমকির মুখে পড়বে। এ ছাড়া শিল্পকারখানার বর্জ্য নদী, জলাশয় ও সমুদ্রের পানিতে মিশে এরই মধ্যে বিভিন্ন উৎসের পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। পানি দূষণের ফলে পানিতে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্রপ্রাণি বিলুপ্ত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছের খাবার সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া দূষিত পানিতে বড় হওয়া মাছ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সেসব রোগাক্রান্ত মাছ মানব স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। কোনো একটি ক্ষুদ্র প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলে প্রাণি জগতে এর দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলি জমিতে সেচকাজে ব্যবহৃত পানি যদি দূষিত হয়। এতে ওই সবজি ও খাদ্যশস্য গ্রহণের ফলে মানব শরীরে রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা কমবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে সমুদ্রের দূষিত পানিতে ঘন ঘন শৈবাল জন্মাবে। সেই শৈবালে বিভিন্ন অণুজীব জন্ম নেবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কোনো কোন গাছের রেণু উৎপাদন বাড়বে। ফলে হাঁপানি ও এলার্জিজনিত রোগ বাড়বে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে কোনো কোনে পতঙ্গের স্বাভাবিক জীবনকাল দীর্ঘায়িত হবে। ফলে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে তাদের দ্বারা বাহিত রোগ- জীবাণুর সংক্রমণ বা। জলবায়ু পরিবর্তনে মশা, মাছি ও ইঁদুরের প্রজনন বৃদ্ধি পাবে। ফলে বাড়বে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া সহ নতুন নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ হবে। মানুষের জন্য অতীতে ক্ষতিকর ছিলো না বা মানুষের উপকার করেছে এমন ব্যাকটেরিয়া তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত কারণে পরিবর্তিত হবে। ফলে মানুষের জীবন ক্রমান্বয়ে বিপন্ন হতে থাকবে।

অতিরিক্ত গরম আর আর্দ্রতায় রক্তচাপ ওঠানামা, ক্লান্তি এমনকি হিটস্ট্রোক মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ার ফলে দরিদ্র জনগণ পর্যাপ্ত ও সুষম খাবার পাবে না। ফলে অপুষ্টির সমস্যা বাড়বে। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে ত্বক, ফুসফুস, পাকস্থলী, কিডনি ও হাড়সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে জটিল রোগে আক্রান্ত হবে। শিশুদের টনসিলের প্রদাহ, কানের সমস্যা, ঘন ঘন সর্দিকাশি ও রোটা ভাইরাসে আক্রান্তের কারণে মারাত্মক ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হুমকির সম্মুখীন হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মা ও নবজাতকের বিভিন্ন সমস্যা যেমন জন্মগত সমস্যা, মস্তিষ্কের ত্রুটি হতে পারে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর জন্য গবেষকেরা অনেক সতর্কবার্তা প্রকাশ করেছেন। সেসব সতর্কবার্তায় অজ্ঞাত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা মানব জাতি আক্রান্ত হতে পারে সে আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সেসব আমলে নেইনি। আজ সবাই জীবনের সমস্ত ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ঘরে বসে আছি। নিজের জীবনকে আরামদায়ক করতে যেয়ে পৃথিবীর প্রতি আমরা চরম অনাচার করেছি। বিজ্ঞান বলেছে গবেষণা দিয়ে-যা হচ্ছে, তা সঠিক হচ্ছে না। আর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে যদি দেখতে চাওয়া হয় করোনা ভাইরাসের এই মহামারিকে, তবে সেই ক্ষেত্রেও মানুষ দোষী। পৃথিবীর মানুষ, সে যে ধর্মমতেই বিশ্বাস করে না কেন- নিজের ধর্মকে সে কি যথাযথ ভাবে অনুসরণ করেছে? পৃথিবীর কোন ধর্ম প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনাশের অনুমতি দেয়নি। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ধর্মাচারী হয়েও প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনাশ করেছে। এখন প্রকৃতির হোক আর ঈশ্বরের হোক সাজা আমাদের পেতে হবে। আমরা নিজেই অপরাধী।

আব্দুল করিম কিম, সমন্বয়ক, সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও প্রকৃতি রক্ষা পরিষদ।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ