প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ১২ এপ্রিল, ২০২১
যতদূর চোখ যায় পড়ে আছে কঙ্কাল অথবা ফসিল বলা যায়! এই নদীর নামেই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি বড় বড় নৌকা এসে ভিড়ত এখানে। আসত ব্যাপারির নৌকা; সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা বরিশাল অঞ্চল থেকে নৌকা বোঝাই করে নিয়ে আসতো রকমারি মশলা, গুড়, তৈল; বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতো এসব। কৃষিপ্রধান অঞ্চল একমাত্র আয় বোরো ধান। সেই ধান তোলা হলেই বর্ষায় আসতো ধানের পাইকারদের নৌকা। হাজার মণ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নৌকা। আমাদের কাছে এইসব পালতোলা নৌকাই বিশাল কৌতূহল, মনে হতো চাঁদসওদাগরের সপ্তডিঙা। বিকেল হলে নৌকায় রান্নার আয়োজনে এক অদ্ভুত ঝাল ঝাল, গন্ধ ছড়িয়ে পড়তো যেন নদীর বাতাসে... কতদিন ইচ্ছে হতো, ইস যদি একদিন খাওয়া যেত নৌকায়।
আমাদের বাড়ির দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষদের নিয়ে একটা গ্রুপ আছে ফেইসবুকে, বড়বাড়ি গ্রুপ। ছোট ভাই গ্রুপে ছবিটি শেয়ার দেয়ার পর মনটা কেমন হু হু করে উঠে, মরে যাওয়া নদীটিকে দেখে। এই শান বাঁধানো ঘাটের জৌলুস সেদিন ছিল না, জৌলুস ছিল নদীর। এই ঘাটের পাশেই ছিল আমাদের বিশাল রাইছমিল, অত্র অঞ্চলে সেটাই ছিল প্রথম রাইস মিল। সেই আমলে নাকি করাচি থেকে এই রাইস মিল আনা হয়েছিল। রাইস মিলের পানির ট্যাংক ছিল আমাদের বিশাল কৌতূহল, কুয়ার মত বিশাল দুই পানির ট্যাংক। একটায় গরম পানি এসে পড়ত অন্যটায় ছিল ঠাণ্ডা পানি। মাইনে দিয়ে প্রশিক্ষিত ড্রাইভার রাখতে হত এই মিলের জন্য। আমার নামকরণ অনুষ্ঠানে আমাদের এক ড্রাইভার নাকি আমার জুয়েল নামটি দিয়েছিলেন, সবগুলো নামের সাথে দ্বীপ জ্বালিয়ে সর্বশেষ যে নামের দ্বীপটি নিভে সেইটি চূড়ান্ত হয় নাম হিসাবে। ভদ্রলোকের দেয়া সেই নামটির দ্বীপ নিভেনি, তাই আমার নামটিও থেকে যায়। কতকিছুর সাথে কতকিছু মিশে থাকে! যেমন নদীর সাথে রাইস মিল, রাইস মিলের সাথে আমার নিজের নাম! কি অদ্ভুত!
এই নদীকে ঘিরে কত স্মৃতি আছে আমাদের। বর্ষায় নৌকাবাইচ, হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার। কত জায়গা থেকে আসতো বাইচের নৌকা, আমাদের গ্রামেরও দুইটা বাইচের নৌকা ছিল। একটা অমূল্য মাস্টারের নৌকা, অন্যটা প্রাণেশ বাবুর নৌকা। নৌকা বাইচের দিন নদীর দুইপাড়ে শুধু মানুষ আর মানুষ। গাড়ি ঘোড়া কিছুই ছিল না কিভাবে খবর পৌঁছাতো, কিভাবে মানুষ আসত সেটা ভেবেই অবাক লাগে। এখন তো ফেইসবুকে স্ট্যাটাস ইভেন্ট সবই আছে। তখন ছিল বাজারে ঢোল পেটানো। টিনের মধ্যে লাটি দিয়ে আওয়াজ করে এইসব ইভেন্টের ঘোষণা দিত।
মনসা পূজার বিসর্জনে আমরা ছোটরাও সেখানে সাধারণ নৌকা দিয়েই সমবয়সীদের সাথে নৌকা বাইচে মেতে উঠতাম। নদীটির ঘাটের ঠিক বরাবর অন্যপাড়ে, কালা শাহ'র মাজার। "আমার মুর্শিদ পরশ মনি গো, লোহারে বানাইলো কাঞ্চা সোনা" বিখ্যাত সেই গানের ফকির সাধক কালা শাহের মাজারের বাৎসরিক উরসে প্রতিবছর মেলা বসত। এখন হয় কিনা জানি না। ছোটবেলায় মেঘের কান্দির মেলা, ভাইটগাঁওয়ের মেলার জন্য ফাল্গুন মাসে আমরা অপেক্ষায় থাকতাম সারা বছর। কিন্তু উরসের মেলায় যাওয়ার অনুমতি ছিল না। সারারাত উরস থেকে গান ভেসে আসত, বাউল গান, মনটা খুব টানতো সেখানে যাওয়ার জন্য। কলেজে উঠার পর বেশ কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল সেই মাজারে। পরে তো জীবনখেলায়, মেলা হারিয়ে গেছে জীবন থেকে।
এই নদীতে এক ভরবর্ষায় ধাইপুরে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে মারামারি, দৌড়াদৌড়ি , তাড়াহুড়ো, ফিরতি খেয়ায়, ঠিকমত সাঁতার না জানা আমি ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাই। কেউ একজন টেনে পাড়ে তুলেছিল, সেই মুখটা ও আজ মনে নেই। কে সেদিন নদী থেকে টেনে তুলেছিল আমাকে। মানুষ এমনই যে মানুষটি প্রাণ বাঁচালো তাঁকেই মনে রাখতে পারিনি।
বড়দের কাছে গল্প শুনতাম এই নদী দিয়ে জাহাজ, স্টিমার যাতায়াত করতো। এই নদীকে শাসন করতে ব্রিটিশ আমলের দেয়া বেড়িবাঁধ এখন বিশাল গ্রাম। এই নদী মিশেছিল কুশিয়ারা-কালনীর সাথে, সেই মিলন মোহনায় মানুষের বসতি। বিবিয়ানাও মৃত এখন। রূপ জৌলুস কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
এই নদীকে ঘিরে বসতি আমাদের পুরো এলাকার। এই নদীতে, নৌকা ভাসিয়েই আমার কোন পূর্বপুরুষ হয়তো এখানে এসে বসতি গড়েছিলেন, আমাদের কয় পুরুষের বসতি এই গ্রামে- আমি নিজেও জানি না। প্রতিবছর পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তর্পণ নামক একটা ধর্মীয় রীতি প্রচলিত আছে সেখানে সাত পুরুষের নাম ধরে মন্ত্র উচ্চারিত হয়। আমাদের সাতপুরুষ ধরে এই বিবিয়ানার সাথে জড়িয়ে আছে এইটা বলতে পারি। হয়তো আরও বেশি পুরুষের বসতি আমাদের এই গ্রামে। এই নদীকে ঘিরেই আমাদের কৃষি ব্যবস্থা ছিল। নদী থেকে অসংখ্য খাল প্রবেশ করেছিল হাওরে। প্রতি বছর বৈশাখ আসার আগেই সেই সব খালের মুখে বাঁধ দেয়া হত যাতে পানি হাওরে প্রবেশ করতে না পারে। মানুষের শাসন কি আর নদী মানে, ফুলে ফেঁপে ঠিকই সেই সব খালের মুখের বাঁধ ভেঙে পানি পৌঁছে যেত হাওরে। যাকে আমরা স্থানীয়ভাবে বলি ঢালা; সেই সব ঢালা ও আজ আর নেই। ঢালা ছুটা মানেই মাছ ধরার উৎসব ছিল। কোথা থেকে আসত এত মাছ কে জানে!
গ্রাম ছেড়ে শহরমুখি মানুষ, আমরাও ছেলেবেলায় গ্রাম ছাড়ি। কিন্তু বাড়িতে গেলে ছবির যে বাঁকটি দেখা যায় এর পাড় ধরে আমাদের বন্ধুদের রাতের আড্ডা, গলা ছেড়ে হেড়ে গলায় গান নদীর জল ছুঁয়ে পৌঁছে দিতাম দূরে কোথাও কোন নারীর হৃদয়ে। নৌ যোগাযোগ ফুরিয়ে গেছে, নদীর পাড় এখন পাকা রাস্তা, রাত বিরোতে ভেঁপু বাজিয়ে চলে যায় মোটরযান। ঘাটে আর নৌকা ভিড়ে না। শুধু স্মৃতিরা ভিড়ে..
একদিন যে নদীতে নৌকা ভাসিয়ে আমার কোন পূর্বপুরুষ এখানে এসেছিল, সেখান থেকে গাড়িতে চড়ে আমি হই দেশান্তরি। বিবর্তন এইভাবেই ঘটে। নদীর মরে যাওয়ার সাথে সাথে কি সভ্যতারা মরে যায়? কিন্তু যতদূর জানি নদীরা তো মরে না, শুধু গতি পরিবর্তন করে, দিক পরিবর্তন করে, এক কূল গড়ে এক কূল ভাঙে। আমাদের নদীগুলোকে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়। লন্ডন শহর যে নদীকে ঘিরে সেই নদীটির নাম "টেমস" মাঝে মাঝে টেমসের পাড়ে গেলে অবাক হয়ে দেখি, কোথায় আমাদের দেশের নদী আর কোথায় টেমস! শুধু পরিকল্পনা করে একটা নদীকে এতো সুন্দর করে সাজিয়েছে। প্রতিবছর সারা পৃথিবী থেকে মানুষ আসে শুধু টাওয়ার ব্রিজ আর সুড়ঙ্গপথ দেখতে। টেমসের চেয়ে কত সুন্দর সুন্দর নদনদী ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা কত? আজও সঠিক কোন হিসাব নেই যে সব নদীর পলি থেকে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। কি সুন্দর সুন্দর নাম নদী সমূহের! মধুমতী, কর্ণফুলী, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, কপোতাক্ষ, বংশী, ডাকাতিয়া, কীর্তনখোলা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা; আর আমাদের বিবিয়ানার মত স্থানীয় কত শত নদী ছড়িয়ে আছে দেশের আনাচে কানাচে আমরা নাম জানি না তাদের।
নদী নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের হিসাবে আগামী কয়েক বছরে ২৫/৩০টি নদী মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাবে। অনেক নদীতো মানচিত্র থেকে মুছেও গেছে। নদী নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি, কিন্তু এই ছবিটা দেখার পর একটা হাহাকার ভিড় করে যেন বুকের মাঝে।
সৈয়দ শামসুল হকের আমার পরিচয় কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন-
আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে। (সংক্ষেপিত)
বাঙালির আত্মপরিচয় পরিচয় তো এই নদী আর পলি। নদী আর পলি ছাড়া বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাল্যশিক্ষা থেকেই জেনে আসছি নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান দেশের প্রাণ আমাদের নদী। নদীগুলো মরে শ্মশান হয়ে যাচ্ছে। মধ্যম আয়ের বাংলাদেশে কৃষির চেয়ে হয়তো শিল্পায়ন প্রাধান্য পাবে বেশি সেখানে নদী বাঁচাও, বৃক্ষ বাঁচাও, পাহাড় বাঁচাও এক ধরনের আঁতলামি মনে করেন অনেকেই।
নদীরাও মনে হচ্ছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু, অন্তত নামের কারণে ও সেটা বলা যেতে পারে। আড়িয়াল খা বা এই জাতীয় দুই একটা বাদ দিলে সব নদীর নামই বাংলা নাম। বাঙলাকে এখন আমরা হিন্দুয়ানী ভাষা বা সংখ্যালঘু ভাষা হিসাবেই বিবেচনা করেন অনেকে। সংখ্যালঘুরা যেভাবে দখল নির্যাতনে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, নদীরা দখল নির্যাতনে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।
বয়ে যাওয়া নদীর স্রোত, পূবালী বাতাস, বর্ষার থৈ থৈ, হেমন্তের কাশফুল, হাজার হাজার বছরে এই দেশের মানুষকে যেভাবে তৈরি করেছিল। আমার মনে হয় মানুষেরও জেনেটিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। মানুষেরও ভিতর শুকিয়ে গেছে, সেখানে মায়া নেই, প্রেম নেই, আছে ধূ ধূ বালুচর, ঘৃণা, ক্ষোভ আর হিংসা।
সরকার বৃহৎ প্রকল্পের মাঝে সারা দেশে নদী খনন কর্মসূচি ছিল। জানি না সেই প্রকল্পের কতদূর। সেই নদী খনন কি আমার বিবিয়ানা পর্যন্ত পৌঁছাবে? আমি জানি না। নদীর মুখের দখল তুলে দিয়ে যদি খনন করে কোনদিন কি স্রোতস্বিনী হবে মরে যাওয়া আমার হাজার বছরের শিকড়।
ধানসিঁড়ি নদীর কবি জীবনানন্দ দাশের যে শালিক মরে যায় কবিতায় বলেন-
চরণ মুছিয়া নিয়া চলে গেছে;-মাঝপথে জলের উচ্ছ্বাসে
বাধা পেয়ে নদীরা মজিয়া গেছে দিকে দিকে-শ্মশানের পাশে।
নদীর সাথে সাথে সভ্যতা ও শ্মশানের পাশে চলে যাবে, তাই বাংলাদেশের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য